ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

সময় এখন বই কেনার

প্রকাশনার সময়: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২০:৪৭
ফাইল ছবি

একুশের উচ্ছ্বাসের পর গেল দুদিন বইমেলার ছিল পরিবেশ অনেকটা নিরিবিলি। বেলা ৩টায় মেলা খুললেও লোকসমাগম হয় বিকেল থেকে। যারা এসেছিলেন, তারা নতুন-পুরোনো বই যাচাই-বাছাই করে কেনাকাটার প্রতিই আগ্রহী ছিলেন। স্টলগুলোর সামনে গাদাগাদি ভিড় না থাকায় সময় নিয়ে বই বাছাই করতে পেরেছেন ক্রেতারা। এখন সব স্টলেই প্রকাশকরা তাদের বেশিরভাগ নতুন বই নিয়ে এসেছেন। ফলে মেলায় এখন বই কেনার জন্য চমৎকার পরিবেশ।

শুক্রবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) এবারকার মেলার সবশেষ শুক্রবার। এদিনও মেলার দ্বার খুলে দেয়া হবে বেলা ১১টায়। চলবে একটানা রাত ৯টা পর্যন্ত। এদিনও প্রথম দুই ঘণ্টা শিশুপ্রহর। শিশু চত্বরে থাকবে সিসিমপুরের চরিত্রগুলোর বিশেষ পরিবেশনা। এর আগে সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সংগীত প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার প্রদান করা হবে। অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ প্রদান করবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। সভাপতিত্ব করবেন নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদার।

আদাবর থেকে থেকে এসেছিলেন বায়িং হাউস কর্মকর্তা আবদুল আলিম ও মেহেরিন আফসানা দম্পতি। একুশের দুদিন পরেও পোশাকে সাদা-কালোর একুশের ঐতিহ্য। তারা বললেন, একুশের দিনের প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে বই কেনা যাবে না, এটা ভেবেই সেদিন আসেননি। বৃহস্পতিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) এসেছেন মূলত বই কেনার লক্ষ্য নিয়েই। আলিমের পছন্দ চিরায়ত উপন্যাস, ভ্রমণ-সাহিত্য ও মুক্তিযুদ্ধ-ইতিহাসবিষয়ক বই। তার স্ত্রী অবশ্য কিনবেন রান্নার বই আর হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক, সুমন্ত আসলামের উপন্যাস।

অন্যপ্রকাশের প্যাভিলিয়নের সামনে সহধর্মিণী মিনার্ভা রহমানকে নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের বই দেখছিলেন জার্মান প্রবাসী মিজানুর রহমান রিকু। তিনি জানান, সেই ১২ বছর বয়স থেকে বই পড়ার অভ্যাস। প্রবাসে থাকায় বাংলা বই হাতের কাছে না পাওয়ায় পড়াটা তেমন হয়ে ওঠে না। ছুটিতে দেশে এসেছি। ঈদের পর জার্মানিতে নিজ কর্মস্থলে ফিরে যাব। পরিকল্পনা করে আজই (বৃহস্পতিবার) মেলায় আসলাম অনেকগুলো বই কেনার জন্য। এখন হুমায়ূন আহমেদের বইগুলো দেখছি। তালিকা নিয়েই এসেছি। তালিকা ধরে ধরে সেগুলো কিনছি। হুমায়ুন আজাদ, আহমদ ছফা, তসলিমা নাসরীন, আনিসুল হক, আহসান হাবীব ও রবীন্দ্র-নজরুল সংগ্রহ কেনার ইচ্ছে আছে।

একই স্টলের সামনে কথা হয় কলেজপড়ুয়া রুচিতা হকের সঙ্গে। বাবা আজমল হকের সঙ্গে মেলায় এসেছেন। মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও আনিসুল হকের বই পড়লেও রুচিতা পছন্দের শীর্ষে হুমায়ূন আহমেদ। ইচ্ছে আছে বেছে বেশ কয়েকটি হুমায়ূন সংগ্রহ কেনার।

অন্যপ্রকাশের পরিচালক সিরাজুল কবির চৌধুরী বলেন, ‘এখনও হুমায়ূন আহমেদ জনপ্রিয়। তিনি না থাকলেও অনেকেই তার বইয়ের খোঁজ করেন। অনন্যা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মনিরুল হক বলেন, ‘বইমেলায় হুমায়ূন আছেন, আবার নেই। তিনি মেলায় এলে পাঠক দীর্ঘলাইন ধরে বই কিনতেন। এখনও পাঠক তার বই কেনেন। না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার পরেও হুমায়ূন আহমেদের জায়গাটা নিতে পারেননি কোনো লেখক।’

মেলায় ঢাকার বাইরের পাঠক-ক্রেতারাও আছেন। গাজীপুর থেকে বইমেলায় এসেছিলেন শিক্ষক মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, ‘চমৎকার ব্যাপার হচ্ছে দিনে দিনেই গাজীপুর থেকে এসে আবার ফেরত যাওয়া যায়। সকালে রওনা দিয়ে দুপুরে ঢাকা এসেছি শুধু বইমেলা থেকে কিছু নতুন বই সংগ্রহ করার জন্য। তিনি জানালেন, একটি লাইব্রেরি রয়েছে তার। এখান থেকে বই কেনা এবং ভাড়ায় বই নেয়া যায়। তাই প্রতি বছর লাইব্রেরির জন্য বেছে বেছে বই কেনেন তিনি। আগের বছরগুলোতে বইয়ে দাম সাধ্যের মধ্যে থাকলেও এবার নানা কারণে মোটা দাগে বই কেনা যাচ্ছে না। তবে যেগুলো না কিনলেই নয় সেগুলোর কেনার ইচ্ছে রয়েছে। বিশেষ করে বাংলা একাডেমির অভিধানগুলো কিনবেন তিনি। এ ছাড়া চিরায়ত সাহিত্য কেনারও ইচ্ছে রয়েছে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সব শ্রেণির পাঠকের কাছে এখনও ভালোবাসার। এখনও সব শ্রেণির পাঠকের কাছে সমান সমাদৃত তারা। একাধিক প্রকাশক ও বিক্রয়কর্মী জানান, মেলায় রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের বইয়ের চাহিদা খুব ভালো, বিক্রিও সন্তোষজনক। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের ছোট ছোট বই, রচনাবলি এসবের চাহিদা বেশি। সব বয়সের পাঠকই নজরুল-রবীন্দ্রনাথের বই খুঁজতে খুঁজতে নির্দিষ্ট স্টলে পৌঁছেন।

এবারের বইমেলায় রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে নিয়ে নেই কোনো নতুন গবেষণাধর্মী বই। এর কারণ হিসেবে জানা যায়, পাঠকদের আগ্রহ কম ও মানসম্মত গবেষকের অভাব। নজরুল গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিক্রয়কর্মী রাসেল বলেন,‘দুটি বই নতুন করে প্রকাশ করা হয়েছে। গবেষণাধর্মী বই কম আসার কারণ গবেষকের অভাব। তাছাড়াও বড় কারণ পাঠকদের এই ধরনের বইয়ের প্রতি আগ্রহ কম। তারা রচনাবলি আর তার বই খোঁজেন বেশি। আবালবৃদ্ধবনিতা সব বয়সের পাঠকই নজরুলের খোঁজে আমাদের এখানে আসেন।’

বাংলা একাডেমির বিক্রয়কর্মী মনীষা বলেন, ‘সব শ্রেণির পাঠকের আগ্রহ রয়েছে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের প্রতি। সবাই এসে রচনাবলি খোঁজ করেন। এবার মেলা উপলক্ষে নতুন কোনো বই আসেনি।’ ঐতিহ্য প্রকাশের প্রধান নির্বাহী আরিফুর রহমান নাইম বলেন, ‘আমাদের এখানে রবীন্দ্রনাথের বই আছে বেশ কিছু। সবাই আসছেন, কিনছেন। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গবেষকরা। ওনাকে নিয়ে গবেষণাধর্মী নতুন কোনো বই নেই।’

পুঁথিনিলয় প্রকাশের বিক্রয়কর্মী বৃষ্টি বলেন, ‘আমাদের এখানকার রবীন্দ্রনাথের বইগুলো কিছুটা ভিন্ন উপস্থাপনায় প্রকাশ করা হয়েছে। যার ফলে যে কেউ এসে দেখছেন, কিনছেন। সব বয়সের পাঠকেরই তার বইয়ে আগ্রহ আছে।’

বাংলা একাডেমির জনসংযোগ উপবিভাগের দেয়া তথ্য মতে, বৃহস্পতিবার মেলায় নতুন বই এসেছে ৭৮টি। মেলায় মিজান পাবলিশার্স এনেছে আনিসুল হকের ‘চার কিশোর গোয়েন্দা’, অজিত কুমার বড়ুয়ার ‘আমার দেখা মুক্তিযুদ্ধ ও কিছু অসম্পূর্ণ কাজ’ ও তুষার কান্তি বর্মণের ‘জামাই বউ’, পাঠক সমাবেশ এনেছে মাহবুব সাবেরের ‘বেলাড অব রোহিঙ্গা’, বইপুস্তক প্রকাশন এনেছে কাঞ্চন রানী দত্তের ছোট গল্পের বই ‘মেঘসীমানার শূন্যরেখায়’, স্বপ্ন ৭১ এনেছে রনজিৎ সরকারের ‘জয়শ্রীর জয়ধ্বনি’, কথাপ্রকাশ এনেছে মুহিত হাসানের ‘মুজতবা রঙ্গ’ ও জেসমিন আক্তারের ‘ব্যবচ্ছেদ’, ঐতিহ্য এনেছে শামসুজ্জামান খানের ‘ঢাকাইয়া ও গ্রাম বাংলার রসিকতা’, হাসান হামিদের ‘গোলাপী মাছ’, পিয়াস মজিদের ‘মারবেল ফলের মওসুম’ ও হাসান রোবায়েতের ‘ব্রিজ পেরোলেই অন্য ঋতুর দেশ’, সময় প্রকাশন এনেছে আহমদ রফিকের ‘ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশ কথা’ ও হুমায়ুন কবিরের ‘হলুদ সাহিত্যের ছলচাতুরি ও অন্যান্য প্রবন্ধ’।

বৃহস্পতিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) বইমেলার মূলমঞ্চে ছিল ‘জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুবিষয়ক কথাসাহিত্য, নাটক ও চলচ্চিত্র এবং জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুবিষয়ক গবেষণা ও মুক্তগদ্য চর্চা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মিল্টন বিশ্বাস এবং ফরিদ কবির। আলোচক ছিলেন রফিকুর রশীদ, সুভাষ সিংহ রায়, সরিফা সালোয়া ডিনা, মাসুদ পথিক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন গোলাম কুদ্দুছ।

প্রাবন্ধিকদ্বয় বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনৈতিক আদর্শ, তার মৃত্যু ও মৃত্যুঞ্জয়ী ভূমিকা উপস্থাপিত হয়েছে শতাধিক ছোটগল্প এবং তিরিশের অধিক উপন্যাস, পঞ্চাশটির মতো মঞ্চনাটক ও চলচ্চিত্রে। বর্তমান শতাব্দীতেও বঙ্গবন্ধু বাঙালি সাহিত্যিকদের কাছে সৃষ্টিশীলতার এক অফুরান উৎস। অপরদিকে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে যত গবেষণা, যত মুক্তগদ্য ও স্মৃতিগদ্য লেখা হয়েছে, পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে এত গবেষণা এবং এত গ্রন্থ রচিত হয়েছে বলে জানা নেই। তবে এত গবেষণা, এত গ্রন্থ রচিত হলেও এ নিয়ে আত্মশ্লাঘায় ভোগার সুযোগ কতটুকু আছে, সেটাই বড় প্রশ্ন।’

আলোচকবৃন্দ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বিষয়ক কথাসাহিত্য-নাটক-চলচ্চিত্র-মুক্তগদ্য ও স্মৃতিগদ্য সংখ্যায় বিপুল তবে গুণগত উৎকর্ষের বিষয়টিও এক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনায় রাখতে হবে। জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যে সব রচনাকর্ম আমরা উপহার পেয়েছি এখন প্রয়োজন তার যথাযথ বিশ্লেষণ।’

সভাপতির বক্তব্যে গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বিষয়ক শিল্প-সাহিত্যচর্চা একটি চলমান বিষয়। প্রতিদিনই এ বিষয়ে নতুন নতুন সৃষ্টিকর্ম যুক্ত হচ্ছে। এ বিষয়ে বিপুল সৃষ্টিকর্ম যেমন একদিকে আশা-জাগানিয়া তেমনি মানের বিষয়টি নিশ্চিত না হলে এ বিষয়ে আমাদের সচেতনতার প্রয়োজন আছে।’

লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কামাল চৌধুরী, জহরত আরা, মোস্তফা আল-মেহমুদ-রাসেল এবং আনজীর লিটন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন ভাস্কর রাশা, দুলাল সরকার, কামরুজ্জামান, রাজীব কুমার সাহা, মাহবুবা ফারুক, আতিক আজিজ। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী শফিকুল ইসলাম বাহার, চৌধুরী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, জিনিয়া ফেরদৌস রুনা এবং অনন্যা সাহা। ছিল হাসান আবদুল্লাহ বিপ্লবের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ঘাসফুল’, শাহিনুর আল-আমিনের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সম্প্রীতি সংস্কৃতি সংসদ’-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী ঝুমা খন্দকার, চঞ্চল খান, ফাহিম হোসেন চৌধুরী, অণিমা রায়, মঞ্জু সাহা, মিরা মণ্ডল, আশরাফ মাহমুদ।

শুক্রবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা ও পরবর্তীকালের সাহিত্যতত্ত্ব শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মাসুদুজ্জামান। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন নিরঞ্জন অধিকারী, এজাজ ইউসুফী, বিপ্লব মোস্তাফিজ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন রাশিদ আসকারী।

নয়া শতাব্দী/জেআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ