দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান শুরু হয় ইউক্রেন আক্রমণের মাধ্যমে। দেশটিতে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের নেপথ্যে কারণগুলো খুঁজে দেখার আগে আমরা স্নায়ুযুদ্ধের সময় কিউবার মিসাইল সংকটের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করতে চাই। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন মার্কিন সীমান্তের কাছাকাছি নিজের মিত্রদেশ কিউবাতে কৌশলগত ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় মার্কিনিরা এবং এক পর্যায়ে কিউবাতে আক্রমণে উদ্যত হলে এক চুক্তির মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবা থেকে পরমাণু ওয়ারহেডবাহী ক্ষেপণাস্ত্র ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়।
কমিউনিস্টরা ১৯৫৯ সালে কিউবার ক্ষমতায় আসার তিন বছর পরই সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে সেখানে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মাত্র ৯০ মাইল দূরের দেশটিতে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনে ঘুম হারাম হয় বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি এর পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে দেশটিতে নৌ অবরোধ আরোপ করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত এই ক্ষেপণাস্ত্র না সরালে কিউবাতে সামরিক পদক্ষেপ নেয়ার কথা পরিষ্কার জানিয়ে দেন। দুই পরাশক্তির মধ্যে উত্তেজনা এতটাই চরমে পৌঁছে যে, বিশ্ব পরমাণু যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল। তবে তৎকালীন সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ কিউবাতে যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক হামলা এড়াতে গোপন এক চুক্তি করেন। যার ফলে মার্কিন আক্রমণ থেকে কিউবা রক্ষা পায় এবং দ্বীপ দেশটি থেকে পরমাণু অস্ত্রবাহী ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নেয়। তবে বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রও তুরস্ক থেকে পরমাণু অস্ত্রবাহী ক্ষেপণাস্ত্র সরাতে বাধ্য হয়। নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র কোনো আপস করেনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে। প্রয়োজনে মস্কোর সঙ্গে সামরিক সংঘাতে যেতেও দ্বিধা করেনি তারা।
এবার সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর গত তিন দশকে ন্যাটো কীভাবে রাশিয়ার নিরাপত্তার বিষয়টি অবজ্ঞা করে আসছে সেটি সম্পর্কে ধারণা নেয়া যাক। ন্যাটো সামরিক গঠনের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের মিত্র দেশগুলোকে নিয়ে ওয়ারশ প্যাক্ট বা ওয়ারশ সামরিক জোট গড়ে তোলে সোভিয়েত ইউনিয়ন। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯১ সালের জুলাইয়ে ন্যাটোবিরোধী সামরিক জোট ভেঙে দেয়া হয়। পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে পূর্ব জার্মানির একত্রীকরণের সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর নীতি নির্ধারকরা পূর্ব ইউরোপ ও রুশ সীমানায় ন্যাটো সম্প্রসারণ করা হবে বলে বারবার রাশিয়াকে আশ্বস্ত করে আসছিলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাশিয়াকে কেবল ধোঁকাই দিয়ে আসছিলেন তারা। রাশিয়ার নিরাপত্তা নিয়ে দেয়া কথা রক্ষা করেনি যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটো কেউই।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ৫ দফায় ন্যাটোর সম্প্রসারণ হয়। এর সবটুকুই হয় পূর্ব ইউরোপ বা রাশিয়া অভিমুখী। ১৫টি রাষ্ট্র ন্যাটোভুক্ত হয়। যার সবই এককালে সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ বা মিত্র ছিল। তবে রাশিয়ার বুকের মধ্যে থাকা ইউক্রেন ও জর্জিয়াকেও ন্যাটো জোটে টানার চেষ্টা হলে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখাতে বাধ্য হয় রাশিয়া। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মাত্র এই দুটি স্থানেই সামরিক অভিযান চালায় রাশিয়া। তবে রাশিয়ার আগে ইউরোপে প্রথম সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছিল কিন্তু ন্যাটোই। ২০০০-এর গোড়ার দিকে রাশিয়ার মিত্র সার্বিয়ার ওপর সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে কসোভোকে বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং এটিকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে পশ্চিমারা। যেটা ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ করেছিল রাশিয়াকে। এরপর রাশিয়ার ‘বুকের মধ্যে’ থাকা ইউক্রেন ও জর্জিয়াকেও ন্যাটোভুক্ত করা চেষ্টা করা হলে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেনি পুতিনের রাশিয়া। কারণ ঘরের কাছে ন্যাটোর তৎপরতা রাশিয়ার নিরাপত্তা মারাত্মকভাবেই ক্ষুণ্ন করতে যাচ্ছিল। ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে ন্যাটোভুক্ত করে ‘রেডলাইন’ লঙ্ঘন না করার জন্য বারবার পশ্চিমাদের সতর্ক করা সত্ত্বেও তারা অবজ্ঞা করে রাশিয়ার দাবিকে অগ্রাহ্য করে আসছিল।
রাশিয়ার সংবাদ মাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট পুতিন নিজের জবানিতেই জানিয়েছেন কেন তিনি ইউক্রেন সংকটে সামরিক পথ বেছে নিয়েছেন। রুশ সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা পরিষ্কার করে বলেছি ন্যাটোর আরো পূর্বদিকে সম্প্রসারণ গ্রহণযোগ্য নয়। এখানে কি বোধগম্য নয়? আমরা কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সীমান্তের কাছে ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করছি। না। বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে আমাদের ঘরের সামনে বসে আছে। এটা কি কোনো ধরনের অত্যাধিক চাহিদা যে, আমাদের ঘরের সামনে আর কোনো রকমের আক্রমণাত্মক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা রাখা না হয়। এখানে কী এমন অস্বাভাবিক লাগছে। আমরা কানাডা-মার্কিন সীমান্তে অথবা মেক্সিকো- আমেরিকান সীমান্তে আমাদের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা রাখলে আমেরিকানরা কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ