করোনাভাইরাসের অজুহাতে সম্প্রতি বিশ্ববাজারে দাম বাড়ে জ্বালানি তেলের। একই অজুহাতে ডিজেল ও কেরোসিন তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। ডিজেলের দাম এক লাফে বেড়েছে লিটারপ্রতি ১৫ টাকা। একই সময়ে ভারত ও পাকিস্তানে জ্বালানি তেলের দামও ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের থেকেও ডিজেলের দাম লিটারে ৪৪ টাকা বেশি ভারতে। পাকিস্তানেও বাংলাদেশের তুলনায় দাম বেশি।
তবে ওই দুই দেশে বাড়েনি বাস ভাড়া। ঠিক উল্টো চিত্র বাংলাদেশে। প্রতিবেশী দুই দেশের তুলনায় বাংলাদেশে তেলের দাম কম থাকলেও বাস ভাড়া বেশি। বাংলাদেশের দূরপাল্লার বাসের ভাড়ার সঙ্গে ওই দুই দেশের অবস্থান, চলাচলকারী বাসের মান ও ভাড়ার পরিমাণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এমন পার্থক্য।
জানা গেছে, দাম বাড়লেও ভারত ও পাকিস্তানে আগের ভাড়ায় চলাচল করছে জনগণ। হয়নি কোনো পরিবহন ধর্মঘট। তবে বাংলাদেশে জনগণকে জিম্মি করে বাস ভাড়া বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। দূরপাল্লার বাসে ২৭ শতাংশ ও রাজধানীতে ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ। ভাড়া বাড়ানোর এমন ঘোষণার পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
কেউ কেউ বলছেন, তেলের দাম পুষিয়ে নিতে ভাড়া বৃদ্ধি করে এই বাড়তি বোঝা জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে সরকার। শেষ পর্যন্ত তেল ব্যবসায়ী ও পরিবহন মালিক শ্রমিকদের জয় হলো। এ ছাড়া যেখানে বাসের ভাড়া ২-৩ টাকা বাড়ালেই ডিজেলের অতিরিক্ত দাম উঠে যেত সেখানে এখন অন্তত ১০ টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে।
পণ্য ও গণপরিবহন মালিক সমিতির সূত্র বলছে, বর্তমানে পণ্য পরিবহন খাতে তিন লাখ ৫১ হাজার ৭৩টি নিবন্ধিত গাড়ি আছে। এর মধ্যে বাস ও মিনিবাস রয়েছে ৭৮ হাজার। এসবের মধ্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছাড়া দূরপাল্লার বাসের ৬০ শতাংশ গ্যাসে চলাচল করে। আর রাজধানীর প্রায় ৯৫ শতাংশ বাসই চলে কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস (সিএনজি) বা লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাসে (এলপিজি)। যদিও ভাড়া বাড়ানোর দাবির ক্ষেত্রে এসবের কিছুই আমলে নেননি পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, গত ৩ নভেম্বর কলকাতায় ডিজেলের মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১০১ দশমিক ১৫ রুপি। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২৪ টাকা। বাংলাদেশের তুলনায় দেশটিতে ডিজেলের দাম লিটারে ৪৪ টাকা বেশি থাকলেও সে দেশে বাড়ানো হয়নি কোনো ভাড়া। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানেও বাংলাদেশের তুলনায় তেলের দাম বেশি। পাকিস্তানে ডিজেলের দাম ৮ দশমিক ১৪ রুপি বেড়ে হয়েছে ১৪২ দশমিক ৬২ রুপি। তবে ওই দুটি দেশে ডিজেলের দাম বাড়লেও বাড়েনি গণপরিবহনের ভাড়া।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভারতের কলকাতা থেকে পুরির সড়ক পথের দূরত্ব প্রায় ৫০০ কিলোমিটার। ওই পথে চলাচলকারী গ্রিনলাইন, প্রধান ট্রাভেলস ও শ্যামলী পরিবহন (প্রা.) লি. ভলভো বি-১১আর মডেলের বাস দিয়ে সেবা দিয়ে থাকে। ৪৫ সিট বিশিষ্ট বাস কোম্পানিগুলো এই দূরত্বে ভাড়া নেয় সাড়ে ৯০০ থেকে এক হাজার রুপি। অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় প্রায় এক হাজার ১০০ টাকা।
বাংলাদেশ সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের তথ্যমতে, ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব ২৪২ কিলোমিটার। এই পথে চলাচলকারী অধিকাংশ এসি কোম্পানি হুন্দাই, স্ক্যানিয়া ও ভলভো বি-৯আর ব্র্যান্ডের বাস দিয়ে সার্ভিস দিয়ে থাকে। তারা বিজনেস ক্লাস (২৮ সিট) বাসের ভাড়া নিচ্ছে এক হাজার ২০০ টাকা। এসি ইকোনমি ক্লাস (৪০ সিট) ভাড়া নেয়া হচ্ছে ৮০০ টাকা। যদিও ইকোনমি ক্লাসের বাসগুলো ভারতের অশোক লিল্যান্ড বা হিনো আর এম-২ মডেলের বাস দিয়ে সেবা দিয়ে থাকে। আর একই পথে গ্রিনলাইন পরিবহন দোতলা বাসের প্রতি সিটের জন্য ভাড়া নিচ্ছে এক হাজার ৪০০ টাকা।
অন্যদিকে, পাকিস্তানের লাহোর থেকে রাওয়ালপিন্ডির দূরত্ব ৩৮০ কিলোমিটার। এই রুটে চলাচলকারী রোডমাস্টার ট্রাভেলস এর ৩১ সিটের বিজনেস ক্লাস এসি বাসের ভাড়া দুই হাজার ৯৬০ রুপি। বাংলাদেশি টাকায় প্রায় এক হাজার ৪৯৩ টাকা। আর ঢাকা থেকে বগুড়ার দূরত্ব ১৯৭ কিলোমিটার। এ পথে চলাচলকারী নাবিল পরিবহনের স্ক্যানিয়া মালি এক্সেল (২৮ সিট) বিজনেস ক্লাস বাসের ভাড়া এক হাজার ২০০ টাকা।
একইভাবে ভারতের মুম্বাই থেকে কাশ্মীর গেটের দূরত্ব এক হাজার ৪২৯ কিলোমিটার। ওই পথে চলাচলকারী হানস ট্রাভেলসের এসি স্লিপার বাসের ভাড়া ভারতীয় রুপিতে তিন হাজার টাকা। ভলভো কোম্পানির ৩২ সিট বিশিষ্ট ওই বাসের বাংলাদেশি মুদ্রায় ভাড়া তিন হাজার ৪৬৮ টাকা। একই পথে চলাচলকারী রাজ ট্রাভেলেসের ৩৬ সিটের স্লিপারের ভাড়া দুই হাজার ৯৫০ রুপি। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৩ হাজার ৪১০ টাকা।
এদিকে, বাংলাদেশে ঢাকা থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব প্রায় ৪০০ কিলোমিটার। এই রুটে চলাচলকারী সবচেয়ে বিলাসবহুল বাস হিসেবে ধরা হয় গ্রিনলাইন পরিবহনের স্ক্যানিয়া ব্র্যান্ডের স্লিপার কোচকে। এই বাসে জনপ্রতি ভাড়া নেয়া হয় দুই হাজার ৫০০ টাকা। সেবা ও মানের দিক থেকে ভারতের ওই বাসের থেকে কিছুটা এগিয়ে গ্রিনলাইন। তবুও ভারতের তুলনায় ওই পথের ব্যবধান যেখানে এক হাজার কিলোমিটারের কম, ভাড়ার ব্যবধান সেখানে কমেছে মাত্র ৯০০ টাকা।
কলকাতা থেকে শিলিগুড়ির দূরত্ব সাড়ে ৫০০ কিলোমিটারের বেশি। ওই রুটে চলাচলকারী শ্যামলী পরিবহনের ৪১ সিট বিশিষ্ট ভলভো বি-১১আর মডেলের মাল্টি এক্সেল বাসের ভাড়া এক হাজার ১৯৫ রুপি। যা বাংলাদেশের মুদ্রায় প্রায় এক হাজার ৩৫০ টাকা। আর গ্রিনলাইন পরিবহনের ৪৫ সিটের ভলভো বি-১১আর মডেলের মাল্টি এক্সেল বাসের ভাড়া এক হাজার রুপি। বাংলাদেশের মুদ্রায় যার পরিমাণ সাড়ে এক হাজার ১০০ টাকা।
অন্যদিকে, ঢাকা থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব প্রায় ৪০০ কিলোমিটার। কলকাতা-শিলিগুড়ির তুলনায় প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার দূরত্ব কম থাকলেও ঢাকা-কক্সবাজার রুটে চলাচলকারী শ্যামলী পরিবহনের ইকোনমি ক্লাসের (৪১ সিট) ভাড়া নেয়া হয় এক হাজার ২০০ টাকা। তারা অধিকাংশ সময়ই হিনো আরএম-২ বাস দিয়ে সেবা দিয়ে থাকে। আর প্রায় সমান সুবিধা দিয়ে গ্রিনলাইন পরিবহন ভাড়া নিচ্ছে এক হাজার ৪০০ টাকা। শুধু তাই নয়, হিনো-অচল বাসকে এসিতে রূপান্তরিত করে উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে সেবা দিয়ে নাবিল পরিবহন ভাড়া নিচ্ছে এক হাজার ১০০ টাকা।
পাকিস্তানের লাহোর থেকে করাচির দূরত্ব এক হাজার ২০০ কিলোমিটার। ওই পথে চলাচলকারী ডেইয়ো এক্সপ্রেসের বিজনেস ক্লাসের (এসি) ভাড়া দুই হাজার ৩২০ টাকা। আর ঢাকা থেকে রাঙামাটির পথে চলাচলকারী শ্যামলী পরিবহন ও সেন্টমার্টিন হুন্দাই (রবি এক্সপ্রেস)-এর বিজনেস ক্লাসের ভাড়া এক হাজার ৬০০ টাকা। যদিও ওই পথের দূরত্ব মাত্র ২৯২ কিলোমিটার। দূরত্ব ৯০০ কিলোমিটার বেশি হলেও ভাড়ার ব্যবধান মাত্র ৫০০ টাকা।
ভারতের দিল্লি থেকে মানালির দূরত্ব সাড়ে ৫০০ কিলোমিটার। সম্প্রতি দিল্লি থেকে মানালি ঘুরতে গিয়েছিলেন পাঁচ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। গত রোববার তারা আবার দিল্লিতে ফিরে এসেছেন। এদের মধ্যে একজন আহসান হাবীব রেদোয়ান জানান, ওই রুটে ভলভোর ইকোনমি ক্লাসের বাস চলাচল করে। আসা-যাওয়ায় বাংলাদেশি মুদ্রায় তাদের ভাড়া লেগেছে সাড়ে এক হাজার ২০০ টাকার মতো। বাসের অবস্থা সম্পর্কেও স্বস্তি প্রকাশ করেন তিনি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান নয়া শতাব্দীকে বলেন, বাসের বিকল্প কোনো বাহন নেই দেশে। বাসের বিকল্প যানবাহন না থাকায় আধিপত্য বেশি বাস মালিক-শ্রমিকদের। তারা দাবি আদায় করতে জনগণকে জিম্মি করতে পারে। তিনি বলেন, রাজধানীসহ দূরের গন্তব্যে বাসই একমাত্র ভরসা। দূরের যাত্রায় ট্রেন থাকলেও যাত্রী তুলনায় আসন একেবারেই কম। দেখা যাচ্ছে দু-তিন দিন আগেও অনেক রুটে ট্রেনের টিকিট পাওয়া যায় না। তবে চাইলেই বাসের টিকিট মেলে। ফলে বিকল্প কোনো বাহন না থাকায় যাত্রীরা জিম্মি হয়ে যায়।
ভারত-পাকিস্তানের তুলনা দিয়ে মো. হাদিউজ্জামান আরো বলেন, পাকিস্তানে ৮০ বছর আগে থেকে করাচি শহরে সার্কুলার রেল সেবা চালু হয়েছে। ভারতে প্রায় ২০০ বছর আগে সার্কুলার রেল চালু হয়েছে। সেখানে, ট্যাক্সি, ট্রাম এবং মেট্রোরেল আছে। এ ছাড়া ভারতে দূরের যাত্রায় ট্রেনই সবাই পছন্দ করেন। ফলে বাস মালিকরা চাইলেও যাত্রীদের জিম্মি করতে পারে না। তাই বিকল্প বাহনের ওপর এখন থেকেই জোর দিতে হবে। যাতে জনগণকে জিম্মি না করতে পারে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। তিনি বলেন, আমাদের দেশে যদি সার্কুলার রেল থাকত, এমআরটি বা বিআরটি যদি থাকত তখন একটা প্রতিযোগিতা আসত। তাহলে ভাড়া নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত। এ সময় দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ছে জানিয়ে জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বিদ্যুতে চলে এমন বাহনের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। বিকল্প বাহন হিসেবে ইলেক্ট্রিক্যাল বাসের প্রচলন আমরা করতে পারি। এতে খরচ অনেক কম, ভাড়াও কম থাকবে। আমরা ইতোমধ্যে ইলেক্ট্রিক্যাল বাইক তৈরি করছি। ফলে আমরা ইলেক্ট্রিক্যাল বাস তৈরিতেও সক্ষম। ইলেকট্রিক্যাল বাসের প্রচলন করতে পারলে এই সেক্টরে দ্রুতই শৃঙ্খলা ফিরবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, গত দুই বছরে ডিজেলসহ অন্যান্য খরচ ও পরিচালন ব্যয় যতটা বেড়েছে, সে তুলনায় ভাড়া বাড়ানো হয়নি। তবুও যতটুকু করা হয়েছে তাতে খরচ কিছুটা উঠবে। এতে যাত্রীদের ওপর চাপ হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ