রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় শনিবার জানিয়েছে, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ইউক্রেনের একটি অস্ত্রভান্ডার উড়িয়ে দিয়েছেন তারা। তাছাড়া নতুন করে আরেকটি জ্বালানি ডিপোতে হামলা করার দাবি করেছে রাশিয়া।
এ ব্যাপারে শনিবার রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইগোর কোনাসেনকোভ বলেন, সমুদ্র থেকে চারটি কালিবার ক্রুস ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে, জায়তোমায়ার প্রদেশের ভেলেকি কোরোভোনসিতে অবস্থিত একটি অস্ত্রভান্ডার গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এই হামলায় একটি অস্ত্র ও গোলাবারুদে ভরপুর গুদাম ধ্বংস হয়ে গেছে।
ইগোর কোনাসেনকোভ আরো বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ইউক্রেনের ১১৭টি সেনা স্থাপনা পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ৬টি কমান্ড পোস্ট ও তিনটি বিমান।
বিবৃতিতে কোনাসেনকোভ আরো বলেন, এছাড়া উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ওনেক্স ক্রুস ক্ষেপণাস্ত্র মাইকোলাইভে আঘাত হেনেছে। এই হামলায় মাইকোলাইভের একটি জ্বালানি ডিপো ধ্বংস হয়ে গেছে। ইগোর কোনাসেনকোভ জানিয়েছেন, মাইকোলাইভের যে জ্বালানি ডিপোটি ধ্বংস করা হয়েছে সেই ডিপো থেকে দক্ষিণ দিকে অবস্থান নেয়া ইউক্রেনের সেনা সদস্যদের জ্বালানি সরবরাহ করা হচ্ছিল। এর আগে শুক্রবার রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইগোর কোনাসেনকোভ দাবি করেছিলেন, রাশিয়ার সেনারা ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় জ্বালানি ডিপোটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। রাজধানী কিয়েভের কাছে অবস্থিত কালইয়ানকোভাতে এ ডিপোটি ছিল। যুদ্ধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্মুখ লড়াইয়ে ইউক্রেনের সেনাদের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারেনি রুশ সেনারা। ফলে এখন রাশিয়া অবকাঠামো ধ্বংস করে দেয়ার দিকে নজর দিয়েছে।
কিন্তু সেক্ষেত্রে রাজধানী কিয়েভ ও তার আশপাশের এলাকাগুলোতে কেন হামলা চালাচ্ছে রুশ বাহিনী বিবিসির এ প্রশ্নের উত্তরে রুডস্কয় বলেন, ‘ডনবাস রিপাবলিক থেকে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর মনোযোগ অন্যদিকে সরানোর কৌশল হিসেবে কিয়েভ ও তার আশপাশের এলাকায় বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হচ্ছে। তবে আমরা মূলত সামরিক স্থাপনাগুলোতেই মনোযোগ দিচ্ছি। বেসামরিক স্থাপনাগুলো এড়িয়ে চলতে সেনা সদস্যদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’
এই প্রথম রাশিয়ার কোনো কর্মকর্তা সুনির্দিষ্টভাবে ইউক্রেনে অভিযান চালানোর কারণ ব্যাখ্যা করলেন। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এর আগে কয়েকবার বলেছেন, ইউক্রেনে অভিযান চালানোর লক্ষ্য দেশটিকে ‘নাৎসিবাদীদের’ কবল থেকে মুক্ত করা, কিন্তু তার এই বক্তব্য অনেকেরই বোধগম্য হয়নি। ফলে, অভিযান শুরুর পর থেকেই পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম ও রাজনীতিবিদরা বলছিলেন, ইউক্রেনের সরকার পতনের মাধ্যমে দেশটিকে দখল করার জন্যই সেখানে অভিযান চালাচ্ছে রাশিয়া।
পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোকে ঘিরে বেশ কয়েক বছর টানাপড়েন চলছিল দুই প্রতিবেশী দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে। এই টানাপড়েনের সূত্রপাত ২০০৮ সালে; ওই বছরই ন্যাটোর সদস্যপদের জন্য আবেদন করেছিল ইউক্রেন। সম্প্রতি ন্যাটো ইউক্রেনকে পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ না দিলেও ‘সহযোগী দেশ’ হিসেবে মনোনীত করার পর আরো বাড়ে এই দ্বন্দ্ব।
ন্যাটোর সদস্যপদের আবেদন প্রত্যাহারে ইউক্রেনকে চাপে রাখতে গত দুই মাস রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে প্রায় দুই লাখ সেনা মোতায়েন রেখেছিল মস্কো; কিন্তু এই কৌশল কোনো কাজে আসেনি। উপরন্তু এই দু’মাসের প্রায় প্রতিদিনই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা অভিযোগ করে গেছে যে কোনো সময় ইউক্রেনে হামলা চালাতে পারে রুশ বাহিনী। গত ২২ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দুই ভূখণ্ড দনেতস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় রাশিয়া; এবং তার দু’দিন পর, ২৪ তারিখ ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরুর নির্দেশ দেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন।
দোনেতস্ক ও লুহানস্ককে একত্রে ডনবাস রিপাবলিক বলে অভিহিত করা হয়। এই দুই অঞ্চলেই ব্যাপকভাবে সক্রিয় রুশপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। রুশ অভিযান শুরুর আগে থেকেই দুই অঞ্চলের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
বিবিসিকে রুডস্কয় জানান, রুশ অভিযান শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত লুহানস্কের ৯৩ শতাংশ ও দোনেতস্কের ৫৪ শতাংশ এলাকা রুশপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দখলে গেছে। এছাড়া অভিযানে এ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছেন ১ হাজার ৩৫১ জন ও আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৮২৫ জন রুশ সেনা। এই সংখ্যা অবশ্য ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্রের দাবির চেয়ে অনেক কম। এই দেশ দু’টির দাবি অভিযানে এ পর্যন্ত ১৫ হাজারেরও বেশি রুশ সেনা নিহত হয়েছেন।
পোল্যান্ডে ইউক্রেনের ২ মন্ত্রীর সঙ্গে বাইডেনের বৈঠক
ইউক্রেনের দুই মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। শনিবার পোল্যান্ডে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রায় এক মাস আগে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরুর পর কিয়েভ ও ওয়াশিংটনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে এটাই প্রথম মুখোমুখি বৈঠক। হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের সঙ্গে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকভের বৈঠকে অনানুষ্ঠানিকভাবে উপস্থিত হন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
গত শুক্রবার থেকে পোল্যান্ড সফরে রয়েছেন জো বাইডেন। পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ দুদার সঙ্গেও বৈঠক করবেন তিনি। এসব বৈঠকের পর ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
পশ্চিমারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে পরিপূর্ণ যুদ্ধ চালাচ্ছে: রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ অভিযোগ করেছেন, পশ্চিমারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘সম্পূর্ণ, হাইব্রিড যুদ্ধ’ শুরু করেছে। রাশিয়ার অর্থনীতিকে পুরোপুরি ধ্বংসের লক্ষ্যেই সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। শুক্রবার মস্কোতে গোরচাকভ পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি ফান্ডের এক বৈঠকে উপস্থিত থেকে এসব কথা বলেন তিনি। এ সময় তিনি গত মাসে ইউক্রেনে চালানো রাশিয়ার অভিযানের বদলা হিসেবে পশ্চিমাদের পদক্ষেপকে ‘যুদ্ধ’ হিসেবে মন্তব্য করেন।
ল্যাভরভ বলেন, আজকে আমাদের বিরুদ্ধে সত্যিকারের একটি হাইব্রিড যুদ্ধ, একটি পরিপূর্ণ যুদ্ধ (টোটাল ওয়ার) ঘোষণা করা হয়েছে। এই টার্মটি হিটলারের জার্মানি ব্যবহার করেছিল। এখন অনেক ইউরোপিয়ান নেতা রাশিয়ান ফেডারেশনের সঙ্গে কী করতে চায় সেই ব্যাপারে কথা বলার সময় এটি ব্যবহার করছে।
এ ছাড়া রাশিয়ার অর্থনীতিকে বিচ্ছিন্ন করতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে যে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল তা কার্যকর হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, ওই রকম কিছুই হবে না কারণ বিশ্বের অধিকাংশ দেশই জাতিসংঘ সনদের মূল নীতির ওপর ভিত্তি করে আন্তঃদেশীয় সমতার সহযোগিতায় আগ্রহী। তিনি যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্র শক্তির চাপ সত্ত্বেও যেসব দেশ ‘রাশিয়াবিরোধী হুজুগে’ যোগ দেয়নি তাদের ব্যাপারে ডিপ্লোম্যাসি ফান্ডের সদস্যদের নোট রাখতে আহ্বান জানান।
এসব দেশের মধ্যে চীন ও ভারতও রয়েছে, যারা ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া হুজুগেও মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের অস্বীকার করেছে। যদিও দুটি দেশই সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে এবং এই সংকটের কূটনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে। এদিকে বেইজিং স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, তারা রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক থেকে সরবে না এবং জোর দিয়ে বলেছে ইউক্রেন সংঘাতে দেশটি নিজেদের ‘স্বাধীন’ অবস্থান ধরে রাখবে।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ