ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬
আক্রান্ত হবে ইউরোপ-আমেরিকা

মন্দার মুখোমুখি বিশ্ব

বিপদ কম এশিয়ার
প্রকাশনার সময়: ২৩ মে ২০২২, ০৮:৩০

করোনার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে টালমাটাল বিশ্ব। আমেরিকা-ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে চলছে অর্থনৈতিক মন্দা। জার্মানিতে বেকারত্ব বাড়ছে। ইংল্যান্ডে বিলাসদ্রব্য ব্যবহার কমে গেছে। ২৫ ভাগ মানুষ তিন বেলার বদলে দুই বেলা খাচ্ছে। ইউরোপের অন্যান্য দেশও প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারছে না। এমনকি সুইজারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, নরওয়ের মতো শান্তির দেশগুলোতেও দেখা দিচ্ছে অশান্তির ছোঁয়া।

এশিয়া, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও মন্দা থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের। শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি শোচনীয়। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়া দেশটি ৭৪ বছরের পথচলায় প্রথমবারের মতো ঋণখেলাপি হয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের সমস্যা মূল্যস্ফীতি। তিনটি দেশেই ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এরই মধ্যে রেকর্ড ছুঁয়েছে। ব্যাংক কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম নয়া শতাব্দীকে জানিয়েছেন, ডলারের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে গত প্রায় ৭ দিন ধরে আমদানিকারকদের ঋণপত্র খুলছে না ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে কিছু ডলার ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। বিলাসদ্রব্য আমদানিতে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার। এমন নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে ডলারের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি আপাতত রোধ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এটা স্থায়ী সমাধান নয়।

নয়া শতাব্দীকে এই ব্যাংক কর্মকর্তা আরো বলেন, অর্থনীতির বিষয়গুলো খুবই সংবেদনশীল। ডলারের দাম, ব্যাংক ঋণ বা ফিক্সড ডিপোজিটের সুদ খুব বেশি কমানো বা বাড়ানোর সুযোগ নেই। ভারসাম্য রক্ষা করা খুবই জরুরি। এই বিষয়গুলোকে শাখের করাতের মতো বিবেচনা করা যায়। আসতেও কাটে, যেতেও কাটে। এজন্য আর্থিক ব্যবস্থাপনা উঁচুদরের পেশাদারিত্ব দাবি করে। এর আগে ২০০৮ সালেও বিশ্বে মন্দা দেখা দিয়েছিল। সেসময় আমেরিকা-কানাডা-ইউরোপের ব্যাংকার এবং অর্থনীতিবিদরা সম্মিলিতভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছিলেন।

বিশিষ্ট শিল্পপতি, তরুণ শিল্পোদ্যক্তা ওবায়দুর রহমান নয়া শতাব্দীকে বলেন, গত এক মাস ধরে আমাদের বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে। কন্সট্রাকশন একেবারে বন্ধ। কাঁচামাল যা ছিল তা দিয়ে যতটুকু কাজ করা সম্ভব হয়েছিল তা শেষ করে কাজ আপাতত বন্ধ করে দিয়েছি। বিশ্বমন্দা আসন্ন। দেখা যাক, পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা যায় কী না।

বিশ্বজুড়েই মন্দা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে। করোনা মহামারি কাটিয়ে যখন অর্থনীতি গতিশীল হয় তখনই রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। ফলে বিশ্ব অর্থনীতির আকাশে মেঘ নেমে আসার শঙ্কা দেখছেন কেউ কেউ। যদিও অল্প কিছুসংখ্যক অর্থনীতিবিদ মনে করছেন চলতি বছরে মন্দা তুলনামূলকভাবে অসম্ভব। তবে, তারাও আগামী বছর বা তার পরের বছরের মধ্যে মন্দা অবশ্যম্ভাবী বলে মন্তব্য করেছেন।

অর্থনীতি বিশ্লেষক, কলাম লেখক মোতাহার হোসেন চৌধুরী নয়া শতাব্দীকে বলেন, যদিও বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান বা ভারতের অবস্থা এই মুহূর্তে ভালো নয়, তারপরও বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় এই অঞ্চলে মন্দা এখনই আঘাত হানবে বলে মনে হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ দুইটি। প্রথমত, এই অঞ্চলের বিপুল জনসংখ্যা এবং দ্বিতীয়ত, এখানকার ভূমির উর্বরতা। এশিয়া চাইলে নিজেদের বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার মাধ্যমে বিশ্বমন্দার হাত থেকে বাঁচতে পারবে। তবে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা যে জরুরি তা বলাই বাহুল্য। আমাদের দেশে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়ছে ব্যবস্থাপনা ঠিক না থাকায়। সরকার, নীতিনির্ধারকরা পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে সময়মতো পদক্ষেপ নিলে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব। ৮০ শতাংশ কৃষিনির্ভর একটি দেশ মন্দার কবলে পড়া কিছুটা কঠিন।

এদিকে, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ এবং পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা জানাচ্ছেন, রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ, মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞা, চীনের করোনা নীতি, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি ও যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার বৃদ্ধি ২০২২ সালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর চাপ বাড়াবে। তাদের কাছে প্রশ্ন হলো এরকম খারাপ পরিস্থিতি ও বিভিন্ন ভুল নীতি ধীর অর্থনীতিকে সংকোচনের দিকে নিয়ে যেতে পারে কিনা। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক তারা সিনক্লেয়ার বলেন, মন্দার বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা অবিশ্বাস্যভাবে কঠিন। এমনকি ভালো পূর্বাভাসকারীদের জন্যও। এর আগের বার মন্দা শুরু হওয়ার পরেই আমরা বুঝতে পারি। যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হয়েছে। দেশটিতে লাফিয়ে বাড়ছে ভোগ্য পণ্যের দাম। ফলে বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশটিতে সংকট তৈরি হওয়ায় শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ এর প্রভাব বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কমে যেতে পারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। করোনা মহামারিতে বিশ্ব অর্থনীতি সংকোচিত হয় চার দশমিক তিন শতাংশ।

গত এপ্রিলে নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ডুডলি এক মতামতে সতর্ক করে বলেন, একটি মন্দা এখন কার্যত অনিবার্য। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে আরেকটি সতর্কতা সংকেত হলো স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি মার্কিন ট্রেজারি বন্ডগুলোর ওপর নতুন নিয়ম আরোপ করা। যা বিনিয়োগকারীদের হতাশ করেছে। ক্যাম্পবেল আর হার্ভে নামের একজন অর্থনীতিবিদ বলেন, ফেডের নীতির কারণে মন্দার ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। যারা মনে করেন চলমান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ফেড ধীর গতিতে এগোচ্ছে তাদের সঙ্গেও একমত পোষণ করেন তিনি। এ বছরের এপ্রিলে সিএনবিসির পক্ষ থেকে পরিচালিত একটি জরিপে ৮১ শতাংশ মার্কিন প্রাপ্তবয়স্করা জানিয়েছেন, তারা বিশ্বাস করেন চলতি বছরে মন্দার সম্ভাবনা রয়েছে।

এদিকে, ইউক্রেনে হামলার পর রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে পশ্চিমা বিশ্ব। রাশিয়ার জ্বালানি আমদানি নিষিদ্ধ করেছে বাইডেন প্রশাসন। ইউরোপীয় ইউনিয়নও একই পথে হাঁটছে। রাশিয়ারও সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক দেশকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এতে বিশ্বজুড়ে জ্বালানিতে প্রভাব পড়েছে। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী সংকট দেখা দিয়েছে। দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ছুঁয়েছে। নাগরিকদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। ইউরোপ এবং আমেরিকার মতো শিল্পনির্ভর দেশগুলোর পক্ষে অর্থনিতক মন্দা থেকে রক্ষা পাওয়া বেশ কঠিন হবে বলে ধারণার কথা স্পষ্ট করেই বলছেন পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা। জনসংখ্যার ঘাটতি এবং কাঁচামালের অভাব শিল্প উৎপাদনের ধারাবাহিকতা ব্যাহত করবে— এমন ধারণা তাদের। বিশেষ করে ইউরোপের শিল্প বাজারের জন্য এশিয়ার দেশগুলোর ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। ক্রাইসিস দেখা দিলে এশিয়া যদি ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ নীতি অবলম্বন করে সেক্ষেত্রে সংকট কাটিয়ে ওঠা ইউরোপের জন্য অসম্ভব হয়ে উঠবে।

নয়া শতাব্দী/জেআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ