ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ভারতের ঐতিহাসিক পাঁচ মুসলিম স্থাপত্য

প্রকাশনার সময়: ০৭ অক্টোবর ২০২২, ১৮:৩০ | আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২২, ২১:৪৫

উপমহাদেশের প্রাচীনতম এক নগরী দিল্লি। দিল্লির ঐতিহ্য ও ইতিহাস পৃথিবীর পাতায় শ্রেষ্ঠত্বের অনন্য চিহ্ন। এই নগরীর বয়স বাড়ে কিন্তু স্থবির হয় না। মানুষের কোলাহল, প্রাণচাঞ্চল্য ও কর্মকাণ্ডে দিল্লি সবসময় সরগরম। নানা দেশের মানুষ এখানে বসবাস করে। বিচিত্র তাদের পোশাক আর বৈচিত্র তাদের ভাষা।

বিশাল একটা সময়জুড়ে এই ভারতবর্ষ শাসন করেছে মুসলিম রাজা-বাদশাহরা। তারা আজ পৃথিবীর বুকে বেঁচে নেই। কিন্তু তাদের কৃতিত্বের ছাপ ভারতবর্ষ থেকে হারিয়ে যায়নি। আধুনিক ভারতে তাদের নিদর্শনসমূহ এখনো বিরাজমান। এখানে তাদের গড়ে তোলা কয়েকটি স্মৃতিচিহ্নর পরিচয় দেওয়া হলো-

তাজমহল

তাজমহল যুগে যুগে বিস্ময়ের সৌধ। পৃথিবীর সেরা সৃষ্টি। একে ঘিরে মানুষের কৌতূহলের অন্ত নেই। তাজের অভ্যন্তরে চির নিদ্রায় শায়িত আছেন সম্রাট শাহজাহান-পত্নী বেগম মমতাজ। তিনি বিশ্ববিখ্যাত সুন্দরী সম্রাজ্ঞী নুরজাহানের ভ্রাতস্পুত্রী। মোঘল সম্রাটের মন্ত্রী ইতিমাদুদ্দৌলার কন্যা।

১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে মহা ধুমধামের সঙ্গে সম্রাট জাহাঙ্গীরের পুত্র যুবরাজ খুররমের সঙ্গে আরজুমান্দ বানুর বিয়ে হয়। এই যুবরাজই পরবর্তীতে সম্রাট শাহজাহান নামে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন।

সম্রাট সিংহাসনে আরোহণের দুই বছর পরে ১৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহ দমনের জন্য আগ্রা থেকে রওয়ানা করেন। সঙ্গে ছিলেন তার প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজ বেগম। এখানেই মমতাজ বেগম মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে তিনি যে বাসনা স্বামীর কাছে করেছিলেন তারই নিদর্শন হচ্ছে আজকের এই তাজমহল। সমাধির জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয় আগ্রার যমুনা নদীর তীরে। সম্রাট তার স্ত্রীর শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য পৃথিবীর সব মূল্যবান পাথর এবং সম্পদ নিয়ে আসেন। ২২ হাজার শ্রমিক এই সমাধি নির্মাণে কাজ করেন। কোটি টাকা ব্যায় হয়েছে এই নির্মাণ কাজে। কাজ সম্পন্ন হতে সময় লেগেছিল দীর্ঘ ২০ বছর।

তাজমহল শ্বেত মর্মরে তৈরি। যমুনা নদীর কিনার থেকে পাথর বাঁধাই হয়ে উঠেছে উন্নত মঞ্চ। এর ওপর স্থাপিত হয়েছে তাজমহলের সৌধ। সৌধের গায়ে উৎকীর্ণ হয়েছে পবিত্র কোরআনের বাণী। এই লিপিমালা এমন বৈজ্ঞানিক উপায়ে খোদিত হয়েছে যে ৮০ ফুট উঁচু থেকেও এগুলো যেমন দেখায়, নিচু থেকেও ঠিক তেমন দেখায়। তাজমহলের ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে মূল কবরের গহ্বরে নামতে হয়। এখানেই মমতাজ বেগম এবং সম্রাট শাহজাহান অন্তিম শয্যায় শায়িত।

কুতুব মিনার

মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন কুতুব মিনার। সুলতান মুহাম্মদ ঘুরির সেনাপতি কুতুব উদ্দিন আইবেক ১১৯২ খ্রিষ্টাব্দে চৌহান রাজা পৃথ্বিরাজকে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পরাজিত করেন। এ বিজয়ের পরে তিনি দিল্লি অধিকার করে কুওয়াতুল ইসলাম নামে একটি মসজিদ এবং এর সংলগ্ন একটি মিনার নির্মাণ করেন। এই মিনারটি ভারতবর্ষের মুসলিম ঐতিহ্যের এক অনন্য নিদর্শন।

১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দে কাজ শুরু হয়ে তা ১৩৮৬ সালে ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে শেষ হয়। মিনারটির উচ্চতা ২৩৮ ফুট। পাদদেশের ব্যাস ১৪.৩২ মিটার (৪৭ ফুট) এবং শীর্ষ অংশের ব্যাস ২.৭৫ মিটার।

এটি দিল্লির অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। ২০০৬ সালে সর্বোচ্চ পরিদর্শিত সৌধ। পর্যটকদের সংখ্যার বিচারে এটি তাজমহলের চেয়েও জনপ্রিয়।

কুতুব মিনারের নামকরণের পেছনে দুটি অভিমত রয়েছে, প্রথমত এর নির্মাতা কুতুব উদ্দিন আইবেকের নামানুসারে। দ্বিতীয়ত ট্রান্স অক্সিয়ানা হতে আগত বিখ্যাত সুফি সাধক কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকির সম্মানার্থে এটি নির্মিত হয় বলে এই নামকরণ।

আগ্রা দুর্গ

এই সেই আগ্রা নগরী; যা ১৫৬৬ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম শাসক সম্রাট আকবর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মোঘল শাসনামলে আগ্রার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্পসৌকর্যে আগ্রা তৎকালীন সময়ের এক বিলাসবহুল নগরী ছিল। সে সময়ে আগ্রা এশিয়ার মধ্যে সর্ব শ্রেষ্ঠ বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল।

এই নগরীর অন্যতম একটি নিদর্শন হলো আগ্রা দুর্গ। যমুনা নদীর দক্ষিণ তীরে এটি অবস্থিত। আকৃতিতে অর্ধ চন্দ্রাকৃতি। দুর্গটি নির্মাণে হাজারো শ্রমিক রাতদিন কাজ করেছিল। মুহাম্মদ কাসিম খাঁ ছিল এর তত্ত্বাবধানে। এভাবে দীর্ঘ নয় বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর দুর্গটি তার আপন রূপে দাঁড়িয়েছিল। দুর্গটি নির্মাণে খরচ হয়েছিল তখনকার সময়ে ৩৫ লাখ টাকা। দুর্গের আয়তন দের মাইলের অধিক ও ৭০ ফুট উঁচু। বেলে পাথর নির্মিত দ্বিগুণ প্রাচীরে সুরক্ষিত।

দুর্গের প্রবেশ পথ চারটি। দুর্গের প্রাচীর যুদ্ধ অস্ত্র দ্বারা সজ্জিত ছিল। দুর্গের চারদিকে প্রায় ৩০ ফুট চওড়া ৫ ফুটের মতো গভীর পরিখা খনন করা ছিল। সম্রাট আওরঙ্গজেব এই পরিখা খনন করা হয়।

লাল কেল্লা

১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয় লালকেল্লা। এটিও মোঘল সম্রাট শাহজাহান কর্তৃক নির্মিত একটি দুর্গ। ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত এ দুর্গটি ছিল মোঘল সম্রাটদের রাজধানী। এরপর শেষ মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে নির্বাসিত করে ভারতের রাজধানী কলকাতায় স্থানান্তরিত করে ব্রিটিশ সরকার। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশরা এই দুর্গটিকে একটি সামরিক ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করত। বর্তমানে এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র এবং ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌমত্বের একটি শক্তিশালী প্রতীক। প্রতি বছর ভারতের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল কেল্লার লাহোরি গেটসংলগ্ন একটি স্থানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।

ফতেহপুর সিক্রি

আগ্রা থেকে ফতেহপুর সিক্রি ১৪ মাইল দূরে অবস্থিত। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবর ফতেহপুর সিক্রি প্রতিষ্ঠা করেন। বলা হয়, এখানে সম্রাট আকবর কয়েক বছর বসবাসও করেছিলেন। এই শহরকে তিনি প্রাচীরে বেষ্টিত করে এক দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করেন। এর তিন দিকে প্রাচীর। অন্য দিকে হ্রদ। দুর্গের প্রাচীর ২২ ফুটের মতো উঁচু। এর প্রধান গেইটকে বলা হতো ‘বুলন্দ দরওয়াজা’। যেমন উঁচু তেমন বিস্ময়কর এর কারুকার্য। রাজপথ থেকে বুলন্দ দরওয়াজার উচ্চতা ১৭৬ ফুট। এই দরজা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রবেশ পথগুলোর অন্যতম। কথিত আছে, সম্রাট আকবর ১৬০২ খিষ্ট্রাব্দে দাক্ষিণাত্য বিজয়ের পর স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ এটি নির্মাণ করেন।

নয়া শতাব্দী/ আরআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ