ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ধ্বংসস্তূপের মাঝেও ‘প্রেমের ফুল’ ফোটানো দুই উদ্বাস্তু!

প্রকাশনার সময়: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৯:৫৫
আহমেদ নাছেদ ও তার সঙ্গী আনা রুদনিচেঙ্কো। ছবি- আল জাজিরা।

বর্তমানে ইউরোপ-এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ, সংঘাত ও আগ্রাসন চলমান। মহামারি করোনা থেকে শুরু করে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, সিরিয়া যুদ্ধ, ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি বর্বরতায় এক বৈশ্বিক অস্থিরতা বিরাজ করছে।

এছাড়াও গত বছর তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ভূমিকম্প- সব মিলিয়ে এসব অঞ্চলে বিগত কয়েকবছরে হতাহত আর সৃষ্ট স্থবিরতার মাত্রা ছিল অত্যধিক পর্যায়ে। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত সেসব অঞ্চল আনন্দ উল্লাস, উন্মাদনা, প্রেম, বিনোদন এসব কোনোকিছুই প্রকাশ বা উদযাপনের অবস্থায় নেই।

তবে ১৪ ফেব্রুয়ারি অনাবিল আনন্দ আর বিশুদ্ধতার উচ্ছ্বাসে সারা বিশ্বে উদযাপিত হচ্ছে ভালোবাসা দিবস। কিন্তু ভালোবাসা দিবস কি সবার জন্য নয়?

যুদ্ধের ময়দানে প্রেমের গোলাপ ফোটার খবরও নতুন কিছু নয়। গোলা-বারুদের গন্ধেও প্রেম জমিয়ে চিরসঙ্গী হয়েছেন কেউ কেউ। হয়তো রয়েছে এমন আরও অনেক গল্প। যদিও তা যুদ্ধবিধ্বস্ত ও দুর্যোগ পরবর্তী মুহূর্তে হাজারো হতাহতের মাঝে হারিয়ে যায়, কিংবা সেভাবে ফুটে ওঠে না।

কিন্তু সত্যিকার অর্থে, এমন প্রতিকূলতায় জীবনের সাথে পাল্লা দিতে দিতে কেউ বোনেন প্রেমের বীজ। যেখানে জীবনের নিশ্চয়তা একেবারেই ভঙ্গুর, যে কোনো মুহূর্তে থেমে যেতে পারে মায়াবী জীবন- এমন পরিস্থিতিতেও এক অনিশ্চিত যাত্রায় সঙ্গীকে নিয়ে শেষ দিন পর্যন্ত কাটিয়ে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন এসব প্রেম কারিগররা।

এমন পরিস্থিতি থেকে বহু চড়াই উতরাই পেরিয়ে আসা এক প্রেম কারিগর জানান, জীবনে যত প্রতিকূল অবস্থাই আসুক না কেন, সঠিক ব্যক্তির সঙ্গ আঘাত কাটিয়ে তোলে।

বলছিলাম, তুরস্কের গাজিয়ান্তেপ অঞ্চলের বাসিন্দা আহমেদ নাছেদ ও তার সঙ্গী আনা রুদনিচেঙ্কো। অতি প্রতিকূল অবস্থাতেও এক পবিত্র বন্ধনের গল্প বুনেছেন এই যুগল।

মজার ব্যাপার হলো- এই যুগল তুরস্কের একই এলাকায় বসবাস করলেও তারা দুটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আসা শরণার্থী। অর্থাৎ ৩০ বছর বয়সী আহমেদ নাছেদ জন্মসূত্রে সিরিয়ান। শৈশবে দেশটিতে যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তুরস্কের গাজিয়ান্তেপে বসবাস শুরু করেন। অপরদিকে সঙ্গী আনা রুদনিচেঙ্কো আরেক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ইউক্রেন থেকে আগত। তাদের সংকল্প ছিল, যত খারাপ পরিস্থিতিই আসুক না কেন, ছেড়ে যাবেন না কেউ-কাউকেই।

বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে প্রকাশিত আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে উঠে আসে এই যুগলের প্রেম-কাহিনী।

২০২২ সালের শুরুতে, যখন তুরস্ক হাজার হাজার ইউক্রেনীয় শরণার্থীকে স্বাগত জানায়, সেখানে আগে থেকেই বসবাস ছিল সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসা সিরিয়ান শরণার্থীদের। ফলে তাদের একত্র আবাস হয় দেশটির গাজিয়ান্তেপে।

আর সেখান থেকেই পরিচয় হয় এই যুগলের। তারা স্বাভাবিকভাবে দিনযাপন করছিলেন। ২০২৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে বিয়ের প্রস্তাব জানানোর কথা ছিল এই যুগলের। কিন্তু বিপত্তি বাধে একই বছর ৬ ফেব্রুয়ারিতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ সেই ভূমিকম্পে; যার কারণে মৃত্যু হয় প্রায় ৫০ হাজার মানুষের।

আহমেদ ও আনা জানান, তারা একটা পুরোনো এপার্টমেন্টের অষ্টম তলায় ঘুমিয়ে ছিলেন। প্রথম কম্পনই তাদের গভীর ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে। তারা ভেবেছিলেন, এটা কোনো যুদ্ধের গোলাবারুদ কিংবা বিমান হামলার কম্পন হবে; যেহেতু তারা এসবে বেশ অভ্যস্ত ছিলেন। এটি যে ভূমিকম্প ছিল, তা বুঝতেই পারেননি তারা।

আর ওই ভয়াবহ ভূমিকম্প পণ্ড করে দেয় তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলের স্থাপনাসহ বিয়ের পরিকল্পনাও। তারা কখনও চিন্তা করেনি, এমন দুর্যোগের সামনে তাদের পড়তে হবে। এমন ধ্বংস-বিধ্বস্ত পরিস্থিতিতে এক পর্যায়ে গাজিয়ান্তেপ ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এই যুগল। পরিকল্পনা করেন কানাডায় পুনর্বাসনের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জার্মানিকে বেছে নেন তারা।

পরে জার্মানিতে তারা যেতে পারলেও বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে থাকেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রধান যে সমস্যা, সেটি ‘বর্ণবাদী আচারণ’। ফলে সেখান থেকে নেতিবাচক অভিজ্ঞতা হয় তাদের।

সে অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে আনা রুদনিচেঙ্কো জানান, ‘যখন আমি বলি আমি ইউক্রেনীয়, আমি অনেক সহানুভূতি পাই। কিন্তু আহমেদের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। কারণ, যেহেতু আমি সরাসরি ইউক্রেন থেকে আসিনি, তাই আমি শরণার্থী হিসেবে বিবেচিত হইনি। যদিও আমি নিজ দেশেও ফিরতে পারিনি। কিন্তু আহমেদের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, সিরিয়াকে সঙ্কট হিসেবে দেখেছিল জার্মানি। যে কারণে তেমন কোনো সুবিধা ও সহানুভূতি পায়নি সে।’

রুদনিচেঙ্কো তুরস্কের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘সিরিয়ানরা তুরস্কের গাজিয়ান্তেপে যেভাবে থাকেন, একইভাবে জার্মানিতে তাদের থাকতে হচ্ছে। অনুভূতিটা যেন একই।’

অবশেষে পাঁচ মাস সেখানে থাকার পর হাল ছেড়ে তুরস্কেই ফিরে আসেন তারা।

ভূমিকম্প পরবর্তী পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় তারা গাজিয়ান্তেপে একসাথে ফিরে আসেন এবং সুখে-শান্তিতে বসবাস শুরু করেন। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে ইস্তাম্বুলের প্রিন্সেস দ্বীপপুঞ্জে ভ্রমণের সময় নাছেদ রুদনিচেঙ্কোকে বিয়ের প্রস্তাব দেন এবং ক্রিসমাসের দিনে গাজিয়ান্তেপে দুজন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

গত বছর ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র সময় যখন গাজিয়ান্তেপ মৃত্যুপুরী, এ বছর সেই গাজিয়ান্তেপেই ভ্যালেন্টাইন্স ডে কাটাবেন, তা কল্পনাও করেননি তারা। তাদের দাবি, শহরটিতে তারা অনেক ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে গেলেও, এটিই এখনো তাদের নিরাপদ আশ্রয়।

পরিশেষে, আহমদের একটি উক্তি ছিল, ‘ভবিষ্যত আমাদের জন্য যা কিছু লুকিয়ে রাখুক না কেন, সঠিক ব্যক্তির সংস্পর্শ পেলে সব প্রতিকূলতাই মোকাবিলা করা সম্ভব হয়।’

নয়াশতাব্দী/ডিএ/এনএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ