রামায়নে কবি চন্দ্র চক্রবর্তী লিখেছিলেন—‘রাজার পাপে রাজ্য নষ্ট, প্রজা কষ্ট পায়’। শ্রীলঙ্কার চলমান অর্থনৈতিক মহাসংকটের কারণ খুঁজতে গেলে প্রথমেই আসবে রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের ভুলনীতির কারণে কীভাবে একটি দেশ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হতে পারে সেটার ‘টেক্সটবুক’ বা ধ্রুপদী উদাহরণ হচ্ছে আজকের শ্রীলঙ্কা।
মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মালদ্বীপের পরেই শ্রীলঙ্কার অবস্থান। পর্যটন থেকে বিপুল আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের কারণে সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল এই দ্বীপ রাষ্ট্রটির। কিন্তু গত এক দশকে দেশটির নীতি-নির্ধারকদের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত ও করোনা মহামারির কারণে শ্রীলঙ্কা আজ মহা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা লাভের পর কখনোই এতটা সংকটে পড়েনি লঙ্কানরা। এমনটি তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধেও এতটা মন্দার মুখে পড়েনি শ্রীলঙ্কা। অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে বিদেশি ঋণ পরিশোধের দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে নিজেদের দেউলিয়াও ঘোষণা করতে পারে দেশটি। অর্থনৈতিক সংকট কতটা মারাত্মক সেটা বোঝার জন্য গত কয়েকদিনের সংবাদপত্রের দিকে নজর দিলেই বোঝা যাবে। কাগজ কেনার মতো বৈদেশিক মুদ্রা না থাকায় সম্প্রতি সাড়ে চার লাখ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হয় দেশটির শিক্ষা বিভাগ। কাগজের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে অন্তত দুটি পত্রিকার প্রকাশনা। জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় ফিলিংস্টেশনগুলোতে চলছে রেশনিং ব্যবস্থা। সেটা মসৃণভাবে করতে ফিলিংস্টেশনগুলোতে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। মুদ্রার অব্যাহত দরপতন ঘটছে। ফলে খাদ্য ও নিত্যপণ্যের দাম প্রতিনিয়তই হু-হু করে বেড়ে চলেছে। রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে জনতা। জাফনা উপদ্বীপ থেকে দলে দলে লোকজন ভারতের তামিলনাড়ুতে প্রবেশ করছে। কয়েক লাখ লোক ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জরুরি প্রয়োজন মেটানোর মতো অর্থ না থাকায় প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছে ঋণের জন্য অনুনয়-বিনয় করতে হচ্ছে শ্রীলঙ্কাকে। এরই মধ্যে ভারতের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলার লাইন অব ক্রেডিট পেয়েছে। বাংলাদেশও শ্রীলঙ্কার জন্য ২৫ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দিচ্ছে। ‘কারেন্সি সোয়াপ’ ব্যবস্থার অধীনে এরই মধ্যে ১৫টি কোটি ডলার শ্রীলঙ্কাকে দেয়া হয়েছে। পাকিস্তানের কাছেও ২০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তার আবেদন করেছে শ্রীলঙ্কা। এমনকি ইরান থেকে তেল ক্রয় বাবদ ২৫ কোটি ডলার পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে দেশটিকে প্রতি মাসে ৫ মিলিয়ন ডলারের চা দিয়ে অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির পার্লামেন্ট সদস্য রমেশ পাথিরানা।
যে পাঁচ কারণে এই মহাসংকটের মুখে শ্রীলঙ্কা:
বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যয় : ২০১০ সালের পর থেকেই হু-হু করে বাড়ছে চীনের বৈদেশিক ঋণ। ২০১৯ সালে দেশটির ঋণ মোট জিডিপির ৮৮ শতাংশে এসে দাঁড়ায়। এরপরই বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির প্রকোপ দেশটিকে আর্থিকভাবে খাদের কিনারায় নিয়ে যায়। ২০২১ সালে দেশটির মোট জিডিপির চেয়েও বেশি হয়ে দাঁড়ায় বৈদেশিক ঋণ। যেটা বর্তমানে জিডিপির ১০১%। দেশটির কাছে ফেব্রুয়ারি মাস শেষে মাত্র দুই বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে। যেটি গত ১০ বছরের মধ্যে এটি সর্বনিম্ন। সাধারণত কমপক্ষে ৩ মাসের আমদানি বিল পরিশোধ করার সক্ষমতা থাকলে কোনো দেশের অর্থনীতি অপেক্ষাকৃতভাবে ঝুঁকিমুক্ত থাকে। অথচ এখন শ্রীলঙ্কার হাতে আছে মাত্র এক মাসের আমদানি বিল মেটানো সমপরিমাণ রিজার্ভ। অথচ চলতি বছরেই দেশটিকে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হবে। দেশটির মোট বৈদেশিক দেনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলার।
২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক অঙ্গন সভেরিন বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নেয়ার জন্য দেশটি প্রথমবারের মতো ৫০ কোটি ডলার সমমূল্যের সভেরিন বন্ড ছাড়ে এবং আস্তে আস্তে এই বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নেয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ে। এই বন্ডের শর্তগুলো বেশ কঠিন। সবচেয়ে কঠিন শর্ত হলো এই বন্ডের মূল বা আসল টাকা বন্ডের মেয়াদপূর্তির সময় একবারে পরিশোধ করতে হয়। অন্যান্য বন্ডের মতো কয়েক বছর মিলিয়ে শোধ করার সুযোগ নেই। তাই বন্ডের মেয়াদপূর্তির সময় ঋণগ্রহীতা দেশের ওপর বড় ধাক্কা আসে, যা শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে হয়েছে। ২০২০ এর শেষে এসে দেখা যায় শ্রীলঙ্কার মোট বৈদেশিক ঋণের অর্ধেকই এসেছে সভরেইন বন্ডের মাধ্যমে।
করোনায় পর্যটনে ধস ও রপ্তানি আয় হ্রাস : করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর লকডাউনের সময় ২০২০ সালে শ্রীলঙ্কার ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন বা ৪৫০ কোটি ডলারের পর্যটন শিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এর প্রভাব দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ওপর পড়ে এবং দেশটির রপ্তানি কমে যায় ১৭ শতাংশ। দেশটিতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আরেকটি বড় জায়গা হচ্ছে বিভিন্ন দেশে কর্মরত শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের পাঠানো ডলার। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারির সময় সেটি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কার ৮৮ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি ২০১৯ সালে এসে কমে ৮৩ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন স্পর্শ করে এবং ২০২০ সালে আরও কমে ৮০ দশমিক ৭ বিলিয়নে নেমে আসে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট এত বেশি তীব্র হয়ে ওঠে যে শ্রীলঙ্কান সরকার ২০২০ সালের মার্চে আমদানির ওপর অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প : গত ১৫ বছরে শ্রীলঙ্কা বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, রাস্তা এবং আরো নানা ধরনের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। যেমন- রাজধানী কলম্বোর কাছেই সমুদ্র থেকে ভূমি উদ্ধার করে কলম্বো পোর্ট সিটি নামে আরেকটি শহর তৈরি করা হচ্ছে। এর কাজ শেষ হতে সময় লাগবে ২৫ বছর এবং বাজেট ধরা হয়েছে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার।
অর্গানিক চাষাবাদের সিদ্ধান্ত : যথাযথ গবেষণা ও সমীক্ষা ছাড়াই প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে দেশে অর্গানিক কৃষি চালু করেন। সেজন্য কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। এর অংশ হিসেবে এক পর্যায়ে শ্রীলঙ্কায় কীটনাশক ও সার আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। তবে কৃষকদের বিক্ষোভের মুখে পরে সেটা স্থগিত হলেও কৃষিতে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। অনেক কৃষি জমিই অনাবাদি ফেলে রেখেছিলেন কৃষকরা। এছাড়া উৎপাদনও প্রায় ৩০ শতাংশ কমে যায়। ফলে এক সময় চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে শ্রীলঙ্কা ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের চাল আমদানি করত। চালের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। যদিও চীন সরকার ১ মিলিয়ন টন ধান বিনামূল্যে শ্রীলঙ্কাকে দেয়ার ঘোষণা দেয়। তারপরও তিন লাখ টন চাল আমদানি করতে বাধ্য হয় দেশটি।
আয়কর ও ভ্যাট কমিয়ে দেয়ায় রাজস্ব আদায়ে ধস : ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাভায় রাজাপাকসে দেশটিতে ভ্যাট এবং ট্যাক্স কমানোর সিদ্ধান্ত নেন। এ ধরনের পদক্ষেপে অনেক বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। ভ্যাট প্রদানের হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে আট শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক শ্রিমাল আবিরত্নে বিবিসিকে জানান, আয়কর এবং ভ্যাট কমানোর ফলে সরকারের রাজস্ব আয় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। ফলে সরকার আরো বেশি পরিমাণ ঋণ নিতে বাধ্য হয়। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক সিনিয়র ডেপুটি গভর্নর বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘ট্যাক্স কমানোর বিষয়টি ছিল একটি বড় ভুল।’
নয়া শতাব্দী/এস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ