ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তিনবার তাজমহল বিক্রি করেছিল যে প্রতারক! 

প্রকাশনার সময়: ১৯ নভেম্বর ২০২১, ২২:১৯

ইতিহাসের সেরা এক প্রতারক তিনি। একবার নয়, তিন তিনবার তিনি বিক্রি করে দিয়েছিলেন পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য ভারতের আগ্রার তাজমহল। শুধু তাজমহল নয়, মোটা অঙ্কের বিনিময়ে খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে সম্রাট শাহজাহানের নির্মাণ করা মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী লাল কেল্লা, রাষ্ট্রপতি ভবন, এমনকি ভারতীয় সংসদ ভবনও বিক্রি করেছিলেন তিনি।

নিজের বুদ্ধি, কুটিলতা, চুরি আর লোক ঠকানোর নজিরবিহীন ক্ষমতা দিয়ে যে কাউকে বোকা বানাতেন মুহূর্তেই। ‘প্রতিভাবান’ সেই ব্যক্তি হচ্ছেন ভারতের মিথিলেশ কুমার শ্রীবাস্তব।

১৯১২ সালে ভারতের বিহারের জিরাদাই জন্ম হয় শ্রীবাস্তবের। মেধাবী শ্রীবাস্তব স্নাতক পাস করার পরই আইন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। পাশাপাশি এ সময় থেকেই শুরু করেন প্রতারণা। ভিন্ন ভিন্ন প্রতারণা কাজে তিনি ভিন্ন ভিন্ন নাম ধারণ করেন। মোটামুটিভাবে তার ৫২টি ছদ্মনাম পাওয়া যায়। এর মধ্যে মিস্টার নটবর লাল নামটা তুমুল জনপ্রিয় হয়ে যায়। ইতিহাসে তিনি নটবর লাল বাবু নামেই খ্যাত। নটবর লাল বাবুকেই ভারতের অপরাধ বিশেষজ্ঞরা সর্বকালের সেরা প্রতারক বলে মনে করেন। শুধু ভারতসেরা নয়, বিশ্বসেরা ১০ প্রতারকের তালিকাতেও তার নাম সবার আগে।

হিন্দুস্তান টাইমসের খবর অনুযায়ী, নিজের গ্রামের এক লোকের সঙ্গে প্রথম প্রতারণা করেন তিনি। ১৯৩০ সালের দিকে সেই ব্যক্তি শ্রীবাস্তবকে শহরের ব্যাংকে ড্রাফট জমা করতে দিয়েছিলেন। জমা করার সময় ওই ব্যক্তির সই নকল করে ব্যাংক থেকে প্রায় এক হাজার টাকা তুলে নেন।

এ রকম কয়েকবার একই কাজ করার পর তিনি ধরা পড়েন। পরে নালিশ যায় তার বাবার কাছে। বাবার কড়া শাসনে ঘর ছেড়ে পালিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। সেখানে এক ব্যবসায়ীর ছেলেকে (টিউশনি) পড়ানো শুরু করেন। সেই ব্যবসায়ীকে ঠকিয়ে সাড়ে চার লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। এরপর ৬৬ বছর ধরে ভারতের আট রাজ্যে ৫২টি ছদ্মনাম ব্যবহার করে প্রায় চার হাজার লোককে ঠকিয়ে তিনি কোটি টাকা উপার্জন করেন। তিনি যেমন তুখোড় ইংরেজি বলতে পারতেন তেমনই ছিল ব্যক্তিত্ব ও আইনের বিষয়ে অগাধ জ্ঞান। এ ছাড়াও মানুষের সই হুবহু জাল করায় তিনি ছিলেন ওস্তাদ। একবার করো সই দেখেই সেই সইটা নিখুঁতভাবে নকল করতে পারতেন। বেশির ভাগ লোককে তিনি ঠকিয়েছেন তাদের সই জাল করে।

মার্কিন এক নবদম্পতি ভারতে ঘুরতে এসে তাজমহলের সৌন্দর্য দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন। তারা মনে মনে ভাবছেন, এই তাজমহলটা যদি নিজেদের হতো! ভালোবাসার এই অমর চিহ্ন যদি নিজেদের নামে রাখা যেত! এমন সময় পেছন থেকে হঠাৎই একটা কণ্ঠ ভেসে এলো ‘চাইলেই আপনি হতে পারেন এই তাজমহলের ভাগিদার!’

নবদম্পতি সামান্য কৌতূহলে জিজ্ঞেস করল, ‘কি করে?’ উত্তর এলো ‘চাইলেই আপনারা কিনে নিতে পারেন পুরো তাজমহল! আমি ভারতের একজন সরকারি কর্মচারী। আমাদের মতো আরো কয়েকজনের হাতে এই তাজমহল বিক্রির দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। আর সেই মোতাবেক আমরা কাজ করছি।’ কিন্তু, ‘কেন আপনাদের সরকার এই তাজমহল বিক্রি করতে চাইছেন?’ উত্তর বলেন, ‘আমাদের সরকারের গরিবি অবস্থার কথা তো আর কারো অজানা নয়।

আশপাশে দেখেন কত মানুষ না খেয়ে আছে। এই অনাহারে থাকা লোকগুলোর খাওয়ার জোগাতেই আমাদের সরকার হিমশিম খাচ্ছে। তার ওপর হাজার হাজার টাকা খরচ করে এই তাজমহলের রক্ষণাবেক্ষণ করা কি আমাদের দ্বারা সম্ভব?’ এমন উত্তরে গলে যান নবদম্পতি। যেহেতু হাতে টাকা রয়েছে হানিমুনে এসে এর চাইতে চমকপ্রদ উপহার আর কী-ই বা হতে পারে? তারা কিনে নেন তাজমহল!

আইনজীবী হওয়ায় জমিজমা কাগজপত্রের খুঁটিনাটি জানতেন নটবর লাল। তাজমহলের মালিকানা তার এই মর্মে প্রয়োজনীয় সব কাগজ ও সরকারি নথিপত্র জোগাড় করে বিদেশিদের কাছে আরো তিনবার তাজমহল বিক্রি করেছিলেন তিনি। শুধু তাজমহল নয়, লালকেল্লাও বেঁচে দিয়েছিলেন দুইবার। এ ছাড়াও প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের সই নকল করে সরকারি নির্দেশ জারিও করেন। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় নথিপত্র দেখিয়ে বেচে দিয়েছেন ভারতের লোকসভা ভবনও।

পুলিশ ও আদালতের কাছে থাকা মামলার নথি দেখলে বোঝা যাবে এসব অভিযোগ এক বর্ণ মিথ্যে নয়। কীভাবে ঠকাও লোকদের? কানপুর আদালতে বিচারকের মুখ থেকে এই প্রশ্ন শুনে তার কাছ থেকে এক টাকা চেয়েছিলেন নটবর লাল।

টাকা নিয়ে পকেটে পুরে নিয়ে নটবর লাল উত্তর দিয়েছিল, ‘আমি লোকেদের কাছে চাই আর তারা এভাবেই আমাকে দিয়ে দেয়। আমি কাউকে বন্দুক দেখিয়ে বা মারধর করে লুট করিনি। দেড়শ’টি মামলায় আমার বিরুদ্ধে আক্রমণ বা আঘাত করার অভিযোগ নেই। আমি চেয়েছি ওরা দিয়েছে। ভারত সরকার চাইলে আমার বুদ্ধি ধার নিতে পারে। বিদেশিদের কাছে ভারতের ধার মিটিয়ে দেব আমি।’ বলাবাহুল্য, চেয়ে নেয়া এক টাকা নটবর আর বিচারককে ফেরত দেননি।

দ্য ওয়ালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নটবর লাল তখন লখনৌ জেলে বন্দি। কয়েক মাস পর পর স্ত্রীর চিঠি আসে। কিন্তু দেড় বছর ধরে সে কোনো চিঠির উত্তর দেন না। আট নম্বর চিঠিটি নিয়ে এসে জেলার নটবর লালকে বলেছিলেন, এ চিঠির উত্তর তোমায় দিতেই হবে। নটবর লালের স্ত্রী চিঠিতে লিখেছেন, তিনি জমি চাষ করবেন, কিন্তু পয়সা নেই। উত্তরে নটবর লাল লিখেছিলেন, জমির একজায়গায় এক ফুট নিচে প্রচুর সোনা লুকানো আছে, সেখান থেকে কিছু নিয়ে আপাতত কাজ চালাতে। কয়দিন পরই জেল থেকে বেরিয়ে ঘরে ফিরে বাকি ব্যবস্থা তিনি করে দেবেন।

নটবরের লেখা চিঠি স্ত্রীর কাছে যাওয়ার আগেই পুলিশ গ্রামে চলে গিয়েছিল সোনা উদ্ধারে। কয়েকশ’ লোক লাগিয়ে পুরো জমি খুঁড়ে ফেলেও সোনা মেলেনি। কয়েক মাস পর জেলে নটবর লালের স্ত্রীর চিঠি এলো, তাতে লেখা পুলিশরা খেত চষে দিয়ে যাওয়ার ফলে ফসল এবার খুব ভালো হয়েছে। রাগে অগ্নিশর্মা জেলার নটবরের সেলে এসে চেঁচামেচি করতে থাকলে নটবর লাল বলেছিলেন, আপনি জোর করেছিলেন, তাই চিঠি লিখেছিলাম। এই জন্যই স্ত্রীর চিঠির উত্তর দিতাম না।

৬৬ বছর ধরে প্রতারণা চালিয়ে মোট নয়বার গ্রেফতার হয়েছিলেন নটবর লাল। জেলে মোট কাটিয়েছিল ২০ বছর। তার নামে আট রাজ্যে দেড়শ’র বেশি প্রতারণার মামলা করা হয়েছিল। প্রথম ১৪টি মামলার রায়েই নটবর লালের ১১৩ বছরের জেল হয়েছিল। তবে নয়বারই জেল থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন নটবর লাল। ১৯৯৬ সালে যখন শেষবারের মতো গ্রেফতার হন নটবর লাল, সেই সময়ে তার বয়স ছিল ৮৪ বছর।

কানপুর জেলে চলার ক্ষমতা হারানো নটবর লালের সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল হুইল চেয়ার। তাকে দিল্লির এইমস-এ ভর্তি করার নির্দেশ দেন আদালত। কানপুর থেকে ট্রেনে করে নটবর লালকে দিল্লিতে নিয়ে এসে ট্রেন থেকে নামিয়ে আবার হুইল চেয়ারে বসানো হয়। জেল পুলিশরা রেল পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে বলতে পেছন ঘুরে দেখে হুইল চেয়ার ফাঁকা। নটবর লাল উধাও। দিনটি ছিল ১৯৯৬ সালের ২৪ জুন। সেই শেষবারের মতো তাকে দেখতে পেয়েছিল পুলিশ। তারপর আর তার সন্ধান পাওয়া যায়নি।

আজো বাঙ্গরা গ্রামের অধিবাসীরা তাকে ভগবান মানেন। তাকে শুধু ‘নটবর লাল’ বলা যাবে না। বলতে হবে ‘মিস্টার নটবর লাল’ বা ‘মিথিলেস বাবু’। গ্রামের লোকেরা আজো বলেন, গরিবদের লুটে যারা বড়লোক হয়েছিল, তাদের লুটে মিথিলেশ বাবু সেই টাকা আবার গরিবদের ফিরিয়ে দিতেন। আশির দশকে তিনটি গাড়ির কনভয় নিয়ে শেষবার গ্রামে গিয়েছিলেন নটবর লাল। সামিয়ানা টাঙিয়ে সারা গ্রামের জন্য বিশাল ভূরিভোজের ব্যবস্থা করেছিলেন।

খাওয়ার পর গ্রামবাসীদের প্রত্যেককে একশ’ করে টাকা দিয়েছিলেন। পুলিশ জানতেই পারেনি। ২০০৯ সালে নটবর লালের উকিল আদালতে জানান, জুলাই মাসের ২৫ তারিখে নটবর লাল মারা গেছেন। কিন্তু নটবর লালের ভাই গঙ্গাপ্রসাদ সংবাদ মাধ্যমকে জানান, দিল্লি স্টেশন থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর, ওই বছরই নটবর লাল রাঁচিতে মারা গেছেন। নিজের মৃত্যুর ওপরও নিজের স্টাইলেই রহস্যের পর্দা বিছিয়ে গেছেন প্রতারক নটবর লাল।

নয়া শতাব্দী/এম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ