ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
জলবায়ু পরিবর্তন

প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকিতে ঢাকাসহ এশিয়ার ১০ বৃহৎ নগরী

প্রকাশনার সময়: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২২:২৭

পৃথিবীর উপকূলীয় অঞ্চলকে প্লাবিত করার ঝুঁকি নিয়ে হাজির হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। নোনা জলের অনুপ্রবেশ, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় পানি নিঃসরণে বাধাসহ সামুদ্রিক ঝড় ও অতিবৃষ্টির কারণে নিমজ্জিত হতে পারে বিস্তীর্ণ জনপদ। দিনে দিনে স্পষ্ট হচ্ছে কোন শহরগুলো সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে।

জাতিসংঘের জলবায়ু প্যানেল (আইপিসিসি) সম্প্রতি ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ব্যাপারে সতর্ক করেছে। বিশ্ব সংস্থাটির বিজ্ঞানীদের মতে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো কিছু পরিবর্তন হচ্ছে স্থায়ীভাবেই, যা এখন থেকে চেষ্টা করলেও আগামী শতকের আগে আর কমানো সম্ভব নয়।

জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতারেজ আইপিসিসি'র এ প্রতিবেদনকে সমগ্র মানবজাতির জন্য চরম বিপদ সংকেত বলে অভিহিত করেন।

আসছে দশকগুলোয় জলাবদ্ধতা ও ব্যাপক বন্যার শিকার হবে, এমন উপকূলীয় শহরের অধিকাংশই অবস্থিত এশিয়ায়। জনবহুল এসব মহানগরী আবার অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র। শীর্ষ জলবায়ু বিজ্ঞানীদের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ভারত ও চীনের প্রধান বন্দর নগরীও রয়েছে এ তালিকায়।

অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি), জলবায়ু ঝুঁকি নিরূপক ফার্ম আরএমএস অ্যান্ড টিন্ডাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট রিসার্চসহ বেশ কিছু সংস্থার বিজ্ঞানীরা এজন্য চারটি প্রধান অনুঘটককে দায়ী করেছেন। এগুলো হলো; জলবায়ু সংকটের তীব্রতা বৃদ্ধি, মানবিক কর্মকান্ডে ক্রমাগত ভূমি ধসে যাওয়া, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং গ্রামীণ জনপদ থেকে শহরমুখী অভিবাসন বৃদ্ধি।

এ বাস্তবতায় আলোচিত গবেষক সংস্থাগুলোর তথ্যানুসারে, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ ২০৭০ সালের মধ্যেই এশিয়ার যে ১০টি বড় ও জনবহুল নগর প্লাবিত হবে তাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো; ১. ঢাকা, বাংলাদেশ

দেশের সবচেয়ে জনবহুল নগরী ঢাকায় প্রায় ২ কোটি ১৭ লাখ মানুষের বসবাস। ঢাকার অদূরেই রাজবাড়ীতে মিলেছে দেশের বৃহৎ দুই নদী পদ্মা ও যমুনা, বড় দুই নদীর অববাহিকায় অবস্থিত হওয়ায় বন্যার ঝুঁকিও বেশি। মহানগরীর এলাকাতেও রয়েছে আরও চার নদী- বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যা।

চারপাশে বিস্তীর্ণ প্লাবনভূমি ঘিরে রেখেছে ঢাকাকে। অথচ ব্যাপক শিল্পায়িত ঢাকা, দেশের অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র। এখানে গড়ে উঠেছে পোশাক, ওষুধ, রাসায়নিক ও ইলেকট্রনিক্স উৎপাদনের মতো গুরুত্বপূর্ণ অনেক শিল্প।

গবেষণা সংস্থাগুলোর নিজস্ব হিসাবে, ২০২১ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৪ হাজার জন। বন্যার ঝুঁকিতে থাকা জনসংখ্যা এক কোটি ১১ লাখ ৪০ হাজার। ২০৭০ সাল নাগাদ ক্ষতির সম্মুখীন হবে প্রায় ৫৪৪ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ।

২. কলকাতা, ভারত

ভারতের বাংলাভাষী অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা ভারতের সপ্তম বৃহৎ মহানগর। ব্রিটিশ উপনেবেশিক আমলের অনেক বিখ্যাত স্থাপনা রয়েছে এ নগরীতে। হুগলী নদী তীরবর্তী নিম্ন ভূমিতে অবস্থিত কলকাতা থেকে বঙ্গোপসাগর ১০০ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে। নগরীর এক-তৃতীয়াংশ অধিবাসী বস্তিতে গাদাগাদি করে বসবাস করে। পাট প্রক্রিয়াকরণ ও বস্ত্র উৎপাদন এ শহরের প্রধান শিল্পের মধ্যে অন্যতম।

মোট জনসংখ্যা প্রায় এক কোটি ৪৯ লাখ ৭০ হাজার যার ভেতর বন্যার ঝুঁকিতে আছে এক কোটি ৪০ লাখ মানুষ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ২৪ হাজার জন। প্লাবনের কারণে ক্ষতির শিকার হবে ১,৯৬১ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ।

৩. মুম্বাই, ভারত

ভারতের সবচেয়ে বড় শহর মুম্বাই, পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ও জনবহুল নগরীর একটি। মুম্বাই ভারতের আর্থিক রাজধানী ও প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র। ফলে অর্থনীতির বিচারেও এটি বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর তালিকায় রয়েছে। তিনদিক থেকে আরব উপসাগর বেষ্টিত মুম্বাই এক উপদ্বীপ। তবে নিমজ্জিত অনেক ভূমি পরবর্তীকালে জল-সেচন ও ভূমি ভরাটের মাধ্যমে উদ্ধার করে, সেখানে আবাসিক ও বাণিজ্যিক অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়।

নগরীর মোট জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৬ লাখ ৭০ হাজার। প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৩২ হাজার ৩০০ জন। ঝুঁকিতে থাকা জনসংখ্যা এক কোটি ১৪ লাখ ২০ হাজার। ২০৭০ সাল নাগাদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে ১,৫৯৮ কোটি ডলারের সম্পদ।

৪. ইয়াঙ্গুন, মিয়ানমার

মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় শহর ও বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র। ইয়াঙ্গুন নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত এ নগরী বদ্বীপ ও প্লাবনভূমি দ্বারা বেষ্টিত। দক্ষিণে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরেই আন্দামান সাগর। বৌদ্ধ ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থনাকেন্দ্র শোয়েডাগোন প্যাগোডা টেম্পল কমপ্লেক্স এ শহরেই অবস্থিত।

মোট জনসংখ্যা ৫৪ লাখ ২০ হাজার। প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৮,৭০০ জন। ঝুঁকিতে থাকা জনসংখ্যা ৪৯ লাখ ৭০ হাজার। ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রায় ১৭২ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ।

৫. ব্যাংকক, থাইল্যান্ড

একাধারে থাইল্যান্ডের রাজধানী, সবচেয়ে বড় শহর ও প্রধান বন্দর নগরী ব্যাংকক। একইসঙ্গে, দেশটির বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। থাই অর্থনীতির মোট উৎপাদনের এক তৃতীয়াংশে অবদান রাখে এ নগরী। ব্যাংককের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় দেশের মোট আমানতের তিন-চতুর্থাংশ রয়েছে। জনাকীর্ণ ব্যাংকক চাও ফ্রায়া নদীর বদ্বীপ অঞ্চলে অবস্থিত। ব্যাংকক থেকে থাই উপসাগরের দূরত্ব মাত্র ৪০ কিলোমিটার।

এখানকার মোট জনসংখ্যা প্রায় এক কোটি ৭ লাখ ২০ হাজার। প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৬,১০০ জন। ঝুঁকিতে আছে ৫১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ। বন্যার কারণে ২০৭০ সাল নাগাদ মোট ক্ষতি হবে ১,১১৮ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ।

৬. হাইফং, ভিয়েতনাম

টংকিন উপসাগর থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে লোহিত নদীর বদ্বীপে অবস্থিত হাইফং রাজধানী ভিয়েতনামের প্রধান বন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে প্রযুক্তি খাতসহ বৈশ্বিক কোম্পানিগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে হাইফং। এখানকার স্থানীয় কোম্পানিগুলো ভোক্তাপণ্য, বস্ত্র ও অন্যান্য পণ্য উৎপাদন করে থাকে।

মোট জনসংখ্যা মাত্র ১৩ লাখ ৪০ হাজার, প্রতি কিলোমিটারে বাস করে ১,২৯৯ জন। ঝুঁকিতে থাকা জনসংখ্যা ৪ লাখ ৭০ হাজার। ২০৭০ সাল নাগাদ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ৩৩৪ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ।

৭. হো চি মিন সিটি, ভিয়েতনাম

ভিয়েতনামের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাণপুরুষের নামাঙ্কিত এ শহর আজ বিশ্ববাণিজ্যের অন্যতম অংশ। সায়গন থেকে ভিয়েতনাম যুদ্ধশেষে নাম পরিবর্তন করা হয়। দেশটির সবচেয়ে জনবহুল এ শহর সায়গন নদীর তীরে অবস্থিত, এ নদী দক্ষিণ চীন সাগরে গিয়ে মিশেছে। শহরের উত্তরেই অবস্থিত উর্বর কৃষিজমিতে ভরপূর মেকং নদীর বদ্বীপ অঞ্চল। দেশটির মোট জিডিপি'তে এক-পঞ্চমাংশ অবদান রাখে হো চি মিন সিটি।

মোট জনসংখ্যা ৮০ লাখ ৮৪ হাজার হলেও, ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে, ২০৭০ সাল নাগাদ বন্যার ঝুঁকির মুখে পড়বে ৯০ লাখ ২২ হাজার মানুষ। এতে ৬৫৩ বিলিয়ন ডলারের সম্পদহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে।

৮. গুয়াংজু, চীন

চীনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য নগরীর একটি গুয়াংজু। কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থন ও উৎসাহে; সাম্প্রতিক সময়ে শহরটি একটি বৈশ্বিক প্রযুক্তি কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে উঠেছে। পার্ল নদীর বদ্বীপের সম্মুখভাগে অবস্থিত এ বন্দর নগরী দক্ষিণ চীন সাগর থেকে ১৪৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। চীনের অন্যতম জনাকীর্ণ শহরও গুয়াংজু, পুরো দেশ থেকেই এখানে জীবিকার সন্ধানে আসেন বহু মানুষ।

মোট জনসংখ্যা প্রায় এক কোটি ৩৬ লাখ ৪০ হাজার। প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৫,৩০০ জন। ২০৭০ সাল নাগাদ বন্যা কবলিত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে ১ কোটি ৩ লাখ ৩০ হাজার জন এবং তাতে ৩,৩৫৮ বিলিয়ন ডলারের সম্পদহানি হতে পারে।

৯. সাংহাই, চীন

চীনের সবচেয়ে জনবহুল এ মহানগরী বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর একটি। একাধারে চীনের আর্থিক রাজধানী সাংহাই এবং দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চল। ২ কোটি ৭০ লাখ জনসংখ্যার সাংহাই আকারে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের চেয়ে আড়াইগুণ বড়। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বন্দরগুলোর মধ্যে যাদের নাম উচ্চারিত হয়, সাঙ্ঘাই রয়েছে সে তালিকায়। এ বন্দর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধানতম কেন্দ্র বলেও পরিচিত।

সাংহাইয়ের অধিকাংশ এলাকা পূর্ব চীন সাগরমুখী এক উপদ্বীপের অংশ। এর একদিকে ইয়াংজি নদী ও আরেকদিকে হুয়াংজু উপসাগর। সমগ্র উপদ্বীপটি সাগরপৃষ্ঠ থেকে গড়ে মাত্র ৩ থেকে ৫ মিটার উচ্চতায় রয়েছে। তবে নিম্ন প্লাবণভূমিও কম নেই।

ফলে মোট দুই কোটি ৭৮ লাখ জনসংখ্যার সাংহাই নগরীর সাড়ে ৫৪ লাখ বাসিন্দা ২০৭০ সাল নাগাদ বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছেন। যার ফলে মোট ১,৭৭১ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ বিনষ্ট হবে।

১০. ​​​​​​​তিয়ানজিন, চীন

উত্তর চীনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ও শিল্পাঞ্চল তিয়ানজিন। পীত সাগরে গিয়ে মেশা হাই নদীর তীরে অবস্থিত। উত্তর চীনের সমভূমির পানি এই নদীর মাধ্যমেই সাগরে নিষ্কাশিত হয়। যেকারণে, দীর্ঘকাল ধরেই নিষ্কাশন ব্যবস্থা সতর্কতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে নগর কর্তৃপক্ষকে। তিয়ানজিন মূলত লৌহ, ইস্পাত, জাহাজ নির্মাণ ও রাসায়নিকের মতো ভারি শিল্প প্রাধান অঞ্চল।

তবে এক কোটি ৩৮ লাখ বাসিন্দার এ নগরীর বন্যার ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। ২০৭০ সাল নাগাদ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ৩৭ লাখ ৯০ হাজার মানুষ। সম্পদের ক্ষতি হবে কমপক্ষে ১,২৩১ কোটি ডলার মূল্যের। সূত্র: সিএনবিসি

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ