বেঁচে থাকার জন্য খাওয়া এবং নিশ্বাসের মতো ঘুমও জরুরি। তাই ঘুমের ব্যাঘাত যেন না ঘটে, সে জন্য অনেক দম্পতি ‘স্লিপ ডিভোর্স’ নামক এক অনন্য পন্থা অবলম্বন করছেন। স্লিপ ডিভোর্স হলো এমন একটা বিষয়, যেটি প্রাথমিকভাবে সাময়িক সময়ের জন্য করা হলেও বিষয়টি আর সাময়িক থাকে না।
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাকলিন হাসপাতালের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ স্টেফানি কলিয়ার জানান, স্লিপ ডিভোর্স হলো এমন একটা বিষয়, যেটি প্রাথমিকভাবে সাময়িক সময়ের জন্য করা হয়। কিন্তু যখন দম্পতিরা বুঝতে পারেন একা ঘুমালে তাদের ভালো ঘুম হয় তখন বিষয়টি আর সাময়িক থাকে না। স্লিপ ডিভোর্সের সাথে স্বাস্থ্যগত কারণ জড়িত বলেও মনে করেন।
তিনি বলেন, যারা নাক ডাকেন, ঘুমের মাঝে পা নাড়ান এবং ঘুমের ঘোরে হাঁটার অভ্যাস রয়েছে, অথবা শারীরিক সমস্যার কারণে তারা ঘনঘন বাথরুমে যাওয়ার পাশাপাশি অনেক বেশি নড়াচড়া করে, গড়াগড়ি খায় এবং এটি তাদের সঙ্গীকে বিরক্ত করে। এটি এখন এমন একটি ট্রেন্ড যেটি নিশ্চিতভাবেই অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
স্লিপ ডিভোর্সের প্রবণতা তরুণ প্রজন্মের মাঝে বেশি কেনো এর কারণ এখনও জানা যায়নি। তবে ধারণা করা যেতে পারে যে আলাদা ঘুমানোর বিষয়টিকে তারা ততটা অসম্মানজনক মনে করে না। এটি একটি সাংস্কৃতিক পরিবর্তন। তারা মনে করে যদি আমি ভালো ঘুমাই, ভালো বোধ করি, তবে কেন নয়?
ঐতিহাসিকদের মতে, অতীতে দম্পতিদের কাছে আলাদা রুমে ঘুমানোটা খুব সাধারণ একটি বিষয় ছিল। কিন্তু ইতিহাসের পরিবর্তনের সাথে সাথে সেই ধারণাতেও পরিবর্তন এসেছে। কোন কোন ঐতিহাসিক বলেন, ডাবল বিছানা (বৈবাহিক বিছানা) হলো একটি আধুনিক ধারণা এবং শিল্প যুগের বিকাশের সময় এই ধারণা বিস্তার লাভ করেছিলো। তখন মানুষকে জনবহুল এলাকায় বসবাস করতো।
চিলির ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল স্কুলের সোমনোলজিস্ট (ঘুম বিশেষজ্ঞ) পাবলো ব্রকম্যান বলেন, আর্থ-সামাজিক অবস্থা যাদের বেশি ভালো ছিল, তাদের মাঝে এটি তত বেশি সাধারণ বিষয় ছিল। রাজপরিবারের সদস্যরা কীভাবে ঘুমাতো, সেটি লক্ষ্য করলেই এটা বোঝা যাবে।
একটা বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা একমত যে যেসব দম্পতি আলাদা রুমে ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নেন, তাদের জন্য কিছু সুবিধা আছে। ড. কলিয়ার বলেন, সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো যে এতে করে তারা একটা নিয়মিত এবং গভীর ঘুমের অভ্যাস গড়তে পারে। ভালো ঘুম সামগ্রিক সুস্থতার জন্য অপরিহার্য।
পালমোনোলজিস্ট এবং এএএসএম-এর মুখপাত্র সীমা খোসলা এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, রাতে ভালো ঘুম হওয়া শরীরের সুস্থতা ও খুশি থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই, কিছু দম্পতি নিজেদের সামগ্রিক সুস্থতার জন্য আলাদা ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
স্লিপ ডিভোর্সের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো আলাদা ঘুমাতে হলে একটি অতিরিক্ত বিছানা এবং রুম দরকার। কিন্তু অনেক দম্পতির জন্য এটার বন্দোবস্ত করা সম্ভব না। এমনকি, এমন সিদ্ধান্তের কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনেক দম্পতিই তাদের মধ্যকার ইন্টিমেসি, অর্থাৎ পারস্পরিক সংস্পর্শ হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা করেন।
ডা. কলিয়ার ব্যাখ্যা করেন যে যারা পূর্ণ সময় ধরে কাজ করে, তারা শুধুমাত্র ঘুমানোর সময়ই তাদের সঙ্গীদের সংস্পর্শে আসেন। সুতরাং, এর অন্যতম সমাধান হলো নিজেদের সংস্পর্শে আসার সময়টাকে আলোচনা করে নেয়া।
ঘুম বিশেষজ্ঞ ড. ব্রকম্যান যদিও বলেন, ‘স্লিপ ডিভোর্স’ সব দম্পতির জন্য কার্যকর না। একসাথে ঘুমানোর বেশ কিছু জৈবিক উপকারিতা রয়েছে। অনেকের কাছে এই বন্ধন স্বপ্নে তৈরি হয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন মা এবং তার সন্তানের মাঝে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় এই বন্ধন তৈরি হয়। মা এবং শিশুর ঘুমের সময়ও একই থাকে, তখন তারা দু’জনেই বিশ্রাম নেয়।
কোনও দম্পতি স্লিপ ডিভোর্স থেকে বিরত থাকতে চাইলে তাদেরকে কিছু বিষয় অনুসরণ করার সুপারিশ করেন বিশেষজ্ঞরা। ড. কলিয়ার বলেন, যদি একজন চায় এবং অপরজন না চায়, তখন এটি বিরক্তির কারণ হতে পারে।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল বেড ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালেও যেসব ব্রিটিশ দম্পতি একসাথে ঘুমাতো, তাদের প্রতি ছয়জনের মধ্যে একজন, অর্থাৎ ১৫ শতাংশ দম্পতি এখন আলাদা ঘুমায়। শুধু তাই নয়, তাদের প্রতি ১০ জনের নয় জন, অর্থাৎ ৮৯ শতাংশ মানুষ পৃথক রুমে ঘুমায়।
২০০৯ সালে দ্য স্লিপ কাউন্সিলের একটি জরিপে দেখা গেছে- ১০ জনের মধ্যে একজনেরও (সাত শতাংশ) কম দম্পতির আলাদা বিছানা রয়েছে। ন্যাশনাল বেড ফেডারেশন বলছে, গত এক দশকে আলাদা ঘুমানোর হার বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সূত্র: বিবিসি বাংলা
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ