ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ

কিয়েভ দখল যেকোনো সময়

প্রকাশনার সময়: ১২ মার্চ ২০২২, ০৮:৩৩

ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ অভিমুখী রাশিয়ার দীর্ঘ ৪০ মাইল সামরিক বহরটি গত এক দিনে উল্লেখযোগ্য হারে অগ্রসর হয়েছে। গতকাল শুক্রবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি শীর্ষ মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানিয়েছে বহরটি কিয়েভ থেকে মাত্র ৩ মাইল দূরে রয়েছে। অপর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্যাটেলাইট ইমেজে দেখা গেছে, রুশ কনভয় কিয়েভের কাছাকাছি রয়েছে। সম্ভবত, কিয়েভের আশপাশের এলাকায় সেনাদের নতুন করে মোতায়েন করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, ইউক্রেনের রাজধানীতে হামলার প্রস্তুতি হিসেবে সেনাদের পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে। ম্যাক্সার টেকনোলজির মতে, কনভয়টিকে সবশেষ আন্তনভ বিমানবন্দরের কাছে উত্তরপশ্চিম দিকে দেখা গিয়েছিল।

সেটি এখন অবস্থান পরিবর্তন করে কিয়েভের আশপাশে রয়েছে। স্যাটেলাইট ইমেজে আরও দেখা গেছে, কনভয়ের একটি অংশ কিয়েভের পাশে লুবিয়াঙ্কায় অবস্থান নিয়েছে। তারা সেই এলাকার আশপাশে কামান বসিয়েছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, নতুন স্যাটেলাইট ইমেজে দেখা গেছে সেই ৪০ মাইল দীর্ঘ রুশ কনভয় কিয়েভের কাছে চলে এসেছে।

কিয়েভের জন্য লড়াই চলমান থাকায় রুশ সেনাদের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। স্যাটেলাইট ইমেজ গত বৃহস্পতিবার কিয়েভের স্থানীয় সময় বেলা ১১টা ৩৭ মিনিটে তোলা হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, এতে দেখা গেছে লুবিয়াঙ্কার বনাঞ্চলে রুশ সেনারা অবস্থান নিয়েছে। এতে করে ধারণা করা হচ্ছে যে কোনো সময় কিয়েভ দখল করে ফেলতে পারে রুশ বাহিনী। এর আগে বৃহস্পতিবার কিয়েভের মেয়র বলেছিলেন, রুশ আক্রমণ মোকাবিলায় রাজধানী শহরটিকে কার্যত একটি দুর্গে পরিণত করা হয়েছে এবং সশস্ত্র বেসামরিক নাগরিকরা এটির সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন।

বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছিল, রুশ সেনাবহরের ট্যাংকগুলোকে সচল না রাখলে এগুলো ৪০ টন ওজনের রেফ্রিজারেটরে পরিণত হবে এবং রাশিয়ার সেনারা ঠান্ডায় জমে প্রাণ হারাবে। এরপর শুক্রবার ফের রুশ সেনাবহরের এগিয়ে যাওয়ার খবর সামনে এলো।

ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের অর্ধেক মানুষ চলে গেছেন বলে জানিয়েছেন শহরের মেয়র ভিতালি ক্লিৎশকো। গত বৃহস্পতিবার ইউক্রেন টেলিভিশনের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা এ তথ্য জানিয়েছে। রুশ সেনা কনভয় ধীরে ধীরে কিয়েভের দিকে এগিয়ে আসার প্রেক্ষাপটে শহরের মেয়র সংবাদমাধ্যমকে এ কথা জানিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি সবাইকে সতর্ক করে বলেছেন, কিয়েভ এখন একটি দুর্গ। এর প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি ভবন, প্রতিটি চেকপয়েন্ট সুরক্ষিত।

প্রতিবেদনে বলা হয়, রুশ সেনারা কিয়েভের দিকে অগ্রসর হওয়ায় প্রায় ২০ লাখ মানুষ রাজধানী ছেড়েছেন। গত বছরের হিসাব অনুযায়ী বৃহত্তর কিয়েভের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫ লাখ। মেয়র বলেন, আমাদের দিক থেকে বলতে পারি, প্রতি ২ জন কিয়েভবাসীর একজন রাজধানী ছেড়েছেন। রুশ সেনারা শহরের উত্তরপূর্ব প্রান্তে চলে এসেছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত রাতে রাজধানীর প্রধান মহাসড়কের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রুশ ও ইউক্রেনীয় সেনাদের মধ্যে তুমুল লড়াই হয়েছে।

ইউক্রেনের দুই প্রান্তের দু’টি পৃথক শহরে হামলার পাশাপাশি দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় ইভানো-ফ্রাংকিভস্ক শহরেও আক্রমণ শুরু করেছে রুশ সামরিক বাহিনী। শহরটির স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো সেখানকার দক্ষিণ-পশ্চিমে বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণের কথা জানিয়েছে। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভলনোভাখা শহর দখল করে নিয়েছে রুশপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। শুক্রবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বিবিসি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুক্রবার সকালে ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলীয় ইভানো-ফ্রাংকিভস্ক শহরে হামলা শুরু করে রুশ সামরিক বাহিনী। হামলার সময় শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে একাধিক বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম। এর আগে ইউক্রেনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় লুতস্ক এবং পূর্বাঞ্চলীয় দিনিপরো শহরে শুক্রবার সকালে হামলা শুরু করে রুশ সামরিক বাহিনী। দিনাইপার নদীর তীরে অবস্থিত দিনিপরো শহরটি মধ্য-পূর্ব ইউক্রেনের একটি প্রধান দুর্গ বলে পরিচিত। পূর্ব ইউরোপের এই দেশটিতে সামরিক অভিযান শুরুর পর এই প্রথম শহর দু’টিতে হামলা করল রুশ সেনারা। লুতস্ক এবং ইভানো-ফ্রাংকিভস্ক শহরে হামলার তথ্য নিশ্চিত করেছে রাশিয়া।

শুক্রবার রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাদের অতি-নির্ভুল, দূরপাল্লার আক্রমণ ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহরগুলোর দু’টি সামরিক বিমানঘাঁটিতে আঘাত হেনেছে। বিবিসি বলছে, ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু হলেও লুতস্ক ও ইভানো-ফ্রাংকিভস্ক শহরের মতো দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় শহরগুলোতে এর আগে রুশ সেনারা হামলা চালায়নি। যার কারণে ইউক্রেনের অন্যান্য অংশ থেকে বহু বেসামরিক মানুষ নিরাপত্তার সন্ধানে লভিভের মতো দেশটির পশ্চিমাঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিল। মস্কোর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে রুশ বার্তাসংস্থা আরআইএ জানিয়েছে, রাশিয়ার অবরোধ করে রাখা বন্দরনগরী মারিউপোলের উত্তরে অবস্থিত ভলনোভাখা শহর দখল করে নিয়েছে রুশপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। মারিউপোলের উত্তরে অবস্থিত এই শহরটি কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে অংশ নিতে ইচ্ছুক বিদেশি স্বেচ্ছাযোদ্ধাদের জন্য সবুজ সংকতে দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এ ধরনের যোদ্ধাদের ইউক্রেনের রুশপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করতে ডনবাস অঞ্চলে নিয়ে যেতে সম্মতি দিয়েছেন তিনি। শুক্রবারবার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এদিন রাশিয়ার নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠকে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু জানান, মধ্যপ্রাচ্যের ১৬ হাজার স্বেচ্ছাযোদ্ধা ইউক্রেনে গিয়ে রুশ-সমর্থিত বাহিনীর সঙ্গে লড়তে প্রস্তুত। এ বিষয়ে পুতিন বলেন, যদি দেখেন, এমন লোক রয়েছে যারা অর্থের জন্য নয়, স্বেচ্ছায় ডনবাসে বসবাসকারীদের সাহায্য করতে আসতে চায়, তাহলে আমাদের উচিত তাদের সেই ইচ্ছা পূরণ করা ও সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে যেতে সাহায্য করা। এদিন রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী আরও প্রস্তাব করেন, ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ সেনাদের হস্তগত হওয়া পশ্চিমাদের তৈরি জ্যাভেলিন ও স্টিংগার ক্ষেপণাস্ত্র ডনবাস বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হোক। জবাবে রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, অস্ত্র সরবরাহ, বিশেষ করে রুশ সেনাদের হাতে আসা পশ্চিমাদের তৈরি অস্ত্রগুলো আমি লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক প্রজাতন্ত্রের সামরিক ইউনিটগুলোর কাছে দেয়াকে সমর্থন করি। দয়া করে, এটাই করুন। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আক্রমণ শুরুর আগে দেশটির রুশপন্থি দুটি বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল লুহানস্ক ও দোনেৎস্ককে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এরপর এ দুটি অঞ্চলের জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতের অজুহাতে ইউক্রেনে কথিত বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু করেন তিনি। ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি আগেই ঘোষণা দিয়েছেন, রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে আগ্রহী বিদেশিদের ভিসার প্রয়োজন পড়বে না। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মানুষ চাইলেই তাদের পক্ষে লড়তে পারবেন। তার এই ঘোষণার পর সত্যি সত্যি বিভিন্ন দেশ থেকে স্বেচ্ছাযোদ্ধা ইউক্রেনে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এবার রাশিয়াও সেই একই পথ অনুসরণ করলো। যদিও বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর এ ধরনের সাহায্যের আদৌ প্রয়োজন রয়েছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। কেউ কেউ মনে করছেন, ইউক্রেনে বিদেশি স্বেচ্ছাযোদ্ধা অংশগ্রহণের খবরের পাল্টা জবাব দিতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পুতিন।

সহসাই পূর্ব ইউরোপের দেশ ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন জোটভুক্ত দেশের নেতারা। শুক্রবার সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা এ তথ্য জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফ্রান্সের ভার্সাই শহরে ইইউ নেতাদের সম্মেলনে ইউক্রেনকে ইউরোপীয় পরিবারের অংশ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও জোটের সদস্য হওয়ার বিষয়ে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে। ২৭ সদস্যের এই জোটের সম্মেলন গতকাল শুক্রবার শেষ হয়েছে। সম্মেলনে ক্রোয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেজ পলেনকোভিচ বলেন, কেউই হুট করে ইইউ সদস্য হননি। ইইউয়ের সদস্য বাড়ানোর বিরোধিতাকারী নেদারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুতে বলেন, জোটে জরুরিভিত্তিতে সদস্য নেয়ার ব্যবস্থা নেই। তিনি আরও বলেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির জন্য আমরা আজ বা কাল কী করতে পারি তার ওপর গুরুত্ব দিতে চাই। তবে ইউক্রেনকে জোটে নেয়ার প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ বলেছেন, কারো জন্যই জোটে ঢোকার দরজা বন্ধ হয়নি। যুদ্ধে জড়িয়ে আছে এমন কোনো দেশের সদস্য হওয়ার প্রক্রিয়া কি শুরু করা যায়? আমি তা মনে করি না। তাহলে প্রক্রিয়া কি বন্ধ করে দেব? কখনোই না। এটা করা ঠিক হবে না। মাখোঁ ইউরোপের ভারকেন্দ্রের কথা মাথায় রেখে সবাইকে সতর্কতার সঙ্গে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। ইউক্রেনের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থন প্রকাশ করে ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট শার্ল মিশেল বলেন, ইউক্রেন ইউরোপীয় পরিবারের অংশ। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্য সদস্যরাও তড়িঘড়ি করে ইউক্রেনের জোটভুক্ত হওয়ার বিষয় নাকচ করে দিয়েছেন।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ২৫ লাখের বেশি মানুষ ইউক্রেন ছেড়েছে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি। শুক্রবার এক টুইটে তিনি বলেন, ইউক্রেনের শরণার্থীর সংখ্যা দুঃখজনকভাবে আজ ২৫ লাখে পৌঁছেছে। তিনি বলেন, আমরা অনুমান করছি, ইউক্রেনের অভ্যন্তরে প্রায় ২০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এই অর্থহীন যুদ্ধের কারণে কয়েক লাখ মানুষ তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। এদিকে গত বৃহস্পতিবার পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ দুদা জানান, ইউক্রেনের থেকে আসা প্রায় ১৫ লাখের বেশি শরণার্থী পোল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছে। শুক্রবার জার্মানির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইউক্রেন থেকে প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার শরণার্থী জার্মানিতে এসেছে। তবে, সংখ্যাটা আরও বেশি হতে পারে বলে জানিয়েছে জার্মানি।

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ