যুক্তরাষ্ট্রের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর নিয়ে আমেরিকা এবং চীনের মধ্যে উত্তেজনা এখন চরমে। ন্যান্সি পেলোসি যেন তাইওয়ান সফর না করেন সেজন্য সতর্ক করেছিল চীন।
চীনা সরকারি কর্মকর্তারা আমেরিকানদের সতর্ক করেছিল যে এই সফর চীনের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের সামিল এবং এতে প্রমাণ হবে যে আমেরিকা তাদের 'এক-চীন' নীতি বর্জন করছে।
এমনকি তারা সামরিকভাবে জবাব দেওয়ার হুমকিও দিয়েছিল। কিন্তু সব কিছু উপেক্ষা করে ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান সফর করেছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে চীনের এতো কাছে, তবু তাইওয়ান নিয়ে আমেরিকার এতো চিন্তা বা আগ্রহ কেন?
তাইওয়ান একটি দ্বীপ, দক্ষিণ পূর্ব চীনের উপকূল থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১০০ মাইল। তাইওয়ান ও চীনের মাঝে ১৬০ কিলোমিটার সমুদ্র আছে। যেটি তাইওয়ান প্রনালী হিসেবে পরিচিত। তাইওয়ানের জনসংখ্যা ২ কোটি ৩০ লাখ।
তাইওয়ান তথাকথিত "প্রথম সারির দ্বীপপুঞ্জের" মধ্যে একটি । এই সারিতে রয়েছে আমেরিকার বন্ধুপ্রতিম অঞ্চলগুলো। মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির জন্য এই দ্বীপগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৪৯ সাল থেকে তাইওয়ানের আলাদা সরকার আছে। শুরুতে সেখানে ছিল সামরিক একনায়কতন্ত্র। পরবর্তীতে তাইওয়ানে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
অন্যদিকে, চীন শাসন করে দেশটির কমিউনিস্ট পার্টি। সেখানে কোনো গণতন্ত্র নেই। চীনের রাষ্ট্র পরিচালনা করার রীতিনিতি একরকম। অন্যদিকে, তাইওয়ানের রীতিনিতি ভিন্নরকম।
১৯৪৫ সালে দ্বীতিয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি সেদেশের সরকার উৎখাত করতে সক্ষম হয়। ১৯৪৯ সালে সেই রিপাবলিক অফ চায়না সরকারের লোকজন তাইওয়ানে পালিয়ে যায় এবং তাইপে তে তাদের নতুন রাজধানী করে। অন্যদিকে, বেইজিংয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না।
১৯৭১ সালে তাইওয়ানের রিপাবলিক অফ চায়না জাতিসংঘের সদস্যপদ হারায় বেইজিংয়ের পিপলস রিপাবলিক অফ চায়নার কাছে।
চীন যত শক্তিশালী হয়েছে তারা ততবেশী তাইওয়ানকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন রাখতে চেয়েছে। কিন্তু আমেরিকা বরাবরই তাইওয়ানের পাশে ছিল। গত কয়েক দশকে সেটা আরও বেড়েছে।
আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইটে তাইওয়ানকে একটি গণতান্ত্রিক এবং টেকনোলজিক্যাল পাওয়ার হাউজ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
আমেরিকা বলছে, তাদের যে ইন্দোপেসেফিক কৌশল রয়েছে সেখানে তাইওয়ান একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। যদিও তাইওয়ানের সাথে আমেরিকার কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই তবে ব্যাপক আনঅফিসিয়াল সম্পর্ক রয়েছে এই দুটি দেশের মধ্যে।
তাইওয়ানের সাথে আমেরিকার অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিসহ বিভিন্নক্ষেত্রে নানা সম্পর্ক রয়েছে। তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেতে আমেরিকান ইনিস্টিটিউট অফ তাইওয়ান নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। এই প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ ব্যয় বহন করে আমেরিকা। একটি দূতাবাস যেমন কনসুলার সার্ভিস দেয় এই প্রতিষ্ঠান সেভাবে কাজ করে। এছাড়াও এই প্রতিষ্ঠানটি অনেকটা কূটনৈতিক দূতাবাসের মতোই কাজ করে।
অন্যদিকে, ওয়াশিংটনে তাইওয়ানের আছে তাইপে ইকোনমিক এবং কালচালার অফিস। তাইওয়ান হচ্ছে আমেরিকার অষ্ঠম বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার। আমেরিকা তাইওয়ানে যেসব পণ্য এবং সেবা রপ্তানি করে সেগুলোর পেছনে বছরে প্রায় দুই লাখ মানুষের কর্ম সংস্থান হয় আমেরিকার ভেতরে।
১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সময় তাইওয়ান রিলেশন অ্যাড করা হয়। এর মাধ্যমে তাইওয়ানকে সামরিক সহায়তা ছাড়াও অন্যান্য সহায়তা দেয় আমেরিকা। স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে, স্বাধীন তাইওয়ানের বিষয়টিকে আমেরিকা সমর্থন করেনা।
অন্যদিকে, তাইওয়ানকে যেভাবে চীন তাদের অংশ বলে দাবী করছে সেটিও মানে না আমেরিকা। তবে স্বাধীন রাষ্ট্র বলে স্বীকৃত না হলেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় তাইওয়ান যাতে সদস্যপদ পেতে পারে সেজন্য আমেরিকা সমর্থন দেয়। যেসব সংস্থায় সদস্যপদ পাওয়া সম্ভব নয় সেখানে যেন তাইওয়ান অর্থবহ ভাবে অংশ নিতে পারে সেজন্য আমেরিকা তাদের উদ্বুদ্ধ করে এবং সহায়তা করে।
কৌশলগত গুরুত্ব
অর্থনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে চীন যেভাবে দ্রুত উন্নতি করছে এর ফলে বিভিন্ন জায়গায় তাদের রাজনৈতিক প্রভাবও তৈরি হচ্ছে। যেটি আমেরিকার মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৯০ সালে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকার নেতৃত্বে এক কেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা এখন চলছে। সব জায়গাতেই আমেরিকার প্রভাব। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের সেই শূন্যস্থান পূরণের জন্য চীন এগিয়ে আসছে। আমেরিকা সেটা হতে দিতে চায়না। এজন্য অর্থনৈতিক, সামরিক এবং নানা কৌশলগতভাবে তারা চীনের উপর চাপ বজায় রাখতে চায়। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় চীনের উপর নানাভাবে বাণিজ্যিক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল।
আমেরিকার কাছে তাইওয়ানের একটি ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। চীনের যে সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং কৌশল সেটিকে দমিয়ে রাখার জন্য যেসব দ্বীপ এবং দেশকে আমেরিকা কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে তাইওয়ান তার মাঝখানে অবস্থিত।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, তাইওয়ানকে ব্যবহার করে আমেরিকা চীনকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। তাইওয়ান প্রণালী এবং তার আশপাশে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বজার রাখতে চায় তাইওয়ান। পূর্ব এশিয়াতে আমেরিকার প্রভাব বজায় রাখার জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীনের সামরিক প্রভাব খর্ব করার জন্য আমেরিকা তাদের প্রভাব রাখতে চায় ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া থেকে শুরু করে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া পর্যন্ত। তাইওয়ান এর মাঝখানে এবং চীনের খুব কাছাকাছি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমেরিকার সামরিক বিশেষজ্ঞরা বুঝতে পারছিলেন যে পশ্চিমাপন্থি কিংবা নিরপেক্ষ তাইওয়ান আমেরিকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীন যদি শক্তি প্রয়োগ করে তাইওয়ান দখল করে নেয় এবং আমেরিকা যদি সেটি আটকাতে ব্যর্থ হয় তাহলে এশিয়ায় আমেরিকার প্রভাব খর্ব হয়ে যাবে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, তাইওয়ানের গণতান্ত্রিক ধারা। যদিও তাইওয়ান একসময় গণতান্ত্রিক দেশ ছিল না। ১৯৮০ এর দশকে শেষের দিকে সংস্কারের মধ্যে দিয়ে তাইওয়ান গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসে এবং নব্বই দশকের মাঝামাঝি সেখানে প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশন সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হয়।
আমেরিকা মনে করে তাইওয়ানের গণতান্ত্রিক ধারা চীনের জন্য একটি অস্বস্তির কারণ হতে পারে এবং সেই জন্যেই তাইওয়ানের উপর আমেরিকার প্রভাব বজায় রাখতে চায় এবং তাইওয়ানকে তারা নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করে।
তথ্যসূত্র-বিবিসি
নয়া শতাব্দী/ এডি
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ