গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানীতে ইরানি কনস্যুলেটে হামলার জবাবে ১৩ এপ্রিল (শনিবার) ইসরায়েলে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। হামলার জবাবে পাল্টা হামলা। এখন প্রশ্ন—এরপর কী পদক্ষেপ নেবে ইসরায়েল?
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ১৩ এপ্রিল হামলা চালানোর ক্ষেত্রে ইরান ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর যথেষ্ট চেষ্টা করেছে। তারা আসলে উত্তেজনা বাড়ুক তা চায় না। তবে ইসরায়েল এখন পাল্টা হামলা চালালে বিপদ তৈরি হবে।
গত ১ এপ্রিল দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে হামলার পর তেহরান বলেছিল, এটি তাদের ভূখণ্ডে হামলা চালানোর শামিল। ইরান তখন ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের কথা উল্লেখ করে বলে যে, কোনো কূটনৈতিক এলাকা, দূতাবাস ও কনস্যুলেটে কারও হামলা চালানো উচিত নয়।
তবে ইরান কিংবা ইরানি স্থাপনাকে হামলার লক্ষ্যবস্তু করাকে বৈধ বলে দাবি করে থাকে ইসরায়েল।
দামেস্কে কনস্যুলেটে হামলার ১৩ দিন পর পাল্টা হামলা চালায় ইরান। শনিবার তারা ইসরায়েল অভিমুখে বেশ কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। দেশটির দাবি, জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী এ হামলা সম্পূর্ণ বৈধ। জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের কোনো সদস্যরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র হামলা হলে, ওই রাষ্ট্র যদি ব্যক্তিগত বা সম্মিলিত আত্মরক্ষার সহজাত অধিকার চর্চা করতে চায়, তবে তা ক্ষুণ্ন করা যাবে না।
এ বিষয়ে র্যান্ডস প্রজেক্ট এয়ার ফোর্সের কৌশল এবং পরামর্শ কর্মসূচিবিষয়ক পরিচালক কোহেন বলেন, ইসরায়েল আগে থেকেই মনে করে ইরানের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ চলছে। কারণ, তারা বিশ্বাস করে গাজায় হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়, তহবিল জোগানো ও অস্ত্রশস্ত্র দেয় ইরান।
কোহেনের মতে, ১৩ এপ্রিলের হামলার মধ্য দিয়ে ইরান ইসরায়েলকে দেখিয়ে দিয়েছে যে, তারা সরাসরি হামলা চালাতে পারে। এ হামলার পর ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়েও ইসরায়েলের উদ্বেগ বাড়বে।
এখন ইসরায়েল পাল্টা জবাব দেবে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে কোহেন বলেন, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জোট জবাব দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে।
ইসরায়েলে ইরানের হামলার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক সংক্ষিপ্ত পোস্টে নেতানিয়াহু বলেন, ‘আমরা প্রতিহত করেছি, হটিয়ে দিয়েছি, একসঙ্গে আমরা জয়ী হবো।’
আল–জাজিরার কূটনীতিক সম্পাদক জেমস বেইস মনে করেন, দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে হামলার পর এখন পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে, তাতে একটি চক্র পূর্ণ হয়েছে। অর্থাৎ হামলা হয়েছে, পাল্টা হামলা হয়েছে।
তার মতে, এখন এ চক্র শেষ হওয়ার পরে নতুন করে হামলার ঘটনা ঘটলে অর্থাৎ ইসরায়েল যদি আবারও হামলা চালায়, তাতে বিপদ নেমে আসবে।
এদিকে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেস (ইউসিএলএ) স্কুল অব ল-এর আইন ও বৈশ্বিক অধ্যয়নবিষয়ক প্রভাষক বেঞ্জামিন রাড মনে করেন, হামলায় হতাহতের সংখ্যা যেন কম হয়, তা মাথায় রেখেই হামলার লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করেছে ইরান।
দ্য স্ট্রেট টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই আইনবিদ বলেন, বেসামরিক লোকসমাগমের কেন্দ্রগুলোকে লক্ষ্যবস্তু না করে সামরিক স্থাপনাকে লক্ষ্যবস্তু করার মধ্য দিয়ে ইঙ্গিত মিলেছে যে, ইরান চায় না উত্তেজনা আর বাড়ুক। তারা কেবল দামেস্কে তাদের দূতাবাস প্রাঙ্গণে হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দেশের ভেতরে যে চাপের মধ্যে ছিল, তা থামাতে এমন পদক্ষেপ নিয়েছে।
এদিকে, গাজা উপত্যকায় চলমান হামলাকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় কথা বলতে দেখা গেছে। তবে মার্কিন বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এ টানাপোড়েন সত্ত্বেও ইরানের হামলার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল একযোগে কাজ করবে।
বেঞ্জামিন রাড মনে করেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে সহযোগিতা করতে পারে। তারা ইসরায়েলকে ক্ষয়ক্ষতি মূল্যায়নে সহযোগিতা করতে পারে। এসব হামলা চালানোর ক্ষেত্রে ইরানের সক্ষমতা কমিয়ে দিতে আঞ্চলিক মিত্রদের সঙ্গে কাজ করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। ক্ষেপণাস্ত্রসহ ইরানের বিভিন্ন তৎপরতা শনাক্ত, ইরানকে নিজেদের আকাশসীমা ব্যবহার করতে না দেওয়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আঞ্চলিক মিত্রদের সহযোগিতা চাওয়া হতে পারে।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার এই প্রভাষকের মতে, যুক্তরাষ্ট্র এখন ইরানকে বারবার একটি কথা মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে যে, নতুন করে কোনো উত্তেজনা তৈরি করলে তা বড় ধরনের সংঘাতে রূপ নেবে। আর সে সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্য মিত্রদেশগুলোও জড়িয়ে পড়বে।
এমন প্রেক্ষিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইতোমধ্যেই ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ইসরায়েলে ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কড়া নিন্দা জানিয়ে এক বিবৃতিতে বাইডেন বলেন, প্রায় সব ধরনের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে ইসরায়েলকে সহায়তা করার জন্য মার্কিন বাহিনী ওই অঞ্চলে রয়েছে। মিত্রদের সুরক্ষার জন্য ওয়াশিংটন দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে বলেও জানান বাইডেন।
বাইডেনের এ বিবৃতি প্রসঙ্গে বেঞ্জামিন রাড বলেন, ইরানের যেকোনো হুমকি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে কাজ করবে এবং যেকোনো আগ্রাসন মোকাবিলায় ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করবে। এসব সহযোগিতার মধ্যে থাকতে পারে ইরানি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ বিমান ব্যবহার করা, অস্ত্র ও গোলাবারুদের মতো সামরিক সহায়তা বাড়িয়ে দেওয়া এবং গোয়েন্দা সহযোগিতা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরানের জবাবের পাল্টা হিসাবে ইসরাইল ইরানে ব্যাপক হামলা চালালে দুদেশের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ লেগে যেতো, যা হয়তো ক্রমান্বয়ে আরেকটি আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের দিকে মোড় নিতে পারতো- যে পরিস্থিতি কেউই চাইছিলো না এ মুহূর্তে। না ইসরায়েল, না ইরান, না পরাশক্তিধর দেশগুলো, কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। কেউই না।
তবে ইরানি হামলায় যদি ইসরায়েলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হতো তাহলে ইসরাইল চাইলেও নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারতো না। কারণ ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নেতানিয়াহুর ভাবমর্যাদা ঠেকাতে ইরানে হামলা করা ছাড়া কোনো পথ থাকতো না নেতানিয়াহুর হাতে। ফলে কম ক্ষয়ক্ষতি সম্পন্ন একটি সীমিত আকারের হামলা সবগুলো পক্ষের জন্যই সন্তোষজনক। কূটনীতির ভাষায়, উইন-উইন সিচুয়েশন ছিলো।
তথ্যসূত্র: আল–জাজিরা, দ্য স্ট্রেট টাইমস
নয়াশতাব্দী/এনএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ