ঢাকা, সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

মারিউপোলের পরিস্থিতি বুচার চেয়েও খারাপ

প্রকাশনার সময়: ০৬ এপ্রিল ২০২২, ০৮:১৮

ইউক্রেনের মারিউপোল শহরের পরিস্থিতি বুচা এলাকার চেয়েও খারাপ বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা। গতকাল মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে তুরস্কভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আনাদোলু এজেন্সি। পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ-তে সোমবার ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাসের সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন দিমিত্রো কুলেবা। সেখানে তিনি বলেন, কিয়েভে ইউক্রেন জিতেছে, কিন্তু যুদ্ধ এখনো চলছে। দিমিত্রো কুলেবা বলেন, তার দেশ এখন পূর্ব ইউক্রেনে নতুন করে রাশিয়ার বড় ধরনের হামলার মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনি বলেন, রুশ বাহিনী ডোনেস্ক ও লুহানস্কের আরো এলাকা দখলের চেষ্টা চালাবে। অবরুদ্ধ মারিউপোল শহরেরও নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করবে তারা। ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বুচাতে আমরা যে ভয়াবহতা দেখেছি তা এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের ভূখণ্ডে রাশিয়ান বাহিনীর সংঘটিত অপরাধযজ্ঞের একটি দৃশ্যমান চিত্র মাত্র।

বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, কিয়েভকে অবরুদ্ধ করে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সরকারকে উৎখাতের যে স্বপ্ন রাশিয়া দেখছিল তার প্রথম কবর রচিত হয়েছে ইউক্রেনের শহর বুচার একটি সরু রাস্তায়। সেই সময়টি আসে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি। ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে কিয়েভের কাছে বুচা নামের ওই শহরে পৌঁছে গিয়েছিল রুশ বাহিনী। সেখানে রাশিয়ার একটি ট্যাংক ও সাঁজোয়া বহর ইউক্রেনীয় বাহিনীর অ্যামবুশে পড়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। ইউক্রেনীয় বাহিনীর এ রকম আরো অনেক প্রতিরোধ হামলায় রুশ বাহিনীর অগ্রযাত্রা থমকে যায়। পাঁচ সপ্তাহ তুমুল লড়াইয়ের পর ইউক্রেনীয়দের তীব্র প্রতিরোধের মুখে ওই এলাকা থেকে সরে যায় রুশ বাহিনী। তবে যাওয়ার সময় মোটেও দয়া-মায়া দেখায়নি। ইউক্রেনীয় বাহিনী যখন হানাদারমুক্ত শহরটিতে প্রবেশ করে তখন সেখানকার সড়কে অন্তত ২০ জনের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। অনেক মরদেহের হাত ছিল পেছন দিকে বাধা। শহরটির মেয়র জানান, তারা ২৮০ জনের লাশ জড়ো করে গণকবর দিয়েছেন। অঞ্চলটি থেকে মোট ৪১০ বেসামরিকের মরদেহ উদ্ধারের কথা জানিয়েছেন ইউক্রেনের প্রসিকিউটর জেনারেল ইরিনা ভেনেডিকতোভা। এরমধ্যেই মারিউ মারিউপোলের পরিস্থিতি বুচার চেয়েও খারাপ বলে মন্তব্য করলেন ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। রাশিয়ার হামলায় দেশটিতে এখন পর্যন্ত ১৮ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে ইউক্রেন। টেলিগ্রামে এক বিবৃতিতে দেশটির সংস্কৃতি ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ দাবি করা হয়েছে বলে মঙ্গলবার লাইভে জানিয়েছে আলজাজিরা। ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ বলছে, নিহত ব্যক্তির মধ্যে ১৫ পুরুষ ও তিন নারী সাংবাদিক। যুদ্ধের মধ্যে পড়ে এ পর্যন্ত দেশটিতে ১৩ সাংবাদিক আহত হয়েছেন। আটজনকে গ্রেফতার বা তুলে নেয়া হয়েছে। আর তিনজনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর ঘোষণা দেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এর পর থেকেই পশ্চিমাদের বাধা উপেক্ষা করে পূর্ব ইউরোপের দেশটিতে চলছে রুশ সেনাদের হামলা। ইউক্রেন যেন ন্যাটোতে যোগ না দেয় এ ব্যাপারে বরাবরই তাদের সতর্ক করে আসছে রাশিয়া। সর্বশেষ যুদ্ধের কারণ হিসেবে তারা বলছে, দেশটিতে ‘অসামরিকায়ন’ ও ‘নাৎসিমুক্তকরণ’ এবং দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের রুশ ভাষাভাষী বাসিন্দাদের রক্ষা করার জন্যই এমন সামরিক পদক্ষেপ। এরই মধ্যে কয়েক দফা বৈঠকে বসেছে ইউক্রেন-রাশিয়া। তবে যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে কার্যত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। প্রতিদিনই যুদ্ধে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। বাস্তুচ্যুত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নানা স্থাপনা।

রিয়া নভোস্তি এর খবরে বলা হয়েছে, ইউক্রেনে চলমান সামরিক অভিযানে পারমাণবিক কিংবা ব্যাপক প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের কোনো পরিকল্পনা রাশিয়ার নেই। গত সোমবার জাতিসংঘের নিরস্ত্রীকরণ কমিশনের এক বৈঠকে এ তথ্য জানিয়েছেন সেখানকার রুশ উপপ্রতিনিধি দিমিত্রি পোলিয়ানস্কি। বৈঠকে পোলিয়ানস্কি বলেন, (রাশিয়ার বিরুদ্ধে) বর্তমানে যেসব প্রচার-প্রচারণা চলছে, তার বিপরীতে গিয়ে আমি বলব, রাশিয়া কেবল তখনই পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগের বিষয়ে ভাববে যদি কোনো রাষ্ট্র রাশিয়ায় আগ্রাসন চালানোর উদ্যোগ নেয় কিংবা যদি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব-অখণ্ডতা হুমকির মুখে পড়ে। ইউক্রেনে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের মতো পরিস্থিতি হয়নি; আর রাশিয়া দৃঢ়ভাবে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার না করার পক্ষপাতি। কারণ আমরা বিশ্বাস করি— পরমাণু যুদ্ধে কেউই বিজয়ী হয় না। পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোকে ঘিরে দ্বন্দ্বের জেরে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। তার আগে, ২২ ফেব্রুয়ারি দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় দুই ভূখণ্ড দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় মস্কো।

এদিকে, ইউক্রেনে রুশ অভিযান শুরুর পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা বলে আসছে, ইউক্রেনে যে কোনো মুহূর্তে পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগ করতে পারে রাশিয়া। সোমবারের বৈঠকে এ সম্পর্কে পোলিয়ানস্কি বলেন, রাশিয়া তার মর্মমূলে রক্ষণাত্মক, আক্রমণাত্মক নয়। যারা প্রচার করছে যে রাশিয়া পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার করতে পারে, তারা আমাদের সম্পর্কে কিছু না জেনেই তা প্রচার করছে; এবং এই কাজটি তারা করছে রাশিয়ার প্রতি বিদ্বেষবশত।

ইউক্রেনের মারিউপোল বন্দরে ডমিনিকান পতাকাধারী তুরস্কের একটি জাহাজে আগুন লেগেছে। ‘আজবুর্গ’ নামে জাহাজটি থেকে প্রচুর ধোঁয়া বের হতে দেখা গেছে। মঙ্গলবার রুশ বার্তা সংস্থা স্পুটনিক এসব কথা জানিয়েছে। ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল দোনেৎস্কের কর্মকর্তাদের বরাতে স্পুটনিকের খবরে দাবি করা হয়েছে, তুর্কি জাহাজটিতে ইউক্রেনের জাতীয়তাবাদীরা হামলা চালিয়েছে। তারা এটি রুশ বাহিনীর কাজ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করতে পারে বলেও দাবি করা হয়েছে। দোনেৎস্ক সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মারিউপোল বন্দর নিয়ন্ত্রণ করা ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীরা পরাজয় আসন্ন বুঝতে পেরে সেখানকার অবকাঠামোর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা বিদেশি জাহাজগুলো ধ্বংস করছে।

রাশিয়ার কাছ থেকে সম্প্রতি স্বাধীনতার স্বীকৃতি পাওয়া দোনেৎস্কের কর্মকর্তারা আরো অভিযোগ করেছেন, ক্রুসহ ছয়টি বিদেশি জাহাজ সরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে তাদের অনুরোধ উপেক্ষা করে চলেছে কিয়েভ প্রশাসন। রাশিয়ার ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরুর আগেই ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীরা বন্দরের জলসীমায় মাইন বসিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সেটি অবরুদ্ধ করে ফেলেছিল বলে দাবি করেছেন তারা। এর আগে, রুশ অভিযানের মুখে গত মাসের শুরুর দিকে ইউক্রেনের ওলভিয়া বন্দরে রকেট হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশি জাহাজ ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’। এতে প্রাণ হারান এক নাবিক, বাকি ২৮ জনকে নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। জাহাজটিতে হামলার ঘটনায় বিমা সংস্থার কাছে ২ কোটি ২৪ লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ চেয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন।

ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ সংলগ্ন শহর বুচায় গণহত্যার প্রতিবাদে এক যোগে ৪০ রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে জার্মানি। সোমবার জার্মান সরকারের বিবৃতির বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি। এ প্রসঙ্গে জার্মানির সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, বুচায় নিষ্ঠুর ও ন্যক্কারজনক গণহত্যায় রাশিয়ার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ বিশ্ব বিক্ষুব্ধ। এই বিক্ষোভের সঙ্গে একাত্মতা ও গণহত্যার প্রতিবাদে জার্মানির সরকার কয়েক রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কতজন কূটনীতিককে বহিষ্কার করা হয়েছে, সেই সংখ্যা বিবৃতিতে দেয়নি জার্মানি; তবে দেশটির রাজধানী বার্লিনের রুশ দূতাবাস এএফপিকে জানিয়েছে, বহিষ্কারাদেশ প্রাপ্ত কূটনীতিকের সংখ্যা ৪০ জন। এদিকে এ ঘটনায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে বার্লিনে নিযুক্ত রুশ দূতাবাস এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ক্রেমলিন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে পোস্ট করা এক বিবৃতিতে বার্লিনের রুশ দূতাবাস থেকে এ সম্পর্কে বলা হয়, এ ধরনের অমূলক ও ভিত্তিহীন বহিষ্কারাদেশ আমাদের দেশের সঙ্গে জার্মানির সংলাপের সুযোগ সীমিত করবে এবং তার ফলে, রাশিয়া ও জার্মানির পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। পৃথক এক বিবৃতিতে ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে এ সম্পর্কে বলা হয়, বুচায় যা ঘটেছে তা নিয়ে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত আমরা সবাই প্রত্যাশা করছি; কিন্তু কেবল কিয়েভকে সমর্থন করতে সেই তদন্তের জন্য অপেক্ষা না করে জার্মানি যে পদক্ষেপ নিল, তা আমরা স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করছি। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের আশপাশের এলাকা থেকে রুশ বাহিনী সরে যাওয়ার পর বুচা শহরে ৪১০টি মৃতদেহের সন্ধান পেয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। রাশিয়ার সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে তদন্ত শুরু করতে গিয়ে এসব মৃতদেহ খুঁজে পেয়েছে তারা। রোববার ইউক্রেনের শীর্ষ প্রসিকিউটর বলেছেন, এ বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু, তারা এতটাই মর্মাহত যে কথাও বলতে পারছে না। গত শনিবার কিয়েভের আশপাশের এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয় রাশিয়া। তারপর শহরগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রচার শুরু হয়। রাজধানী কিয়েভের পার্শ্ববর্তী বুচা শহরের মেয়র বলেছেন, চেচেন যোদ্ধারা এলাকাটি নিয়ন্ত্রণ করার সময় রুশ বাহিনীর গুলিতে অন্তত তিন শ’জন বাসিন্দা নিহত হয়েছেন।

নয়া শতাব্দী/এম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ