ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরীক্ষার হল থেকে তুলে নিয়ে যৌন প্রস্তাব, অতঃপর!

প্রকাশনার সময়: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৫:১৪

ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনলেন প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী। অভিযুক্ত অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয়টির একটি বিভাগের সাবেক প্রধান।

ভুক্তভোগীর অভিযোগ, অধ্যাপক তাকে পরীক্ষার হল থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে পরোক্ষভাবে যৌন চাহিদা মেটানোর প্রস্তাব দেন। কিন্তু সেই প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায়, ছাত্রীর কাছে দুই সিনিয়র ছাত্রের মাধ্যমে সরাসরি ওই প্রস্তাব দেন অভিযুক্ত অধ্যাপক।

ছাত্রীর অভিযোগ, পরীক্ষা শেষে হতেই তার বিভাগের ফাইনাল ইয়ারের দুই ছাত্র তাকে বলেন, ‘‘ভালোভাবে পরের পরীক্ষাগুলো দিতে চাইলে.... স্যারের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হতে হবে। বাকি কোনো অসুবিধা যাতে না হয়, তা আমরা দেখে নেব!’’

এতে রীতিমত হতভম্ব ওই ছাত্রী একটি ই-মেইলের মাধ্যমে ঘটনাটি জানিয়েছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার স্নেহমঞ্জু বসুসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের। ওই ই-মেইল সূত্রে জানা যায়, সেখানে ভুক্তভোগী বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন ঘটনার দিন ও তার আগে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহের ব্যাপারে।

তিনি লিখেছেন, ‘‘আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। আমি জানি না, আমার এরপর কী করা উচিত। কেনো আমার সঙ্গেই এমন হচ্ছে। আমার সম্মান নিয়ে টানাটানি হচ্ছে। আমি শুধুই সুবিচারের আশা করছি।’’

পশ্চিমবঙ্গের একটি গ্রামাঞ্চল থেকে কলকাতা শহরে পড়াশোনা করতে এসেছিলেন ওই ছাত্রী। কলকাতার নামী বিশ্ববিদ্যালয় বলে জানতেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে। তাই অনেক আশা নিয়ে সেখানে এসেছিলেন স্নাতকোত্তর পড়তে।

ভুক্তভোগী লিখেছেন, তিনি কখনও পরীক্ষায় খারাপ ফল করেননি। মাধ্যমিকে ৬০ শতাংশ এবং উচ্চমাধ্যমিকে ৭৫ শতাংশ নম্বর নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। বাংলায় সাম্মানিক স্নাতকও হয়েছেন ৭৪ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়ে। যাদবপুরে ভর্তি পরীক্ষায় ১০০-র মধ্যে ৯০ নম্বর পেয়ে মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। কিন্তু ক্লাস শুরুর পর থেকেই বুঝতে পারছিলেন, গ্রাম থেকে আসা এক ছাত্রীর ভালো নম্বর পাওয়াকে ভালো চোখে দেখেননি ওই অধ্যাপক। মাঝে মধ্যেই সহপাঠীদের সামনে ওই ছাত্রীকে নিয়ে এ বিষয়ে ঠাট্টাও করতেন তিনি। বিষয়টি খারাপ লাগলেও এড়িয়ে যাওয়াই ভালো মনে করেছিলেন ভুক্তভোগী। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনার পর তার মনে হচ্ছে, প্রথম দিন থেকেই তিনি ওই অধ্যাপকের ‘লক্ষ্যবস্তুতে’ পরিণত হন।

ই-মেইলে ওই ছাত্রী লিখেছেন, ঘটনার শুরু গত ১৯ ফেব্রুয়ারি, তার প্রথম বর্ষের প্রথম পরীক্ষার দিন। পরীক্ষার হলে আচমকাই ওই অধ্যাপক সবার সামনে তার নাম ধরে ডাকেন এবং বলেন, তাকে শারীরিকভাবে তল্লাশি নিতে হবে। কারণ তিনি চিরকুটে পরীক্ষার উত্তর লিখে এনেছেন।

ছাত্রীর কথায়, ‘‘পরীক্ষার হলে আমার পুরুষ সহপাঠীরাও ছিল। কিন্তু তাদের সামনে আর কোনো মেয়ে সহপাঠীকে এমন তল্লাশির কথা বলা হয়নি। শুধু আমাকেই সবার সামনে অস্বস্তিকরভাবে শরীরে হাত দিয়ে তল্লাশি করা হয়। ঘটনাটা আমার কাছে অপমানজনক লাগছিল। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। কারণ, ওই অধ্যাপক বলেছিলেন, হয় তল্লাশি করতে দিতে হবে, নয়তো পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।’’

ওই ঘটনায় অবশ্য কোনো চিরকুট ছাত্রীর থেকে পাওয়া যায়নি। সে দিনের মতো পরীক্ষা দিতে পারেন তিনি। কিন্তু তার পর আবার ধাক্কা খান পরের পরীক্ষার দিন।

২১ ফেব্রুয়ারি ছিল তার প্রথম বর্ষের প্রথম সেমিস্টারের দ্বিতীয় পরীক্ষা। ছাত্রী জানান, প্রায় দেড় ঘণ্টা পরীক্ষা দেওয়ার পর হঠাৎই পরীক্ষার হলে যিনি গার্ড (একই বিভাগের একজন গবেষণার ছাত্রী) দিচ্ছিলেন, তিনি তার নাম ধরে ডেকে বলেন, তাকে ওই অধ্যাপকের ঘরে ডেকে পাঠানো হয়েছে। অগত্যা পরীক্ষা ছেড়ে তাকে নিয়ে অধ্যাপকের ঘরের বাইরে আসেন ওই গার্ড। নিজে বাইরে দাঁড়িয়ে তিনি ওই ছাত্রীকে ঘরের ভেতরে যেতে বলেন।

ছাত্রী লিখেছেন, অধ্যাপক তাকে দেখে প্রথমেই তার হাত শক্ত করে ধরে ঘরের মধ্যে টেনে আনেন। ছাত্রী প্রায় কান্নাকাটি করেই তাকে অনুরোধ করেন, তাকে পরীক্ষা হলে ফিরে যেতে দেওয়ার জন্য। কিন্তু অধ্যাপক কোনো কথা না শুনে ওই ছাত্রীর হাতের ওপর কিছুটা কালি ঢেলে দিয়ে বলেন, ‘‘তুমি হাতে পরীক্ষার উত্তর লিখে এনেছো।’’

ছাত্রীর কথায়, ‘‘এই অভিযোগ শুনে আমি হতভম্ব হয়ে যাই। আমি তাকে বলি, ‘এই হাতের ছবি আমি তুলে রাখতে চাই, যাতে আপনি যা বলছেন, তার প্রমাণ থাকে আমার কাছে। যেভাবে আমার ওপর শারীরিক নির্যাতন করা হচ্ছে, সে বিষয়ে আমি অভিযোগও জানাতে চাই কর্তৃপক্ষের কাছে’।’’

ছাত্রী জানান, সে কথা শুনেই অধ্যাপক তাকে টেনে এনে তার হাত সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে ধুয়ে দেন এবং বাংলায় তাকে বলেন, ‘‘আমি যা চাইছি, তুমি যদি তা না করো এবং যদি আমার চাহিদা না মেটাও, তবে আমি তোমাকে চিরতরে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেবো।’’

ছাত্রী জানান, এখানেই তার নির্যাতন শেষ হয়নি। ওই অধ্যাপক তাকে এরপর টেনে নিয়ে যান তার বিভাগীয় প্রধানের কাছে। ছাত্রীর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগও করেন। কিন্তু সৌভাগ্যবশত বিভাগীয় প্রধান আস্থা রাখেন ছাত্রীর ওপরেই। তাকে পরীক্ষার হলে যাওয়ার অনুমতিও দেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার পরীক্ষা দেওয়া হয়ে ওঠেনি।

ছাত্রী লিখেছেন, পরীক্ষার হলে তিনি পৌঁছান পরীক্ষার শেষের ঘণ্টা বাজার দু’-তিন মিনিট আগে। তবুও বিধ্বস্ত মনে কলম নিয়ে লিখতেও শুরু করেন তিনি। কিন্তু তাকে আবার বাধা দেন ওই অধ্যাপক। বাধ্য করেন, তার লেখা পরীক্ষার খাতার প্রতিটি পাতায় কাটা চিহ্ন দিতে। আর ওভাবেই পরীক্ষার খাতা জমা দিতে হয় তাকে। কাঁদতে কাঁদতেই হল ছাড়েন তিনি। কিন্তু সামনে এসে দাঁড়ান তারই বিভাগের দুই সিনিয়র ছাত্র।

ই-মেইলে ওই ছাত্রী লিখেছেন, তারাই ওই অধ্যাপকের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার প্রস্তাব দেন তাকে। এমনও বলেন, ওই দিনই ‘অধ্যাপকের সঙ্গে গিয়ে একান্তে দেখা’ করতে হবে। কারণ, যৌন সম্পর্কই ‘অধ্যাপকের রাগ’-এর হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়।

ছাত্রী লিখেছেন, ‘‘আমি বুঝতে পারি অধ্যাপকের কথা বুঝতে না পারায়, তিনি ওই ছাত্রদের দিয়ে তার প্রস্তাব পাঠিয়েছেন আমার কাছে।’’

এর পরেই ওই ছাত্রী বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানাবেন বলে মনস্থ করেন। গোটা ঘটনাটি লেখেন ই-মেইলে। তারপরও ভয়ে কুঁকড়ে রয়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘‘আমি শারীরিক এবং মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। পরীক্ষা চলছে। কিন্তু আমি পড়াশোনা করতে পারছি না। রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে হচ্ছে। এখনও দু’বছর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে পড়াশোনা করতে হবে। আগামী দিনগুলো যে কীভাবে কাটবে, তা ভেবেই আতঙ্কে ভুগছি আমি।’’

এ বিষয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমি ওই ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি এবং সংশ্লিষ্ট জায়গায় বিষয়টি জানিয়েছি। আশা করি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।’’ সূত্র- আনন্দবাজার অনলাইন।

নয়া শতাব্দী/এনএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ