ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

চীন কেন তালেবানে ঝুঁকছে

প্রকাশনার সময়: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:১৩

বর্তমানে আফগানিস্তানের শাসনক্ষমতা সে দেশীয় সশস্ত্র সংগঠন তালেবানের হাতে। গত বছরের (২০২১ সাল) ১৫ আগস্ট অনেকটা বিনাযুদ্ধেই কাবুল বিজয়ের মাধ্যমে আফগানিস্তানে তালেবান বাহিনীর পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। মার্কিন বাহিনী ও ন্যাটোজোটের সেনারা অনেকটা পরাজিত হয়েই তড়িঘড়ি করে আফগানিস্তানের মাটি ত্যাগ করে। এর কিছুদিন বাদেই অস্থায়ী সরকার গঠনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক ক্ষমতাও নেয় তালেবান। তারপর থেকে আন্তর্জাতিক মহল থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে তালেবান সরকার।

কেবল চীন, পাকিস্তান, তুরস্ক, কাতার ও ইরানকেই দেখা গেছে তালেবান সরকারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে। এদের মধ্যে পাকিস্তান, তুরস্ক, কাতার ও ইরান মুসলিম রাষ্ট্র এবং এসব দেশের ক্ষমতাসীনরা ধর্মীয়ভাবে অনেকটাই ডানপন্থী। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে বাম ধারার কমিউনিস্ট রাষ্ট্র চীন ঘনিষ্ঠ প্রীতি গড়ে তুলেছে তালেবান সরকারের সঙ্গে।

মার্কিন বাহিনীর আফগান ত্যাগের বিষয় অনেকটা নিশ্চিত হওয়ার পর থেকেই চীনকে তালেবানের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করতে দেখা গেছে। প্রতিবেশী চীনের সঙ্গে সখ্যতা গড়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি তালেবানও। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে ৩ কোটি ডলার মূল্যের জরুরি মানবিক সহায়তা পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে চীনা সরকার। এছাড়াও দারিদ্র্যপীড়িত দেশটিতে সাহায্য পাঠানোর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিও অনুরোধ জানিয়েছে চীন। একইসঙ্গে তালেবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানে বিপুল বিনিয়োগের ঘোষণাও দিয়েছে দেশটি।

এদিকে দীর্ঘদিন ধরেই চীনা সরকারের বিরুদ্ধে দেশটির শিনজিয়াং প্রদেশে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিম সম্প্র্রদায়ের লোকদের অবরুদ্ধ করে নির্মম নির্যাতনের অভিযোগ তুলছে বিশ্ব মিডিয়া। সম্প্রতি শিনজিয়াংয়ের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উইঘুর মুসলিমদের জোরপূর্বক শ্রমদানে বাধ্য করার অভিযোগ তুলে চীনের শিনজিয়াংয়ের বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় বাইডেন প্রশাসন।

ফলে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে আর কোনো পণ্য আমদানি করা যাবে না যুক্তরাষ্ট্রে। অথচ উইঘুর মুসলিম নির্যাতনে অভিযুক্ত সেই কমিউনিস্ট চীন সরকার কট্টর ইসলামপন্থি তালেবানের সঙ্গে প্রীতির সম্পর্ক গড়ে তুলতে মরিয়া হয়ে উঠেছে! আসলে তাদের এই তালেবান প্রীতির নেপথ্যে রয়েছে অন্য রহস্য। আফগানিস্তানের পাহাড়ঘেরা ওয়াখান অঞ্চলটি চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় শিনজিয়াং প্রদেশের সঙ্গে সংযুক্ত। সেখানে আফগানিস্তানের সঙ্গে চীনের ৭৬ কিলোমিটারের অধিক সীমান্ত রয়েছে। ফলে এই অঞ্চল ব্যবহার করে অবরুদ্ধ উইঘুরদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে কোনো তালেবান যোদ্ধা যেন প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা না করে সেটা নিশ্চিত করতেই মূলত চীনা কর্মকর্তারা দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন তালেবান নেতাদের কাছে।

ইতিপূর্বে তালেবানরা নব্বইয়ের দশকে প্রথম ক্ষমতায় এলেও উইঘুর ইস্যুতে আতঙ্কিত হয়ে ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় তালেবানের সঙ্গে প্রথমবারের মতো দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে তোলে চীন। এ সময় আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করে উইঘুর সম্প্রদায়ের সদস্যরা যেন চীনা ভূখণ্ডে হামলা করতে না পারে সে জন্য পাকিস্তানের মাধ্যমে তালেবানকে চাপও দেয় চীন। সে সময় চীনের আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় উইঘুর যোদ্ধাদের ক্যাম্প বন্ধ করতেও তালেবানকে অনুরোধ করে তারা। বিনিময়ে সে সেময় তালেবান সরকারের আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য কাজ করাসহ নানারকম সহায়তার আশ্বাস দেয় চীন।

দুই দশক পর যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোজোটকে হটিয়ে আবারো তালেবানরা ক্ষমতায় আসায় বেইজিংয়ের আশঙ্কা, শিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বাধীন পূর্ব তুর্কিস্তান আন্দোলনের নির্বাসিত সদস্যরা আফগানিস্তান-চীন সীমান্তবর্তী ওয়াখান অঞ্চল ব্যবহার করে শিনজিয়াং প্রদেশে হামলা চালাতে পারে। এ সময় যদি তালেবানরা স্বাধীন পূর্ব তুর্কিস্তান আন্দোলনের উইঘুর সদস্যদের আফগানিস্তানের ভেতর আশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়, তাহলে তা চীনের জন্য হবে ভীষণ আতঙ্কের কারণ। কেননা, এই আফগানি যোদ্ধাদের সঙ্গে লড়তে গিয়েই তো বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এ জন্য তালেবানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে চায় চীনা কর্তৃপক্ষ।

তাছাড়া ইরাক ও সিরিয়া থেকে পলাতক আইএস সদস্যরা মধ্য এশিয়ায় পৌঁছানোর জন্য আফগানিস্তানের ওয়াখান অঞ্চল ব্যবহার করতে পারে। এমনকি তারা চীনের শিনজিয়াংয়েও প্রবেশ করতে পারে বলেও আশঙ্কা চীনা বিশ্লেষকদের। এদিকে আফগানিস্তান-চীন সীমান্তবর্তী এলাকার অদূরেই রয়েছে চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’র করিডোর। এই বিশাল প্রকল্পটির মাধ্যমে চীন অত্র অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে চায়। আফগানিস্তানে অস্থিতিশীলতার কারণে যদি এই করিডোর বিপদের মুখে পড়ে তাহলে চীনের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এসব বিষয় মাথায় রেখে তালেবান সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে সব চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে আগ্রহী চীনা কর্তৃপক্ষ।

এদিকে বিজ্ঞানীদের ধারণা, আফগানিস্তানে এক ট্রিলিয়ন ডলারের অধিক খনিজ সম্পদ রয়েছে। কিন্তু তালেবান সরকারের নেই এসব খনিজ সম্পদ উত্তোলন করে ব্যবহার করার প্রযুক্তি। আর এই প্রযুক্তি রয়েছে চীনের। অর্থাৎ চীনের প্রযুক্তি ও আফগানিস্তানের সম্পদ। এক্ষেত্রে তালেবানের শত্রু মার্কিনিরা এবং মার্কিনিদের শত্রু চীন। তাই শত্রুর শত্রুকে বন্ধু মেনে উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী তালেবানও। ফলে আফগানের খনিগুলোতে অনুসন্ধানের দায়িত্ব ইতোমধ্যে বাগিয়ে নিয়েছে চীন।

এ ছাড়াও আফগানিস্তানে রয়েছে এমন সব বিরল খনিজ সেগুলো স্মার্টফোন, ট্যাবলেট ও কম্পিউটার চিপ তৈরির ক্ষেত্রে জরুরি। এই খাতে এখনো তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার মতো প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জন করতে পারেনি চীন। তবে আফগানিস্তানে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের খনিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলে চীনও এই খাতে শক্তিশালী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। ফলে একথা বলাই যায় যে, মার্কিন বাহিনীর আফগান ত্যাগ ও সেখানে চীনের উপস্থিতি দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে চীনের কর্তৃত্বকে আরো বেশি শক্তিশালী করল। মূলত নিজেদের নিরাপত্তা ইস্যু ও অর্থনৈতিক স্বার্থেই তালেবানের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়তে চীনের এত দৌড়ঝাঁপ।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ