ইউক্রেনে প্রতিবেশী দেশ রাশিয়ার হামলার এক সপ্তাহ পার হলেও দেশটির গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে রুশ বাহিনীর হামলার তীব্রতা বেড়েছে। উত্তর, পূর্ব এবং দক্ষিণে অঞ্চলের শহরগুলোতে তাণ্ডব চালাচ্ছে রাশিয়ার সেনাবাহিনী। এই যুদ্ধকে ভাইরাসের সঙ্গে তুলনা করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি বলেছেন, দুই বছর আগে আমাদের দেশে প্রথম কোভিড রোগী শনাক্ত হয়েছিল। এক সপ্তাহ হয়েছে আরেকটি ভাইরাস আক্রমণ করেছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, পুতিনের উদ্দেশে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট বলেন, বিশ্বজুড়ে থাকা সব রুশভাষির নয়, রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের উচিত তার দেশের রুশভাষিদের সুরক্ষা দেয়া। ইউক্রেনের একাধিক শহরে রাশিয়ার টানা গোলাবর্ষণের প্রসঙ্গ এনে জেলেনস্কি দেশকে পুনর্নির্মাণের অঙ্গীকার করেন।
তিনি বলেন, রাশিয়া যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বিষয়েও শেখবে। পুতিনকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আপনি যদি আমাদের সব ক্যাথেড্রাল ও গির্জাও ধ্বংস করে ফেলেন, আমাদের বিশ্বাস ধ্বংস করতে পারবেন না। ইউক্রেন এবং ঈশ্বরের প্রতি আমাদের অগাধ বিশ্বাস, মানুষের প্রতি বিশ্বাস ধ্বংস করতে পারবেন না। আমরা প্রতিটি বাড়ি, প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি শহর পুনর্নির্মাণ করব। রাশিয়াকে বলব, পরাজিত রাষ্ট্রের দেয়া ক্ষতিপূরণ ও কর সম্বন্ধে শিখে রাখা। আপনাদের আমাদের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, প্রতিটি ইউক্রেনীয়ের বিরুদ্ধে যা করেছেন তার সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
গত ২৪ ঘণ্টায় ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর বিমান হামলায় দুই শিশুসহ ৮ বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বিবিসি। প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় খারকিভ শহর থেকে দক্ষিণ-পূর্বে দুই ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত ইজিয়াম শহরে বিমান হামলা চালিয়েছে রুশ সামরিক বাহিনী। এতেই ওই দুই শিশুসহ আট বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। ইজিয়াম শহরের ডেপুটি মেয়র ভলোদিমির মাতসোকিন বলেছেন, রুশ বিমান হামলায় শহরের কেন্দ্রস্থলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শহরের একটি সরকারি ভবনেও হামলা চালিয়েছে রুশ বিমান। এতে সেখানে দায়িত্ব পালনরত এক পুলিশ সদস্য আহত হন। এর আগে ফেসবুকে দেয়া এক পোস্টে ভলোদিমির মাতসোকিন জানিয়েছিলেন, রুশ হামলায় অজ্ঞাত সংখ্যক বাসিন্দা নিহত হয়েছেন। রুশ গোলা তাদের আবাসিক ভবনে আঘাত হানলে তারা নিহত হন।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে ইউক্রেনে ঢুকে হামলা শুরু করে রাশিয়ান সৈন্যরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবারই প্রথম ইউরোপের প্রথম দেশ হিসাবে রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনী স্থল, আকাশ এবং সমুদ্রপথে ইউক্রেনে সবচেয়ে বড় এই হামলা শুরু করে। একসঙ্গে তিন দিক দিয়ে হওয়া এই হামলায় ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পড়েছে বৃষ্টির মতো। এর আগে ইউক্রেনে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরুর চতুর্থ দিনে নোভা কাখোভকা নামে দেশটির একটি শহর দখলে নেয় রাশিয়ার সামরিক বাহিনী। নিউ কাখোভকা নামেও পরিচিত এই শহরটি ছোট হলেও কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কাখোভকা শহরটি দিনিপার নদীর তীরে অবস্থিত এবং এই নদীটি পানি পথে সরাসরি ক্রিমিয়া উপদ্বীপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কাখোভকা শহরের মেয়র ভলোদিমির কোভালেঙ্কো জানিয়েছিলেন, রুশ সেনারা কাখোভকা শহরের প্রধান প্রশাসনিক ভবন দখল করার পর সেখান থেকে ইউক্রেনের সব পতাকা সরিয়ে দিয়েছে। সামরিক অভিযান শুরুর একদিনের মাথায় গত শুক্রবার রাতে বিনা বাধায় ইউক্রেনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর মেলিতোপোল দখলে নেয় রুশ সেনারা। পরে শনিবার রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এই তথ্য নিশ্চিত করা হয়।
সর্বশেষ ইউক্রেনের অন্যতম প্রধান শহর এবং বন্দরনগরী খেরসনের দখল নেয় রুশ সামরিক বাহিনী। ব্যাপক হামলার পর বুধবার কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই শহরটির নিয়ন্ত্রণ নেয় রুশ সেনারা। খেরসন শহরের মেয়র ইগোর কলিখায়েভ জানিয়েছেন, দেশের অন্যতম প্রধান এই শহরটি দখলে নেয়ার পর রুশ সেনারা সিটি কাউন্সিল ভবনে প্রবেশ করে এবং শহরে কারফিউ জারি করে। বিবিসি বলছে, প্রায় ৩ লাখ বাসিন্দার খেরসন শহরটি রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর দখলে যাওয়া মস্কোর জন্য বড় ধরনের এক বিজয়। রাশিয়ার সৈন্যদের হাতে পতন হওয়া সবচেয়ে বড় শহরও এটি। একই সঙ্গে সামরিক বাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘাঁটিও হবে শহরটি। এই শহর থেকে উপকূল বরাবর আরও ভেতরে এবং পশ্চিমের আরেক বৃহৎ বন্দরনগরী ওডেসার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হবে। কৃষ্ণ সাগরের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর এবং একটি শিল্পকেন্দ্র এই খেরসন শহর।
ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে বাসিন্দাদের নিরাপদে সরে যেতে বলেছে রুশ সামরিক বাহিনী। মস্কো থেকে রুশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কিয়েভ থেকে বাসিন্দারা দেশটির মধ্যাঞ্চলীয় শহর ভ্যাসিলকিভের দিকে চলে যেতে পারবেন এবং এতে তাদের বাধা দেয়া হবে না। গতকাল বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেনে রুশ সামরিক বাহিনীর অভিযান সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ব্রিফিং করার সময় রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মেজর জেনারেল ইগোর কোনাশেঙ্কোভ কিয়েভের বাসিন্দাদের এই প্রস্তাব দেন। রাশিয়া ২৪ নিউজ চ্যানেলে মেজর জেনারেল ইগোর কোনাশেঙ্কোভকে বলতে শোনা যায়, (কিয়েভ থেকে) বেসামরিক মানুষের বেরিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা দেবে না রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার কিয়েভ থেকে বেসামরিক নাগরিকদের সরে যেতে বলল রাশিয়া। এর আগে গত সোমবার ইগোর কোনাশেঙ্কোভ কিয়েভের বাসিন্দাদের প্রতি একই আহ্বান জানিয়েছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, (বেসামরিক মানুষের জন্য) কিয়েভ থেকে বেরিয়ে ভ্যাসিলকিভে যাওয়ার রাস্তা খোলা এবং নিরাপদ। তবে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরুর পর থেকে ভ্যাসিলকিভ শহরও রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর ব্যাপক গোলাবর্ষণের শিকার হচ্ছে। সেক্ষেত্রে কিয়েভের বাসিন্দারা ভ্যাসিলকিভে গেলেও সেখানে তারা কতটা নিরাপদ সেটি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
রাশিয়ার চলমান আগ্রাসনে ইউক্রেনে নো ফ্লাই জোন কার্যকর করতে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর প্রতি কিয়েভ আহ্বান জানালেও তাতে সাড়া মেলেনি। নো-ফ্লাই জোন কার্যকরে অস্বীকৃতি জানানোয় দেশটিতে রাশিয়ার হামলায় বেসামরিক নাগরিকদের প্রাণহানির জন্য ন্যাটোকেও আংশিকভাবে দায়ী করেছে কিয়েভ। বৃহস্পতিবার ইউক্রেনের উপ-প্রধানমন্ত্রী ওলফা স্টেফানিশিনা বিবিসি রেডিও ৪-কে দেয়া সাক্ষাৎকারে ন্যাটোর বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, নো-ফ্লাই জোন কার্যকরের সিদ্ধান্ত না নওয়ার ফলে বেসামরিক জনগণ এবং শিশুদের হত্যা করা হবে, এটি অমানবিক। ইউক্রেনের এই উপ-প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, গতকাল জন্ম নেয়া দুই শিশু, যারা গোলার আঘাতে তাদের বাবা-মাকে হারিয়েছেন; তারাসহ সেসব বেসামরিক নাগরিকদের রক্ত কেবলমাত্র রাশিয়ার হাতে নয়, ন্যাটোর হাতেও আছে। দেশটিতে চলমান যুদ্ধে হতাহতের ঘটনায় ন্যাটো জোটের অবস্থানের সমালোচনার ক্ষেত্রে কূটনৈতিকসুলভ ভাষা পছন্দ করতে না পারার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন স্টেফানিশিনা। কারণ হিসাবে দেশটিতে বোমার মাঝে বসে তিনি কথা বলছেন বলে জানিয়েছেন।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ