সাজসজ্জার ক্ষেত্রে প্রথমে ভাবতে হবে, আপনি কার জন্য এবং কাকে দেখানোর জন্য সাজবেন। কোরআনে কারিমে নারীদের সৌন্দর্য প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। তবে মাহরাম ১৪ শ্রেণির পুরুষ ছাড়া। কাজেই নারী, নারীসদৃশ হিজড়া এবং মাহরাম পুরুষদের সামনে সাজসজ্জার প্রদর্শন বৈধ। তবে স্বামী ব্যতীত অন্য মাহরাম পুরুষের (ছেলে, পিতা, ভাই প্রমুখ) সামনে পেট ও পিঠের সৌন্দর্য প্রকাশ করা জায়েজ নয়। (বাদায়ে’: ৫/১২০)
এমনকি তাদের মধ্য থেকে যদি কারো সামনে সাজসজ্জা প্রদর্শনে ফেতনার প্রবল আশঙ্কা থাকে তাহলে তার সামনেও সৌন্দর্য প্রকাশ নাজায়েজ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো কাছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। (সুরা নূর: ৩১)
আর স্বামীর সামনে সাজসজ্জা ও সৌন্দর্য প্রদর্শন শুধু বৈধই নয় বরং করণীয়। আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলতেন, ‘কোনো মুমিন ব্যক্তি আল্লাহভীতির পর উত্তম যা লাভ করে তা হলো পুণ্যময়ী স্ত্রী। স্বামী তাকে কোনো নির্দেশ দিলে সে তা পালন করে; সে তার দিকে তাকালে (তার বাহ্যিক সাজসজ্জা ও চরিত্রের মাধুর্যতা) তাকে আনন্দিত করে এবং সে তাকে শপথ করে কিছু বললে সে তা পূর্ণ করে। আর স্বামীর অনুপস্থিতিতে সে তার সম্ভ্রম ও সম্পদের হেফাজত করে।’ (ইবন মাজাহ: ১৮৫৭)
সাজসজ্জার ক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতি
নারীর জন্য কী ধরনের সাজসজ্জা বৈধ হবে ইসলাম এক্ষেত্রে কিছু মূলনীতি আরোপ করেছে। মূলনীতিগুলো হলো—
১- কোনো সাজসজ্জা হারাম হওয়ার ব্যাপারে যতক্ষণ পর্যন্ত দলিল পাওয়া যাবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তা বৈধ। আর হারাম হওয়ার দলিল পাওয়া গেলে তা অবৈধ। কেননা, বস্তুর মূল হচ্ছে, বৈধতা। আল্লাহ বলেন, ‘আপনি বলুন, আল্লাহর সাজসজ্জাকে, যা তিনি বান্দাদের জন্যে সৃষ্টি করেছেন এবং পবিত্র খাদ্যবস্তুসমূহকে কে হারাম করেছে?’ (সুরা আ’রাফ: ৩২)
২- একজন নারী সাজসজ্জা করতে গিয়ে পুরুষের বেশ ধারণ করতে পারবেন না। যেমন- চুল এত ছোট করে ছাঁটা যার কারণে দূর থেকে দেখে পুরুষ মনে হয়। কেননা, ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) নারীর বেশ ধারণকারী পুরুষদেরকে এবং পুরুষের বেশ ধারণকারী মহিলাদেরকে অভিশাপ করেছেন।’ (বুখারি: ৫৮৮৫)
৩- সাজসজ্জার ক্ষেত্রে অমুসলিম কিংবা প্রকাশ্য পাপাচারে লিপ্ত নারীদের অনুকরণ করা যাবে না। এ মর্মে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদের দলভুক্ত গণ্য হবে।’ (আবু দাউদ: ৪০৩১)
৪- সাজসজ্জার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর বস্তু বা প্রসাধনী ব্যবহার করা যাবে না। কেননা, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ক্ষতি ও ক্ষতি সাধনের কোনো অনুমতি নেই।’ (দারাকুতনি: ৩০৭৯)
চেহারার সাজসজ্জা
১- ভ্রু প্লাক করা। এটা হারাম। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত, ‘আল্লাহতায়ালা অভিশম্পাত করেছেন, সেসব নারীদের ওপর যারা দেহাঙ্গে উল্কি উৎকীর্ণ করে এবং যারা করায়, তেমনি যারা ভ্রু উঠিয়ে সরু (প্লাক) করে, যারা সৌন্দর্য বাড়াতে দাঁতের মাঝে ফাঁক সৃষ্টি করে, যারা মহান আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে পরিবর্তন আনে।’ (বুখারি: ৪৮৮৬)
২- চেহারায় উল্কি অংকন করা। উক্ত হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে, শুধু চেহারা নয়; বরং দেহের যেকোনো অঙ্গে উল্কি অংকন করা হারাম।
৩- ফেক আইল্যাস বা কৃত্রিম পাপড়ি লাগানো। এটাও নাজায়েজ। ড. খালিদ আল মুসলিহ বলেন, আমি আশঙ্কা করছি, এটি নিষিদ্ধ পরচুলার অন্তর্ভুক্ত, যার কর্তাকে আল্লাহতায়ালা লানত করেছেন। যেমনটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের অনেকেই বলেছেন যে, ‘আল্লাহতায়ালা পরচুলা ব্যবহারকারিনী ও যে ব্যবহার করায় উভয়কে লানত করেছেন।’ আর এটা তো স্পষ্ট যে, কাজটি মিথ্যার অন্তর্ভুক্ত। এটা প্রতারণা। এজন্য মুসলিম বোনদেরকে আমি উপদেশ দিচ্ছি, তারা যেন এধরনের মেকআপ থেকে বেঁচে থাকেন এবং বৈধ মেকআপ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন। (http://www.almosleh.com)
৪- চোখে রঙিন পর্দা বা কন্ট্যাক্ট লেন্স। চশমার বিকল্প হিসেবে আজকাল অনেকেই ব্যবহার করছেন। এটা আজকাল ফ্যাশনের নতুন অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। এ সম্পর্কে শায়েখ সালিহ আল-ফাওযান বলেন, ‘যদি কন্ট্যাক্ট লেন্স চশমার মতো দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে হয় কিংবা চোখের কোনো ত্রুটি দূর করার উদ্দেশ্য হয় তাহলে অসুবিধা নেই। আর যদি চোখ সুস্থ থাকে, চোখে কোনো ত্রুটি না থাকে, তাহলে এটির ব্যবহার আমরা জায়েজ মনে করি না। কেননা, এটি তখন ফ্যাশন হবে। অনেক মহিলা কন্ট্যাক্ট লেন্স পরে, যাতে অমুসলিম নারীদের মতো তাদের চোখ নীলাভ বা বিভিন্ন রঙ্গের দেখায়। অনেকে নিজের পোশাকের সঙ্গে কালার মিলিয়ে এটি ব্যবহার করে। এটা নিছক ফ্যাশন, যা জায়েজ নেই।’ (www.alfawzan.af.org.sa)
৫- দাঁত স্কেলিং করা বা আঁকাবাঁকা দাঁত সোজা করার উদ্দেশ্যে ব্রেস পরানো। এটি যদি কেবল ফ্যাশনের উদ্দেশ্যে হয় অথবা এটা করতে গেলে যদি শরীরের কোনো ক্ষতি হয় তাহলে জায়েজ হবে না। পক্ষান্তরে যদি চিকিৎসার উদ্দেশ্যে হয় তাহলে অসুবিধা নেই। হাফেজ ইবন হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন, হাদিসে যারা সৌন্দর্যের মানসে দাঁতের মাঝে ফাঁক সৃষ্টি করে তাদের জন্য নিন্দা (লানত) এসেছে- এর দ্বারা বোঝা যায়, যদি তা চিকিৎসা বা এ জাতীয় প্রয়োজনে হয় তাহলে জায়েজ আছে। (ফাতহুল বারী ১০/৩৭২)
৬- মেকআপ করা। যেমন, বর্তমানে স্নো, ক্রিম, পাউডারসহ বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী সামগ্রী পাওয়া যায়। এগুলোর ব্যবহার বৈধ। কেননা, ইসলাম নারীর জন্য মেহেদি, কলপ ইত্যাদির ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে থাকে। আর আধুনিককালের এসব প্রসাধনীও এ শ্রেণীরই অন্তর্ভুক্ত। যেমন, বিন বায (রহ.) বলেন, ‘মেকআপ সাজসজ্জার অন্তর্ভুক্ত। যদি চেহারা বা ত্বকের ক্ষতি না করে তাহলে অসুবিধা নেই। কিন্তু যদি এর কারণে ক্ষতি হয় তাহলে করা যাবে না।’ (www.binbaz.org.sa)
তবে এসব বস্তু ব্যবহারের সময় নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে :
১- বিজাতি কিংবা প্রকাশ্য পাপাচারে লিপ্ত নারীদের অনুকরণ করার উদ্দেশে হলে এসবের ব্যবহার জায়েজ হবে না।
২- মেকআপে ক্ষতিকর বস্তু বা প্রসাধনী ব্যবহার করা যাবে না। কেননা, আমাদের দেহের মালিক আমরা নই।
৩- অতিরিক্ত রূপচর্চা করা যাবে না। কেননা, অতিরিক্ত রূপচর্চা হয়তো ত্বকের ক্ষতি করে কিংবা অপচয়ের সীমায় পড়ে।
৪- যে সমস্ত প্রসাধনী হালাল বস্তু দ্বারা তৈরি, সেগুলোর ব্যবহার জায়েজ। যেমন- সাধারণ মেকআপ, লিপস্টিক ইত্যাদি। তবে এগুলোর উপাদানে যদি হারাম কিছু থাকে, এমনটি নিশ্চিতভাবে জানা থাকলে সেগুলো ব্যবহার করা জায়েজ হবে না।
৫- যেসব সাজসামগ্রীতে অ্যালকোহল ব্যবহার করা হয়, সেগুলো যদি আঙ্গুর বা কিসমিসের তৈরি না হয় এবং নেশার পরিমাণে না পৌঁছায়, তাহলে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতানুযায়ী তা ব্যবহার জায়েজ। আর যদি আঙুর বা কিসমিসের তৈরি হয়- তাহলে সামান্য পরিমাণ ব্যবহারও জায়েজ নয়।
সাজসজ্জার আরো কিছু সামগ্রী
১- নেইলপলিশ। যদি পবিত্র বস্তু দ্বারা প্রস্তুত হয়, তাহলে ব্যবহার করা জায়েজ। তবে নেইলপলিশ যেহেতু পানি প্রবেশের প্রতিবন্ধক, তাই তা নখে থাকাবস্থায় অজু ও ফরজ গোসল হবে না। নখ থেকে তুলে অজু ও ফরজ গোসল করতে হবে। তবে পিরিয়ড অবস্থায় নেইলপলিশ ব্যবহার করলে করতে পারেন। বারংবার অজুর সুবিধার্থে পিরিয়ডমুক্ত পবিত্রাবস্থায় নেইলপলিশ ব্যবহার না করাই অধিকতর নিরাপদ।
২- পারফিউম বা বডি স্প্রে। এর ব্যবহার জায়েজ। তবে শর্ত হল, আঙ্গুর, খেজুর অথবা কিসমিসের তৈরি না হওয়া। কেননা, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘নেশা সৃষ্টিকারী প্রতিটি বস্তুই হারাম।’ (বুখারি: ৪৩৪৩)
৩- পরচুলার ব্যবহার। এটি সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। (বুখারি: ৪৮৮৬)
৪- চুল কালার করা। মহিলাদের জন্যও চুলে কালো কলপ ব্যবহার করা জায়েজ নয়।
এছাড়া স্বামীর দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে (পরপুরুষকে দেখানো উদ্দেশ্য না হলে) মহিলারা চুল বাদামি, সোনালি, লালচে প্রভৃতি কলপ দিয়ে রাঙাতে পারেন। (রদ্দুল মুহতার: ৬/৭৫৬ আলমুগনি : ১/১২৭) তবে তাতে যেন কোনো সেলিব্রেটি বা কাফের নারীর অনুকরণ বা বেশধারণ উদ্দেশ্য না হয়। কেননা তা হাদিসে নিষিদ্ধকৃত বিজাতীয় অনুসরণের মধ্যে পড়বে।
নারীর চুল কাটার বিধান
মহিলাদের চুলের ক্ষেত্রে শরিয়তের মৌলিক নীতিমালা হলো:
১. মহিলারা চুল লম্বা রাখবেন। হাদিস শরিফ থেকে জানা যায়, উম্মাহাতুল মুমিনীন (রা.) চুল লম্বা রাখতেন।
২. এ পরিমাণ ছোট করবেন না যা পুরুষের চুলের মতো হয়ে যায়। হাদিসে পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বনকারিনী মহিলার প্রতি অভিসম্পাত করা হয়েছে।
৩. চুল কাটার ক্ষেত্রে বিজাতির অনুকরণ করবে না। কারণ হাদিসে বিজাতীয়দের অনুকরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। অতএব যে মহিলার চুল এত লম্বা যে, কিছু অংশ কাটলে পুরুষের চুলের সঙ্গে সাদৃশ্য হবে না তার জন্য ওই পরিমাণ কাটা জায়েজ হবে। পক্ষান্তরে যার চুল তত লম্বা নয়; বরং অল্প কাটলেই কাঁধ সমান হয়ে যাবে এবং পুরুষের বাবরী চুলের মতো দেখা যাবে তার জন্য অল্প করেও কাটার অনুমতি নেই।
তবে জটিল অসুস্থতার কারণে চিকিৎসার প্রয়োজনে অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শে চুল ছোট করা, এমনকি প্রয়োজনে কামানোরও অনুমতি রয়েছে। তবে সর্বাবস্থায় ফ্যাশনের অনুকরণ করা থেকে বিরত থাকা জরুরি। উপরোক্ত মূলনীতির আলোকে মহিলারা তাদের চুল খাটো করতে পারবেন। (বুখারি : ২/৮৭৪; তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম : ১/৪৭২)
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ