ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘এশিয়ান ইউনিকর্ন’ খুঁজছেন বিজ্ঞানীরা

প্রকাশনার সময়: ০৭ জানুয়ারি ২০২২, ২২:১২

রূপকথার ইউনিকর্ন একশিঙা ঘোড়ার মতো প্রাণী, কোনো কোনো কাহিনীতে যার আছে পক্ষীরাজের মতো ডানা। কিন্তু, বাস্তবেও কি ইউনিকর্ন থাকা সম্ভব! বিজ্ঞান এমন জীবের দেখা পায়নি বটে, কিন্তু 'এশীয় ইউনিকর্ন' নামের যে প্রাণীর সন্ধান করছে সে কাল্পনিক ইউনিকর্নের মতোই দুর্লভ। তার দেখা পাওয়াই মুশকিল।

প্রাণীটির প্রাকৃতিক আবাস দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশ ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওস। দেখতে তেমন আহামরিও নয়, নেই কল্পকথার জৌলুষ। ৮০-১০০ কেজি পর্যন্ত ওজনের এই প্রাণীর স্থানীয় নাম 'সাওলা'। দুই শিঙ, আর মুখে সাদা দাগের ছোপওয়ালা প্রাণীটি অত্যন্ত বিরল। বনের গহীনে লোকচক্ষুর আড়ালেই তার বিচরণ।

সাওলা এতটাই বিরল যে, ১৯৯২ সালের আগে জীববিজ্ঞানীরা এর সন্ধানও পাননি। এটাই ছিল অর্ধশতাব্দীকাল সময়ে নতুন করে কোনো বড় আকৃতির স্তন্যপায়ী প্রাণী আবিষ্কারের ঘটনা। তবে আবিষ্কার মানে প্রাণীটির অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া, সামনাসামনি সাওলাকে দেখা এত সহজ হয়নি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শত উন্নয়ন সত্ত্বেও।

গ্রামবাসীদের অনেকেই সাওলা ধরে পোষ মানানোর চেষ্টা করেছে বলে বিভিন্ন সময়ে জনশ্রুতি শোনা গেছে, কিন্তু বনজ খাদ্য ছাড়া সেগুলো বাঁচিয়ে রাখা যায়নি। ধরা পড়ার দিন কয়েকের মধ্যেই মারা যায়।

বিজ্ঞান সাওলার অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয় জীববিজ্ঞানী ডোক টোয়ুকের মাধ্যমে। তিনি ২১২ বর্গমাইল আয়তনের ভু কুয়াং সংরক্ষিত বনাঞ্চলে এক জরিপ চালানোর সময়ে ১৯৯২ সালে অজ্ঞাত কোনো প্রাণীর এক জোড়া খুলি ও শিঙ খুঁজে পান। এরপর পাওয়া যায় অক্ষত একটি চামড়াসহ বিভিন্ন দেহাবশেষের আরও ২০টি নমুনা। ১৯৯৩ সালে ল্যাবটেরিতে পরীক্ষার পর জানানো হয় এটি কেবল সম্পূর্ণ একটি নতুন প্রজাতিই নয়, বরং খুরওয়ালা তৃণভোজী 'বোভিড' প্রাণিকূলের মধ্যে স্বতন্ত্র জিন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এই বোভিডদের মধ্যে গৃহপালিত প্রাণী- ছাগল, মেষসহ বন্য অ্যান্টিলোপও পড়ে।

বিশ শতকে প্রাণিবিজ্ঞানের বিস্ময়কর এ আবিষ্কারের ৩০ বছর পর, বর্তমানে সাওলার সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে গেছে বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা। এজন্য তারা চোরাশিকারীদের উৎপাতকে দায়ী করছেন। ১৯৯৪ সালের পর থেকেই ভিয়েতনামে সংঘবদ্ধ চোরাশিকারী চক্রের তৎপরতা বহুগুণে বেড়েছে। তাছাড়া, বিরল এ প্রাণীর মাংস ও দেহের বিভিন্ন অংশের কথিত ওষুধিগুণের জন্যই এদের শিকার করা হয়।

ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়ার যে দুর্গম বনে সাওলার বাস তা অবস্থিত আনামাইট পাহাড়শ্রেণীতে। এটি লাওস ও ভিয়েতনাম থেকে কম্বোডিয়ার উত্তরপূর্ব পর্যন্ত ৬৮০ মাইল জুড়ে বিস্তৃত। দুর্গম এই বনে প্রাণীদের রক্ষা করতে ভিয়েতনাম সরকার বনরক্ষীদের টহল বাড়িয়েছে। কিন্তু, বিস্তীর্ণ এলাকার কোনো না কোনো অংশ দিয়েই নির্বিঘ্নে ঢুকে পড়ছে চোরাশিকারীর দল। মারণ ফাঁদ পেতে প্রতিবেশী তিনটি দেশজুড়ে তারা অবাধে বিভিন্ন বন্যপ্রাণি শিকার করছে। সাওলা বিরল হওয়ার কারণে তারা এটির অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভালো দাম পায় কালোবাজারে, আর সেটাই কাল হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় এ তৃণভোজীদের জন্য।

সমস্যার ভয়াবহতা তুলে ধরে কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির পিএইচডি ছাত্র মিন নগুয়েন বলেন, "কোনো বনে যদি কয়েক হাজার মানুষ ফাঁদ পাতে, তাহলে লাখ লাখ ফাঁদে ছেয়ে যেতে পারে বন। এই অবস্থায় বড় স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখিদের কোথাও নিরাপদে পালিয়ে বাঁচার সুযোগ থাকে না। একারণেই আনামাইট পাহাড়জুরে তাদের সংখ্যায় বড় পতন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।"

বিলুপ্তি ঠেকাতে সাওলা খুঁজছেন বিজ্ঞানীরা : ২০০১ সালে বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন, লাওসে ৭০-৭০০টি সাওলা রয়েছে, আর ভিয়েতনামে কয়েক শত। আরও সম্প্রতি এই সংখ্যা ১০০ এর নিচে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এরপর প্রাণীটিকে প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর জোট আইইউসিএন- এর মহাবিপন্ন প্রাণীর লালতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রাকৃতিক পরিবেশে কোনো প্রাণী সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হওয়ার অবস্থায় থাকলেই কেবল এ তালিকায় স্থান পায়।

সংখ্যায় কমে যাওয়ায় আজকাল ক্যামেরার ফাঁদে সাওলার ছবি তোলাও ভাগ্যের বিষয়। ২০১৩ সালে সর্বশেষ সাওলার ছবি তোলা হয়েছিল কেন্দ্রীয় ভিয়েতনামের সাওলা নেচার রিজার্ভে।

বিলুপ্তি ঠেকাতে তৎপর হন জীববিজ্ঞানী উইলিয়াম রুবিশেড ও প্রকৃতি সংরক্ষণবিদ সাইমন হেজেস। আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী চোরাশিকার বন্ধে যুক্ত এ দুই বিশেষজ্ঞ গঠন করেন সাওলা ওয়ার্কিং গ্রুপ। এটি গঠনের উদ্দেশ্য ছিল বন্য সাওলার সন্ধান এবং সেগুলো ধরে এনে বন্দী অবস্থায় প্রজননের মাধ্যমে বংশ বিস্তার। পরে এসব প্রাণীকে নিরাপদ কোনো প্রাকৃতিক রিজার্ভে অবমুক্ত করা হবে।

সংরক্ষণবাদী গ্রুপটি এখন লাওস ও ভিয়েতনামে সাওলা শিকারবন্ধে মানুষজনকে সচেতন করার প্রচারণা চালাচ্ছে। আবার স্থানীয়দের থেকে সাওলার গতিবিধির খোঁজখবর নিয়ে প্রাণীটিকে ধরার জন্য খুঁজে চলেছে।

বিজ্ঞানীরা জানেন, যত দ্রুত তারা জীবিত কিছু পুরুষ ও স্ত্রী সাওলা ধরতে পারবেন, প্রজাতিটি রক্ষার সম্ভাবনা ততোই বাড়বে। দেরি হলে ঠেকানো যাবে না বিলুপ্তি। তাছাড়া, এ কাজে সফল হতে যথেষ্ট দীর্ঘ সময়ও দরকার। তাই তারা ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু, ভাগ্য সুপ্রসন্ন হচ্ছে না একেবারেই।

সাওলা ওয়ার্কিং গ্রুপ ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত লাওসের খোন শে নোংমা জাতীয় উদ্যানের ১১ বর্গমাইল এলাকায় ৩০০টি ক্যামেরার ফাঁদ পাতে জন্তুটিকে খুঁজতে। কিন্তু স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরার তোলা লাখো ছবির ভিড়ে একটিও সাওলার দেখা মেলেনি।

আরেকটি বড় সমস্যা হলো, সাওলা যে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বাস করে সেই বনভূমির মাত্র ৩০ শতাংশ বন্যপ্রাণি জরিপের আওতায় এসেছে। এসব জরিপের আবার মাত্র ২ শতাংশ ক্ষেত্রে করা হয়েছে সাওলার সন্ধানে। ফলে বনের বিশেষ অংশে এর বিচরণ সম্পর্কে অজানা অনেক কিছু। তাছাড়া, সাওলা রেঞ্জের বিশাল অঞ্চলের ঘন, আদ্র ও অন্ধকার বনভূমিতে একা একা বিচরণ করা প্রাণীদের খুঁজে পেতে ক্যামেরার ফাঁদ খুব একটা কার্যকরও হয় না।

এ বাস্তবতায়, গেল বছরের আগস্টে আইইউসিএন এর প্রজাতি রক্ষা কমিশন (এসএসএন) সাওলার খোঁজে বিনিয়োগ বৃদ্ধির আহ্বান জানায়।

এসএসএন-এর এশিয়ান স্পিসিস অ্যাকশন পার্টনারশিপের পরিচালক নেরিসা চাও বলেন, ‘এই প্রজাতিটির বিলুপ্তি ঠেকাতে হলে আমাদের আরও বড় পরিসরে অভিযান চালাতে হবে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।’

এজন্য সাওলা ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠন বর্তমানে অনুদান সংগ্রহ করছে। তারা প্রশিক্ষিত কুকুরের মাধ্যমে সাওলা খোঁজার পরিকল্পনা করছে। বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত কুকুরেরা সাওলার মলমূত্র বা অন্য কোনো নমুনার সন্ধান পেলে সঙ্গে সঙ্গে তা মাঠপর্যায়ে ডিএনএ ফিল্ড টেস্টের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হবে।

নিঊইয়র্কের একটি গবেষণাগার ওয়াইল্ডলাইফ কনজার্ভেশন সোসাইটির মলিকিউলার ল্যাবরেটরি এই টেস্ট কিট তৈরি করেছে, যা এক ঘণ্টার মধ্যেই পজিটিভ ফলাফল দিতে পারে। কোনো নমুনা সাওলার বলে নিশ্চিত হওয়া মাত্রই সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞ বন্যপ্রাণি অনুসন্ধানীরা বনের ওই অংশ তন্ন তন্ন করে খোঁজা শুরু করবেন।

উদ্যোগটির মাধ্যমে সাওলাদের ধরা গেলে, তাদের একটি প্রজনন কেন্দ্রে আনা হবে। বাক মা জাতীয় উদ্যানে অবস্থিত এ কেন্দ্র পরিচালনায় থাকবে ভিয়েতনাম সরকার ও সাওলা ওয়ার্কিং গ্রুপ।

সাওলা ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুবিশেড বলেন, ‘অসাধারণ এ প্রানীটিকে কীভাবে খুঁজে পেয়ে বাঁচাতে হবে তা আমাদের জানাই আছে। পৃথিবীতে ৮০ লাখ বছর ধরে বিচরণকারী প্রাণীটিকে আমরা চিরতরে হারিয়ে যেতে দিতে পারি না। এজন্য বিশ্বের সকল মানুষের সহানুভূতি, সহযোগিতা প্রয়োজন। আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করলে খুব সামান্য কিছু অর্থ দিয়েই একে রক্ষা করা যাবে। সাওলাকে রক্ষার ফলে আনামাইট পাহাড় ও বাস্তুসংস্থানের যে বিশাল উপকার হবে, তার তুলনায় খরচের অঙ্ক খুবই নগণ্য।’

নয়া শতাব্দী/এস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ