ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাশিয়ার দখলে চার শহর

কিয়েভ ও খারকিভে তুমুল লড়াই, পারমাণবিক অস্ত্র সতর্ক অবস্থায় রাখার নির্দেশ পুতিনের, রাশিয়ান আগ্রাসনকে ‘যুদ্ধ’ বলেছে তুরস্ক
প্রকাশনার সময়: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৮:৩৪

ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর দেশটির চারটি শহর দখল করেছে রাশিয়া। এর মধ্যে গতকাল রোববার তিনটি শহর দখল করেন রুশ সৈন্যরা। ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভে ঢুকে পড়ার পর দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে রুশ সেনাদের তুমুল লড়াইয়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে। রাজধানী কিয়েভেও লড়াই চলছে।

গত বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্ট পুতিনের নির্দেশে জল, স্থল ও আকাশপথে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করেন রুশ সৈন্যরা। অভিযান শুরুর তৃতীয় দিন গতকাল ইউক্রেনের দক্ষিণের জাপোরিঝঝায় অঞ্চলের মেলিটপোল শহর দখল করে নেন রুশ সৈন্যরা। বাকি তিনটি শহর হলো নোভা কাখোভকা, খেরশন ও বারদিয়ানস্ক।

মেলিটপোল দেশটির একটি মাঝারি আকারের শহর। ইউক্রেনের প্রধান বন্দরগুলোর একটি মারিওপোলের কাছেই মেলিটপোলের অবস্থান। ২৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় রাশিয়ার সেনাদের একটি দল কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই মেলিটপোল শহরে ঢোকে। এ সময় শহরের কিছু বাসিন্দাকে লাল পতাকা নিয়ে রাস্তায় নামতে দেখা যায়।

ইউক্রেনের সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী গতকাল রোববার দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর নোভা কাখোভকা দখলে নিয়েছেন রুশ সেনারা। শহরটি ছোট হলেও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, শহরটি দিয়ে পানিপথে ক্রিমিয়ায় যাওয়া যায়। ২০১৪ সালে সামরিক অভিযান চালিয়ে ক্রিমিয়া দখল করেছিল রাশিয়া।

নোভা কাখোভকায় রুশ সৈন্যদের ঢুকে পড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে ওই শহরের মেয়র ভলোদিমির কোভালেঙ্কো বলেছেন, রুশ সেনারা শহরের নির্বাহী কমিটির দখল নিয়েছেন। সব ভবন থেকে ইউক্রেনের পতাকা নামিয়ে দিয়েছেন। তিনি শহরের বাসিন্দাদের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘গোপন আশ্রয়স্থল থেকে বের হবেন না।’

গতকাল মস্কো দাবি করেছে, রাশিয়ার সেনারা ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় খেরোশেন ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় বারদিয়ানস্ক শহরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইগোর কোনাশেঙ্কোভ বলেছেন, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় খেরোশেন ও বারদিয়ানস্ক শহরের পুরো নিয়ন্ত্রণ দখলে নেন রাশিয়ার সেনারা।

ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হারকিভের রাস্তায় রাস্তায়ও দেশটির সেনাদের সঙ্গে রুশ সেনাদের লড়াই চলছে। আজ রুশ সেনারা শহরটিতে ঢুকে পড়ার পর দুই পক্ষের মধ্যে লড়াই শুরু হয়। এদিকে কিয়েভের উপকণ্ঠে ত্রোয়েশচনিয়া এলাকায় আজ একটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে। কিয়েভেও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়।

রাশিয়ার সেনাদের সঙ্গে তীব্র লড়াইয়ের পর ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভ ইউক্রেনীয় সেনাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে প্রাদেশিক গর্ভনর ওলেহ সিনেগুবভ স্থানীয় সময় গতকাল রোববার বিকেলে এক ফেসবুক পোস্টে দাবি করেছেন। ওই ফেসবুক পোস্টে তিনি বলেন, খারকিভের ওপর নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ আমাদের! সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ এবং প্রতিরক্ষা বাহিনী কাজ করছে, এবং শহরটি শত্রুদের হাত থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করা হচ্ছে।

এর আগে, সিনেগুবভ বলেছিলেন ‘রাশিয়ান শত্রুর হালকা যান খারকিভ শহরে প্রবেশ করেছে’। বাসিন্দাদের আশ্রয়স্থল ছেড়ে না যাওয়ারও আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। ইউক্রেনীয় সংবাদমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা ভিডিওতে রাশিয়ান যানগুলোকে খারকিভের রাস্তায় চলতে দেখা গেছে। একটি হালকা যান রাস্তায় পুড়তেও দেখা যায়। খারকিভেই প্রকৃত অর্থে রুশ ও ইউক্রেনীয় সৈন্যদের মধ্যে প্রথমবারের মতো রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ হয়েছে বলে বিবিসির সংবাদদাতা পল অ্যাডামস রোববার জানিয়েছেন।

শহরটি থেকে প্রকাশ পাওয়া কিছু ছবিতে দেখা যাচ্ছে, রাস্তার কোনায় কোনায় ইউক্রেনের সৈন্যরা রকেটচালিত গ্রেনেড নিক্ষেপ করছে এবং রুশ সৈন্যরা সাঁজোয়া যানের পেছনে পেছনে হেঁটে এগোচ্ছে।

পল অ্যাডামস লিখছেন, গত কয়েকদিনে রুশ কৌশল ছিল বড় শহরগুলো এড়িয়ে চলা এবং দৃশ্যত তাদের ইচ্ছা ছিল রাজধানী কিয়েভে ঢুকে সরকার পরিবর্তন ঘটানো। খারকিভের ক্ষেত্রে হয়তো সেই কৌশলে একটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। খারকিভ শহরটি রুশ সীমান্তের একেবারে কাছে এবং বরাবরই এ সম্ভাবনা ছিল যে রুশ অভিযান হলে এ শহরটিই হয়তো প্রথম বিপদে পড়বে।

রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র বহনকারী বাহিনীকে উচ্চ সতর্কতায় থাকার নির্দেশ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। টেলিভিশনে সম্প্রচার হওয়া এক বৈঠকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী সার্গেই সইগু ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভকে পুতিন বলেন, ‘ন্যাটো জোটের শীর্ষ দেশগুলোর নেতারা আমাদের দেশের ব্যাপারে আগ্রাসী মন্তব্য করছেন। আমি তাই প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সামরিক বাহিনীর প্রধানকে নির্দেশ দিচ্ছি ‘রাশিয়ান আর্মি ডিটারেন্স ফোর্স’কে যুদ্ধাবস্থার সতর্কতায় রাখতে।’

প্রেসিডেন্ট পুতিন আরো বলেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে বেআইনি নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। পারমাণবিক অস্ত্র বহনকারী বাহিনী সম্পর্কে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আরআইএ বলেছে, কৌশলগত এই বাহিনীগুলো রাশিয়া ও তার মিত্রদের ওপর আক্রমণ প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে, পরমাণু অস্ত্রের যুদ্ধে আগ্রাসনকারীদের পরাস্ত করাও এর উদ্দেশ্য।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনকে একটি ‘যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছে তুরস্ক। যা ন্যাটো সদস্য দেশের জন্য কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়ান নৌপথকে সীমাবদ্ধ করতে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তির পথকে প্রশস্ত করতে পারে। গতকাল রোববার তুরস্ক এ কথা বলেছে বলে রয়টার্সের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৩৬ সালের মন্ট্রিক্স কনভেনশনের অধীনে দারদানেলস এবং বসফরাসের ওপর তুরস্কের নিয়ন্ত্রণ আছে। যা ভূমধ্যসাগরীয় ও কৃষ্ণ সাগরকে সংযুক্ত করে এবং যুদ্ধের সময় বা হুমকি দেয়া হলে যুদ্ধজাহাজের চলাচল সীমিত করতে পারে।

পশ্চিমা প্রতিশ্রুতি এবং মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রেখে আঙ্কারা বলেছে, রাশিয়ার এই হামলা গ্রহণযোগ্য নয়। তবে রোববার পর্যন্ত তারা এই পরিস্থিতিকে যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করেনি।

তুরস্কের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ইব্রাহিম কালিন টুইট করেন, ইউক্রেন যুদ্ধের চতুর্থ দিনে আমরা রাশিয়ান হামলা অবিলম্বে বন্ধ এবং যুদ্ধবিরতি আলোচনা শুরু করতে রাষ্ট্রপতি এরদোয়ানের আহ্বানের পুনরাবৃত্তি করছি। তুরস্কের যোগাযোগবিষয়ক পরিচালক ফাহেরটিন আলতুন বলেন, ‘আমরা আমাদের অঞ্চলে আরো একটি যুদ্ধ দেখছি এবং মধ্যস্থতার জন্য এরদোয়ানের প্রস্তাবের পুনরাবৃত্তি করছি।’

রয়টার্স বলছে, কিয়েভ আঙ্কারার কাছে আবেদন করেছে— তারা যেন রুশ যুদ্ধজাহাজকে কৃষ্ণ সাগরের দিকে যেতে বাধা দেয়। তবে, তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শুক্রবার বলেছেন, মন্ট্রিক্সের অধীনে রাশিয়ার অধিকার আছে জাহাজগুলোকে তাদের নিজ ঘাঁটিতে ফিরিয়ে দেয়ার।

খারকিভে ইউক্রেনীয় বাহিনীর কমান্ডার ওলেগ সিনেগুবভ দাবি করেছেন, রাশিয়ার সীমান্ত থেকে প্রায় ২০ মাইল দূরে অবস্থিত শহরটিতে লড়াই চলাকালে কয়েক ডজন রুশ সেনা আত্মসমর্পণ করেছে। সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিনেগুবভ তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে কয়েক সেনার ছবি পোস্ট করেছেন এবং তাদের রুশ সেনা বলে দাবি করেছেন।

বেসামরিক মানুষকে বাড়ির ভেতর থাকার পরামর্শ দিয়ে সিনেগুবভ বলেছেন, ‘রাশিয়ার যোদ্ধারা তাদের অবস্থান ছেড়ে বেসামরিকদের মধ্যে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করছে। মানুষের কাছে পোশাক ও খাবার চাচ্ছে তারা।’

এর আগে গতকাল ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপদেষ্টা ভাদিম ডেনিসেনকো বলেন, ‘রাশিয়ান বাহিনী আমাদের শহরগুলোতে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কিয়েভ শহর, চেরনিহিভ শহর, মারিউপোল শহর, খারকিভ শহর সম্পূর্ণভাবে ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে আছে। রাশিয়ানরা তাদের দল পাঠাচ্ছে এবং তারা গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে গোলাগুলি চালাচ্ছে। তবে আমরা আমাদের সব শহরকে রক্ষা করেছি।’

ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের মেয়র ভিটালি ক্লিটসকো বলেছেন, রাজধানী শহরে কোনো রুশ সেনা নেই। ভিটালি ক্লিটসকো বলেন, সামরিক, আইন প্রয়োগকারী এবং আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা নাশকতা সৃষ্টিকারীদের শনাক্ত করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিয়েভের বাসন্দািদের সোমবার পর্যন্ত ঘরে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষের সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, কেউ বাইরে বের হলে তাকে ‘নাশকতা গ্রুপের সদস্য হিসেবে বিবেচনা করা হবে’। গতকাল কিয়েভের পরিস্থিতি শান্ত দেখা গেছে। রাস্তায় পুলিশ, সামরিক বাহিনী ও সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবী ছাড়া মানুষ দেখা যায়নি।

গতকাল নিজের টেলিগ্রামে পাঠানো বার্তায় ভিটালি ক্লিটসকো বলেন, রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে কিয়েভে ৯ জন বেসামরিক নাগরিক ‘হারিয়ে গেছে বা নিহত হয়েছে’। তাদের মধ্যে একজন শিশুও আছে।

জানা গেছে, শুক্রবার থেকে রুশ বাহিনী শহরের উপকণ্ঠে অবস্থান করছে এবং কিয়েভজুড়ে গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে।

ইউক্রেনীয় বাহিনী প্রধান শহর খারকিভের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছে বলে দাবি করেছেন আঞ্চলিক গভর্নর। টেলিগ্রামে দেয়া এক পোস্টে গভর্নর ওলেহ সিনেহাবুবভ বলেন, খারকিভের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ এখন আমাদের। সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ এবং প্রতিরক্ষা বাহিনী কাজ করছে এবং শহরটি পুরোপুরি শত্রুমুক্ত করা হচ্ছে।

এর আগে, রুশ সেনারা ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরটিতে প্রবেশ করে এবং নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল বলে দাবি করেছিল।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ফুটেজে দেখা গেছে, ইউক্রেন ও রাশিয়ার সেনাদের মধ্যে রাস্তায় সংঘর্ষ হচ্ছে। বিবিসি বলছে, নিয়ন্ত্রণের দাবি যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে, বেসামরিক নাগরিকরাও বিবিসিকে বলেছে— খারকিভ ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে ফিরে এসেছে এবং রাস্তায় সংঘর্ষ কমেছে।

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ