বাংলাদেশে বাসাবাড়িতে এলপিজি সিলিন্ডারের ব্যবহার অনেক বেড়েছে, তার সাথে বেড়েছে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও সিলিন্ডার থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। ফলে বাড়ছে হতাহতের সংখ্যাও। সম্প্রতি গাজীপুরের কালিয়াকৈরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ জনে। এর আগে ১৩ মার্চ সন্ধ্যায় কালিয়াকৈরে গ্যাসসিলিন্ডার লিকেজের আগুন থেকে দগ্ধ হয়ে নারী-শিশুসহ ৩৪ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। এছাড়াও কয়েকদিন আগে রাজধানীর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে একটি বাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে একই পরিবারের চারজনসহ মোট ছয়জন দগ্ধ ও আহত হয়েছেন। এভাবে প্রতিনিয়ত সিলিন্ডারের লিকেজ থেকে কিংবা অসাবধানতার কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা। বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট ৩০টি কোম্পানির অন্তত দুই কোটি সিলিন্ডার বাজারে রয়েছে। রান্না কাজে জনপ্রিয় এই গ্যাস এখন আতঙ্কের নাম।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, গত বছর চুলার গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ২১০টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ২০২২ সালে তা ছিল ৯৪টি। এসব ঘটনায় হতাহতের পাশাপাশি মূল্যবান মালামালেরও ক্ষতি হয়। এর আগের বছরগুলোতেও এ পরিসংখ্যান ছিল উদ্বেগজনক।
গৃহস্থালির বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটছে গ্যাস লিকেজ থেকে। মূলত সিলিন্ডার থেকে কানেক্টিং পাইপ, চুলার রাবার কিংবা রেগুলেটরের ত্রুটি থেকে গ্যাস লিকেজ হচ্ছে, যা হয়তো বদ্ধঘরে জমা হচ্ছে। এক পর্যায়ে বৈদ্যুতিক স্পার্ক বা কোনোভাবে আগুন লেগে বিস্ফোরণ ঘটছে। গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার এবং এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেওয়ার সময় সতর্ক থাকুন। সাধারণত এলপিজি গ্যাস ২ শতাংশ ও লাইনের প্রাকৃতিক গ্যাস ৫ শতাংশ বাতাসের সংস্পর্শে এলেই তা বিস্ফোরণ সম্ভাবনা তৈরি করে। লাইন গ্যাসের চেয়ে ১০-১২ গুণ চাপ কম থাকে সিলিন্ডার গ্যাসে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কারিগরি ত্রুটি, অসচেতনতা ও অসতর্কতার ফলে সিলিন্ডার দুর্ঘটনা ঘটছে। তাই গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে প্রয়োজন সচেতনতা। সেক্ষেত্রে যা যা করা যেতে পারে, তা নিচে তুলে ধরা হল-
১. গ্যাসের ব্যবহার বা চুলা জ্বালানো শুরুর আগে সব জানালা-দরজা খুলে দিতে হবে। এতে জমাট বাতাস সরে যাবে। ভেন্টিলেশন ফ্যান থাকলে চালু করে দিন। কিচেন হুড থাকলে চালিয়ে দিন।
২. রোজ কাজ শেষে শুকনা কাপড় দিয়ে চুলা মুছে রাখা জরুরি। প্রয়োজন হলে কাপড়টিকে ভিনেগার দিয়ে ভিজিয়ে নেওয়া যেতে পারে। তবে পানি দিয়ে ভেজানো যাবে না।
৩. এলপিজি সিলিন্ডার কোনো পাটাতনের ওপর না রেখে সমতল জায়গায় খাড়াভাবে দাঁড় করিয়ে রাখতে হবে। আশপাশে কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা না লাগে সেটিও খেয়াল রাখা দরকার। চুলা, সিলিন্ডার থেকে কমপক্ষে ছয় ইঞ্চি ওপরে রাখতে হবে এবং লম্বা পাইপের সাহায্যে চুলা থেকে অন্তত তিন ফুট দূরে স্থাপন করতে হবে সিলিন্ডারটি।
৪. ভালো মানের চুলা ব্যবহার করুন। কিছু অর্থ সাশ্রয় করতে গিয়ে নিম্নমানের চুলার কারণে জীবন সংশয়ও হতে পারে। মাসে একবার বার্নারের ছিদ্র এবং ক্রেট পরিষ্কার করুন।
৫. রেগুলেটরের নজেলটি যাতে পাইপ দিয়ে ভালো করে কভার করা থাকে সেটা লক্ষ্য রাখুন। গরম বার্নারের সঙ্গে যাতে গ্যাসের পাইপ কোনওভাবে লেগে না থাকে এদিকেও নজর রাখতে হবে।
৬. ঘরে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া গেলে দরজা-জানালা খুলে দেওয়া। এই সময় ম্যাচের কাঠি না জ্বালানো, বৈদ্যুতিক সুইচ, মোবাইল ফোন অন/অফ না করা। এটি ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে যেখানে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে।
৭. সিলিন্ডারে সংযুক্ত পাইপটি নিয়মিত ভেজা কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করুন। কিন্তু ভুলেও সাবান পানি ব্যবহার করবেন না। ২ বছর পরপর অবশ্যই পাইপটি বদলে ফেলুন।
৮. একটি ঘরে দুটি সিলিন্ডার রাখার জন্য অন্তত ১০ বর্গফুট জায়গা থাকা জরুরি। এমন জায়গায় সিলিন্ডার রাখবেন না, যেখানে সহজেই তা অতিরিক্ত গরম হয়ে যেতে পারে। সিলিন্ডারের ওপরে কখনোই কোনও কাপড়, বাসন ইত্যাদি রাখবেন না।
৯. খালি সিলিন্ডার থেকে গ্যাসের রেগুলেটর খোলার সময় আশপাশে কোনও মোমবাতি জাতীয় জিনিস যাতে না জ্বলে, তাও খেয়াল রাখুন।
১০. এলপিজি সিলিন্ডার যদি অব্যবহৃত থাকে অথবা গ্যাসহীন অবস্থায় থাকে, তাহলে রেগুলেটরের নব বন্ধ করে রাখা উচিত। প্রয়োজনবোধে সিলিন্ডার ভর্তি থাকার সময় সেফটি ক্যাপ ব্যবহার করা নিরাপদ। এছাড়া রান্না শেষে চুলা ও রেগুলেটর উভয়ের সুইচ বন্ধ করে রাখুন।
এছাড়াও বাংলাদেশের এলপিজি বিধিমালা, সিলিন্ডার বিধিমালা এবং বিস্ফোরণ অধিদফতরের পক্ষ থেকে আরও কিছু সতর্কতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো হল:
১. আগুন, বিদ্যুৎ এবং তাপের যেকোনো রকম উৎস সেইসঙ্গে দাহ্য, প্রজ্বলিত বা বিস্ফোরক পদার্থ এবং ভিন্ন কোন গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে এই এলপিজি সিলিন্ডার দূরে রাখতে হবে।
২. যেখানে সিলিন্ডার রাখা হচ্ছে তার আশেপাশে আগুন জ্বালানো, ধূমপান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সিলিন্ডারের ওপরে ভারী বোঝা রাখা যাবে না।
৩. রান্না শুরু করার আধাঘণ্টা আগে রান্নাঘরের দরজা-জানালা খুলে দিন। রান্না শেষে চুলার নব ও এলপিজি সিলিন্ডারের রেগুলেটর সুইচ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। অনেকদিনের বদ্ধ ঘরে প্রবেশের পর সবার আগে দরজা জানালা খুলে দিতে হবে। যদি ঘরের ভেতরে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যায় তাহলে জানালা দরজা খুলে দিয়ে সাথে সাথে ডিলারদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
৪. এই সময়ের মধ্যে ম্যাচের কাঠি জ্বালানো, ইলেকট্রিক সুইচ, সিলিন্ডারের রেগুলেটর কিংবা মোবাইল ফোন অন বা অফ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। অনেকে সিলিন্ডারে লিকেজ খোঁজার সময় মোমবাতি কিংবা ম্যাচের কাঠি ব্যবহার করেন। সেটা কোন অবস্থাতেই করা যাবে না।
৫. অতিরিক্ত গ্যাস বের করার জন্য এলপিজি সিলিন্ডারে চাপ দেয়া, ঝাঁকানো কিংবা সিলিন্ডার গরম করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এতে তরল এলপিজি দ্রুত গ্যাসে রূপান্তরিত হয়ে অস্বাভাবিক চাপ বেড়ে বিস্ফোরিত হতে পারে।
৬. এলপিজি পূর্ণ সিলিন্ডার কোন দুই চাকার যান যেমন সাইকেল, মোটর সাইকেলে কিংবা ভারসাম্য কম, এমন বাহনে পরিবহন করা যাবে না।
৭. এছাড়া বছরে অন্তত একবার গ্যাস সিলিন্ডারটি এবং এর সাথে ব্যবহার হওয়া নানা রকম সামগ্রীর নিয়মিত ডিস্ট্রিবিউটর বা সরবরাহকারী দিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে।
৮. সিলিন্ডারের ভালভ, গ্যাসের পাইপ বা ফিটিংস দুর্বল হলে কিংবা সিলিন্ডারে ছিদ্র থাকলে সেটা সাথে সাথে বদলে ফেলতে হবে। একে মেরামত, ঝালাই করে ব্যবহার করা যাবে না। তেল বা পিচ্ছিল পদার্থ ব্যবহার করে নাড়াচাড়া করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
৯. এরপরও যেকোনো ধরণের জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাসা, বিশেষ করে রান্নাঘরের মধ্যে নিরাপত্তামূলক বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি, যেমন- গ্যাস ডিটেক্টর এবং ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার কিংবা হাতের কাছে কম্বলের মতো মোটা কাপড় রাখা যেতে পারে।
নয়াশতাব্দী/ডিএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ