ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

কী ঘটছে ইমরান খানের ভাগ্যে?

প্রকাশনার সময়: ০১ এপ্রিল ২০২২, ০৮:৩৯

পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা পাকিস্তানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খান মসনদে থাকতে পারবেন কিনা। তার বিরুদ্ধে আনীত অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর সংসদে ভোটাভুটি শনিবারের মধ্যে সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

পাকিস্তানে সংসদীয় আসন ৩৪২টি। অনাস্থা ভোটে টিকে থাকতে হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৭২টি ভোট ইমরান খানকে পেতে হবে। বিলাওয়াল ভুট্টো, শাহবাজ শরীফসহ ইমরান বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা দাবি করছেন তাদের ১৯৯টি ভোট রয়েছে। ইমরান পরিস্থিতির গুরুত্ব ভালোমতোই বুঝতে পারছেন।

গত বুধবার জাতির উদ্দেশে ভাষণও দিতে চেয়েছিলেন তিনি। পরে কোনো কারণ না দেখিয়েই তা বাতিল করেন। কিন্তু ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আবারো মত বদলে ভাষণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। গতকাল বৃহস্পতিবার যে কোনো সময় এই ভাষণ দেয়ার কথা ছিল।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের বিশ্লেষণে জানা গেছে, সাম্প্রতিককালে সেনাবাহিনী এবং আমেরিকার সমর্থন হারিয়েছেন ইমরান খান। বিভিন্ন রাজনৈতিক সভায় সেনাবাহিনী ইমরানের দলের পেছনে আছে— এমন প্রচারণা প্রকাশ্যে চালানোর বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি সেনা প্রধানসহ সিনিয়র সেনা কর্মকর্তারা। আরেকটি বিষয় হলো আইএসআইয়ের প্রধান হিসেবে নাদিম আনজুমের নিয়োগ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান কামার জাভেদ বাজওয়া চার মাস আগে তাকে আইএসআই প্রধান হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করেন। কিন্তু ইমরান খান বিষয়টি বেশ কিছুদিন ঝুলিয়ে রাখেন, যা সেনাপ্রধানের পছন্দ হয়নি। ইমরান খান প্রকাশ্যেই আইএসআইয়ের তৎকালীন প্রধান জেনারেল ফয়েজ হামিদের প্রতি তার সমর্থন ব্যক্ত করেন।

আমেরিকাও বেশ কিছু ঘটনায় ইমরান খানের ওপর তাদের অসন্তুষ্টি জানিয়েছেন। একসময় পাকিস্তান সবচেয়ে বেশি অস্ত্র কিনতো আমেরিকা থেকে। কিন্তু সম্প্রতি চীন থেকে বেশি অস্ত্র কেনা হয়েছে। আফগানিস্তানে তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইমরান খান মন্তব্য করেছিলেন, দাসত্ব থেকে দেশটি মুক্তি পেল। বিষয়গুলো ভালোভাবে নেয়নি বাইডেন প্রশাসন। ওসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তানে আশ্রয় দেয়ার পুরোনো বিষয়টিও আমেরিকা ভালোভাবেই বিবেচনায় রেখেছে। সাম্প্রতিক সংকটে আমেরিকা প্রকাশ্যে কোনো ভূমিকা না রাখলেও স্বয়ং ইমরান খান তাকে হটানোর পেছনে দেশটির হাত আছে বলে মন্তব্য করেন। এর প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যেই ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ইস্যুতে তাদের কোনো ভূমিকা নেই।

এদিকে, ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনা বিরোধী দলগুলোর অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর জাতীয় পরিষদের নিম্নকক্ষে বিতর্ক শুরু হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় বিকেল ৪টায় অধিবেশন শুরু হয়েছে। অধিবেশনের আলোচ্যসূচিতে অনাস্থা প্রস্তাবও রাখা হয়েছে। অনাস্থা প্রস্তাব ঘিরে সৃষ্ট অনিশ্চয়তার মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন ইমরান খান। এ ছাড়া ‘হুমকি দিয়ে চিঠি’ পাঠানোর ঘটনায় জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির (এনএসসি) বৈঠকর আহ্বান করেছেন প্রধানমন্ত্রী।

বৃহস্পতিবারে অধিবেশনের আলোচ্যসূচিতে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর বিতর্কের বিষয়টি রেখে বুধবার রাতে আদেশ জারি করে জাতীয় পরিষদের সচিবালয়। গত সোমবার বিরোধী নেতা শাহবাজ শরিফ প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিলেন। এ নিয়ে তৃতীয় কোনো পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী অনাস্থা প্রস্তাবের মুখোমুখি হলেন।

সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রশিদ বলেন, আগামী দুই দিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গণতন্ত্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে ইমরান খান অবিচল অবস্থান নিয়েছেন।

অন্যদিকে, একটি বিদেশি শক্তির ‘হুমকি দিয়ে চিঠি’ প্রেরণের বিষয়টি আলোচনা করতে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠক ডাকেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।

নিরাপত্তা ইস্যু সমন্বয়ে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটিই দেশটির সর্বোচ্চ ফোরাম।

এর আগে গত রোববার এক সমাবেশে একটি চিঠি দেখিয়ে ইমরান খান বলেছেন, তার বিরুদ্ধে বিদেশি ষড়যন্ত্রের প্রমাণ এই চিঠি। তার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাব এই বিদেশি ষড়যন্ত্রেরই অংশ। তার এ অভিযোগের কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

জিও নিউজের প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাবের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততার বিষয়টি জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা বলছে, অনাস্থা প্রস্তাবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা এবং প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ‘হুমকি দিয়ে চিঠি লেখার’ বিষয়টি ভিত্তিহীন।

পাকিস্তানের সাবেক এক কূটনীতিক বলেন, মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক পাকিস্তানি কূটনীতিকের বৈঠকে নেয়া নোটের প্রতি হয়তো ইঙ্গিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। চিঠিতে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে ওই কূটনীতিকের নিজস্ব মূল্যায়নও থাকতে পারে। পার্লামেন্টে আনা বিরোধীদের অনাস্থা ভোটে পাকিস্তানে এই প্রথম কোনো প্রধানমন্ত্রীর বিদায় নিতে হতে পারে। সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের কারণে পাকিস্তানে এর আগেও কোনো প্রধানমন্ত্রী তার মেয়াদ পূর্ণ করে যেতে পারেননি। এই ঝুঁকির মুখে দেশটির সামরিক বাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে ইমরান একাধিক বৈঠক করেছেন। দেশটির তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী গত বুধবার এই তথ্য জানিয়েছেন। জিও নিউজের প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়।

ফাওয়াদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ক্ষমতাসীন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দেশটির সামরিক নেতৃত্বকে শ্রদ্ধা করে। দেশের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর। বিরোধী পাকিস্তান মুসলিম লিগ নওয়াজের (পিএমএল-এন) প্রধান নওয়াজ শরিফকে বিদ্রূপ করে ফাওয়াদ বলেন, সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর একটি সমস্যা ছিল। তিনি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কব্জায় নিতে চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করেছেন। কেউ তাকে পদত্যাগ করতে বলেনি। আর প্রধানমন্ত্রীরও এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা নেই।

ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকারের জোটসঙ্গী মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট পাকিস্তান (এমকিউএম-পি)। গত বুধবার সংবাদ সম্মেলনে সরাসরি এই ঘোষণা দেয় তারা। এই ঘোষণার পর বিরোধীদের পাল্লা ভারী হলো।

এমকিউএম-পি’র এই ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মাথায় দেশটির তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী জানান যে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে ইমরান একাধিক বৈঠক করেছেন।

পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সরকারকে হুমকি দিয়ে কোনো একটি উৎস থেকে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে বলে বলা হচ্ছে। এই চিঠির বিষয়ে ফাওয়াদ বলেন, এ ধরনের হুমকি যে কোনো স্বাধীন দেশের কাছে অগ্রহণযোগ্য। পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের জন্য লড়াই চালিয়ে যাবেন ইমরান খান। তারা পার্লামেন্টের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে এ চিঠির বিস্তারিত প্রকাশ করতে পারেন। তারা এই চিঠির বিস্তারিত বিরোধীদের জানাতে পারেন।

মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সরকারি সংস্থা বা কর্মকর্তা পাকিস্তান সরকারকে কোনো চিঠি দেয়নি।

২৭ মার্চ পিটিআইয়ের এক সমাবেশে ইমরান অভিযোগ করেন, তার সরকার উৎখাতের প্রচেষ্টায় বিদেশি শক্তি জড়িত। আর এই কাজে পাকিস্তানেরই কিছু মানুষকে ব্যবহার করা হচ্ছে।

গত মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানের পরিকল্পনা ও উন্নয়নমন্ত্রী আসাদ উমর অভিযোগ করেন, পিএমএল-এনের সর্বোচ্চ নেতা নওয়াজ শরিফ বিদেশি শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। তিনি ইমরানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। নওয়াজ লন্ডনে বসে অন্যান্য দেশের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন।

অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও ভুল পররাষ্ট্রনীতির অভিযোগ তুলে জাতীয় পরিষদে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করে বিরোধী দলগুলো। পরে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করা হয়। প্রস্তাবের ওপর আগামী ৩ এপ্রিল ভোটাভুটি হতে পারে।

ইমরান ২০১৮ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত তার সরকারের মেয়াদ রয়েছে। তবে অনাস্থা ভোটে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই তার সরকারের পতন হতে পারে। পাকিস্তানে স্বাধীনতার পর দেশটির কোনো সরকার তার পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরানের ভাগ্যেও তেমনটা ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

নয়া শতাব্দী/এম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ