ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

যে যুদ্ধের সূচনা কুকুরের কারণে!

প্রকাশনার সময়: ১৭ নভেম্বর ২০২১, ২২:২৮

রাজনৈতিক আধিপত্য, দেশ দখল ও সম্পত্তি লুটের জন্য আদিকাল থেকেই দেশে দেশে যুদ্ধের চর্চা হয়ে আসছে। তবে, মাত্র একটি কুকুরের কারণে যুদ্ধ বেঁধেছিল ইউরোপের দুই দেশ গ্রিস ও বুলগেরিয়ার মধ্যে।

এ দুটি দেশই একসময় অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। সময়ের পরিবর্তনে একসময় তারা একে অপরের শত্রুতে পরিণত হয়। বুলগেরিয়া যখন অটোমানদের থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, তখন সীমানা নিয়ে বেশ বড় ধরনের বিতর্ক শুরু হয়। মেসিডোনিয়া ও পশ্চিম থ্রেসের ওপর দুই দেশই নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, একে অপরকে কেউই সামান্য ছাড় দিতে রাজি ছিল না।

সীমানা নিয়ে ঝামেলার কারণে দুই দেশের মধ্যে গেরিলা কায়দায় ছোট ছোট সংঘর্ষ হতে থাকে, যেটি পরবর্তীতে দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধে রূপ নেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে বুলগেরিয়া জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরির সমন্বয়ে গঠিত অক্ষশক্তিতে যোগ দিয়ে সার্বিয়ায় হামলা চালায়। অন্যদিকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকার নেতৃত্বে গঠিত হওয়া মিত্রশক্তির পক্ষে থাকে গ্রিস। এ যুদ্ধে মিত্র শক্তি জয়ী হওয়ায় গ্রিসকে পুরস্কার হিসেবে পশ্চিম থ্রেসের বিশাল অংশের ওপর রাষ্ট্রীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেয়া হয়।

তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও দুই পক্ষ পরস্পরের বিপরীত অবস্থান নেয়। গ্রিস ঠিক করে তারা ইংল্যান্ড, আমেরিকা এবং ফ্রান্সের মিত্র শক্তিতে যোগ দেবে। পাল্টা বুলগেরিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জার্মানি ইতালির সঙ্গে হাত মিলিয়ে অক্ষশক্তির হয়ে যুদ্ধ করার। গ্রিস প্রথমে মিত্র শক্তিতে যোগ দিয়েছিল বলেই বুলগেরিয়া অক্ষশক্তিতে শামিল হয়েছিল।

এই যুদ্ধেও বুলগেরিয়ার অক্ষশক্তি পরাজিত হয়। যুদ্ধগুলোতে বুলগেরিয়ার পরাজয়ে সেদেশের জনগণ ও সেনাবাহিনী রীতিমতো ফুঁসছিল। যে কোনো মূল্যে যেন বুলগেরিয়ান সরকার এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয় চারদিক থেকে সেই চাপ আসতে থাকে। বুলগেরিয়ার জনগণ এতটাই ক্ষুব্ধ ছিল যে, দেশটির প্রধানমন্ত্রী আলেক্সান্দার স্ট্যামবোলিস্কি যখন গ্রিস ও প্রতিবেশী অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করার চেষ্টা চালান, তখন তাকে ক্ষমতা থেকে সরাসরি উৎখাত করা হয়। এসব কারণে গ্রিসের সঙ্গে বুলগেরিয়ার সম্পর্ক একেবারে তলানিতে এসে ঠেকে, যে কোনো সময় যুদ্ধ লেগে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তখন শুধু এমন একটি ঘটনার দরকার ছিল, যেটার দোহাই দিয়ে যে কোনো পক্ষ তার বিপরীত পক্ষের ওপর হামলা চালাবে।

ঠিক সে সময় ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর গ্রিস-বুলগেরিয়ান সীমান্তে কুকুর নিয়ে টহল দিচ্ছিল একজন গ্রিক সীমান্তরক্ষী। হঠাৎ তার হাত থেকে ছুটে গিয়ে কুকুরটি বুলগেরিয়ান সীমান্তে ঢুকে পড়ে। ওই সৈন্য কোনো কিছু চিন্তা-ভাবনা না করেই কুকুরটিকে ফেরত আনতে বুলগেরিয়ান সীমান্তে প্রবেশ করেন। এতে বুলগেরিয়ার সৈন্যরা সঙ্গে সঙ্গেই গ্রিস সৈন্যকে গুলি করে হত্যা করে। গ্রিসের সৈন্যরা এই ঘটনা জানতে পেরে তাদের সহকর্মীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পাল্টা হামলা শুরু করে এবং বুলগেরিয়ান সীমান্তরক্ষী সৈন্যরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। সংঘর্ষের মধ্যেই গ্রিসের সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন ও তার সহকারী পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য সাদা পতাকা হাতে সীমান্তের নোম্যান্স ল্যান্ডে গিয়ে আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন।

কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সমস্ত রীতি-নীতি লঙ্ঘন করে বুলগেরিয়ার সেনারা তাদেরকেও হত্যা করে। এরপরই ব্যাপক ক্ষিপ্ত হয়ে যায় গ্রিসের স্বৈরশাসক প্যাঙ্গোলাস। তিনি বুলগেরিয়াকে চিঠি দিয়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দুই লাখ ইউরো ক্ষতিপূরণ, প্রকাশ্যে এই ঘটনার জন্য বুলগেরিয়ার ক্ষমা প্রার্থনা এবং যে সমস্ত সেনা এই ঘটনায় জড়িত ছিল তাদের মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানান। বুলগেরিয়ার সরকার গ্রিসের এই সমস্ত দাবির একটিও পূরণ করেনি। এর ফলে ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা পেরিয়ে যেতেই গ্রিস সেনাবাহিনী বুলগেরিয়ায় প্রবেশ করে। তারা দ্রুত সেখানকার বেশকিছু শহর দখল করে নেয়। এই ঘটনায় বুলগেরিয়ার সেনা এবং সাধারণ মানুষ মিলে ১০০ জনের মৃত্যু ঘটে। গ্রিসের খুব একটা ক্ষতি হয়নি।

ওই সময় দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে তুরস্কের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে হেরে যাওয়ার ফলে গ্রিসের আর্থিক পরিস্থিতি খুব একটা ভালো ছিল না। তাই তাদের পক্ষে বুলগেরিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ চালানো একরকম অসম্ভব ছিল। এই পরিস্থিতিতে বুলগেরিয়া জাতিসংঘের সাহায্য প্রার্থনা করলে পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নেয়। জাতিসংঘ গ্রিসকে নির্দেশ দেয় তারা যেন অবিলম্বে বুলগেরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহার করে, না হলে সেখানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনী পাঠানো হবে।

এর ফলে গ্রিস দ্রুত বুলগেরিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। পরে বুলগেরিয়ার কাছ থেকে মাত্র ৪৫ হাজার ইউরো ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পেরেছিল গ্রিস। এই যুদ্ধের নির্দিষ্ট পরিণতি না ঘটলেও এর কারণেই গ্রিসের স্বৈরশাসক প্যাঙ্গোলাসকে ক্ষমতা হারাতে হয়েছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত কারণে শুরু হওয়া যুদ্ধগুলোর মধ্যে বুলগেরিয়া ও গ্রিসের এ যুদ্ধ অবশ্যই প্রথম সারিতে থাকবে।

নয়া শতাব্দী/এম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ