ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিশ্ব অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির আঘাত

প্রকাশনার সময়: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২১:৫৫

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের শুরুর্তেই আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারে পৌঁছেছে অপরিশোধিত জীবাশ্ম জ্বালানি তেলের দাম। ২০১৪ সালের পর এই প্রথম এত বড় বৃদ্ধির ঘটনা। এতে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাগুলো আরও দুর্বল হবে, একইসাথে বাড়বে মূল্যস্ফীতি। অর্থাৎ, আঘাত আসছে দুদিক থেকেই।

বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মহামারি থেকে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ব্যাহত না করেই অত্যন্ত জোরালো হয়ে ওঠা মূল্যস্ফীতিকেও নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছে। তাদের জন্য এবার বড় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে চলেছে জ্বালানির দরবৃদ্ধি।

এর আগে ইউক্রেন সংকট বাজে পরিণতির দিকে (যুদ্ধের) এগোচ্ছে এই শঙ্কায় লন্ডনের বাজারে জ্বালানি পণ্যের সূচক-ফিউচার্স ৩.৩ শতাংশে উল্লম্ফন করে। বিশ্ববাজারে রাশিয়া তেল ও গ্যাসের বড় সরবরাহক। যুদ্ধের ডামাডোলে দেখা দিয়েছে ইউরোপে গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি রপ্তানিকারক দেশটি থেকে সরবরাহ বন্ধের সম্ভাব্যতা।

জ্বালানি রপ্তানিকারক সব দেশ এই চড়া বাজারের সুবিধাভোগ করবে নিশ্চিতভাবেই। অর্থনীতির ওপর জ্বালানি তেলের প্রভাব অতীতের মতো সর্বব্যাপী অবস্থানে না থাকলেও, চড়া দামের কারণে কোম্পানিগুলোর উৎপাদন ব্যাহত হবে। বাড়তি দামের বোঝা চাপবে আপামর ভোক্তাদের কাঁধে। একদিকে বিদ্যুৎ, পানিসহ সব পরিষেবার অতিরিক্ত বিল আর অন্যদিকে আরও দামি হয়ে ওঠা খাদ্য, পরিবহন মূল্যের চাপে দিশেহারা হতে চলেছে অগণিত পরিবার।

তেলের দর উত্থানের সুবিধাভোগী ও ক্ষতিগ্রস্তদের নিয়ে একটি বিশ্লেষণ করেছে ব্লুমবার্গ ইকোনমিক্স। তাদের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, বাড়তি দামের বিপুল ফায়দা নিঃসন্দেহে লুটতে চলেছে মধ্যপ্রাচ্যের বৃহৎ তেল রপ্তানিকারক সৌদি আরব। লাভবান হবে রাশিয়াও। বাড়তি অর্থ আয় হবে সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ তেল রপ্তানিকারক অন্যান্য দেশও। আর ক্ষতির পাল্লা সবচেয়ে ভারী হবে দ. কোরিয়া, ভারত ও জাপানের মতো জ্বালানির বড় আমদানিকারক দেশগুলোর ক্ষেত্রে।

এবিষয়ে মেব্যাংক সিঙ্গাপুর শাখার জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিদ চুয়া হাক বিন বলেন, "বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে মূল্য সীমার মাত্রা কমিয়ে আনার চাপে ফেলবে জ্বালানি তেলের দরবৃদ্ধি। মূল্যস্ফীতির নাটকীয় উত্থান বন্ধে তাদের হয়তো সুদের হার আরও আগ্রাসীভাবে বাড়াতে হবে।"

মূল্যবৃদ্ধির ঝাঁকুনি

জ্বালানির চড়া দামের কারণে এরমধ্যেই ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলা করছে জি-২০ ভুক্ত দেশগুলো।

যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগান চেজ অ্যান্ড কোং তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১৫০ ডলারে পৌঁছানোর ব্যাপারেও হুঁশিয়ারি দিয়েছে। যা বাস্তবে রূপ নিলে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পায়ে পড়বে কুঠারের আঘাত। এতে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের বেশি বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। যা আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রকদের লক্ষ্যসীমার চেয়েও তিনগুণ বেশি।

বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশের এই অবস্থা হলে, অন্যদের কথা বলাই বাহুল্য।

তাছাড়া, তেলের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে কমোডিটি বা অন্যান্য পণ্য ও কাঁচামালের দামও চড়েছে বিশ্ববাজার সূচকে। আকাশপানের এই যাত্রায় সওয়ারী হয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাসও। এর আগে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ লকডাউনের বেড়াজাল থেকে বেড়িয়ে আসার পর চাঙ্গা হয়েছিল জ্বালানির বাজার। মাঝেমধ্যে ইরানের সাথে পশ্চিমা শক্তিগুলোর পরমাণু চুক্তির সম্ভাবনায় বাজার শান্তও হয়েছে। কিন্তু, এবার খোদ রাশিয়ার মতো বিশ্বশক্তি যুদ্ধে জড়ানোয় ভবিষ্যৎ প্রক্ষেপণ করা বেশ জটিল।

রাশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অশোধিত জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক, আর গ্যাস রপ্তানিতে প্রথম। আজো বিশ্ব অর্থনীতির ৮০ শতাংশ জ্বালানি চাহিদা মেটায় প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল, কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানি। বর্তমানে এসব পণ্যের দর সার্বিক বিচারে এক বছর আগের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি বলে উল্লেখ করছে বাজার পরামর্শক সংস্থা- গ্যাভেকাল রিসার্চ লিমিটেডের তথ্য।

জ্বালানি দরের চাপে পিষ্ট হয়ে আরও বাজে রূপ নিতে পারে বৈশ্বিক সরবরাহ চক্রের চলমান সংকোচন। সরবরাহ বিচ্ছিন্নতার একারণে ইতোমধ্যেই বহু পণ্য ও কাঁচামালের দাম বেড়েছে, দেরিও হচ্ছে সরবরাহে।

বৈশ্বিক উত্তরণ কি বিপন্ন?

২০২২ ও ২০২৩ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি মাঝারি আকারের হওয়ার প্রক্ষেপণ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)

চলতি বছর উন্নত অর্থনীতির দেশের জন্য গড় ভোক্তাপণ্যে মূল্যস্ফীতি ৩.৯ শতাংশ হওয়ার আভাস দিয়েছে আইএমএফ। উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশের জন্য তা গড়ে ৫.৯ শতাংশ ধরা হয়েছে।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল আমদানিকারক এবং ভোগ্যপণ্য রপ্তানিকারক চীন এপর্যন্ত বাড়তি মূল্যস্ফীতির সুবিধাভোগীই হয়েছে। কিন্তু, উৎপাদনের উৎস খরচ বাড়তে থাকায় এবং জ্বালানি সংকট ঘিরে উদ্বেগে ভীত দেশটির উদ্যোক্তারা, এসব বিষয় দেশটির অর্থনীতিতে বড় আঘাত হানতে পারে।

মূল্যের চাপ পূর্ব ধারণার চেয়েও আগেভাগে তীব্র হয়ে উঠতে থাকায়, অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন বাজার চাহিদা সমর্থন দেওয়ার চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

যেমন যুক্তরাষ্ট্রে চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে জোরালো মূল্যস্ফীতির ঘটনা দেশটির আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রকদের সম্বিৎ ফেরায়। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বাজি ধরে বলেছিলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলতি বছর ফেডারেল রিজার্ভ সুদ হার অন্তত ৭ বার বাড়াতে পারে।

জ্বালানি বাজারের চাপকে উল্লেখ করেই সুদহার বৃদ্ধির পক্ষে ন্যায্যতা দেন ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর আন্ড্রু বেইলি। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বাজারে বাড়তি অর্থপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিচ্ছে। এর প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিন লাগার্দে সম্প্রতি বলেছেন, জ্বালানি মূল্য কীভাবে অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে তা তারা 'সতর্কতার সাথে পরীক্ষা' করছেন।

তেলের চড়া মূল্যকে ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক- রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া।

এদিকে ব্যাংক অব কোরিয়ার নীতিনির্ধারণী সভাশেষে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনায় এর গভর্নর লি জু-ইয়োল ইউক্রেন সংকটের কারণে বৈশ্বিক পণ্য ও কাঁচামালের বাজার প্রভাবিত হওয়া এবং তার ফলে মূল্যস্ফীতির আগুনে ঘি ঢালার মতো পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা ব্যক্ত করেছেন।

একথা সত্য, এক কালে তেলই ছিল বিশ্ব অর্থনীতির প্রাণভোমড়া। বিশেষ করে, ১৯৭০ এর দশকে। কিন্তু, এখন বিকল্প অনেক জ্বালানিই জীবাশ্ম তরল খনিজটি থেকে খানিকটা দূরত্ব রাখার সুযোগ দিচ্ছে। তবে সেটা খুব বেশি নয়। তাছাড়া, মহামারি কালে দেওয়া প্রণোদনা বন্ধের পথে হাঁটছে বেশিরভাগ দেশ।

এই অবস্থায় সাধারণ ভোক্তার নাভিশ্বাস উঠলে প্রবৃদ্ধি হবে অনিশ্চিত। উন্নয়নশীল দেশে গৃহস্থালি সঞ্চয়েও বড় আঘাত হেনেছে মহামারি। সাধারণ মানুষের আয়- রোজগারে উন্নতি তেমন হয়নি। উন্নত দেশগুলো হয়তো জ্বালানি মজুদ দিয়ে প্রাথমিক সংকটের ধাক্কা সামলাতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব তেল উৎপাদন শিল্প দেশটিকে জ্বালানি নিরাপত্তা দেবে, কিন্তু বড় আমদানিকারক এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর ভোক্তার ভাগ্যে শনির দশাই কী রেখেছে জ্বালানির দরবৃদ্ধি? উত্তর জানতে হয়তো বেশিদিন অপেক্ষাও করতে হবে না। সূত্র: ব্লুমবার্গ অবলম্বনেৎ

নয়া শতাব্দী/এস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ