ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬
সৈয়দ আলী গিলানি

কাশ্মিরের মহান নেতা

প্রকাশনার সময়: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৩:২০

কাশ্মিরী হুররিয়াতের অবিসংবাদিত নেতা সৈয়দ আলী শাহ গিলানির ইন্তেকালে কাশ্মিরী স্বাধীনতা আন্দোলন বিরাট ক্ষতির মুখে পড়ল। কিন্তু মৃত্যু থেকে কে কবে পলায়ন করতে পেরেছে! নির্দিষ্ট সময়ে সবাইকে মৃত্যুর ডাকে সাড়া দিতে হবে। দীর্ঘ সময় রোগাক্রান্ত থেকে শ্রীনগরে নিজ বাড়িতেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বিগত ১২ বছর যাবত ভারত সরকারের হাতে গৃহবন্দি ছিলেন। নিঃসন্দেহে গিলানির মৃত্যুতে কাশ্মিরী জনগণ এতিম হয়ে গেল।

তিনি ৯২ বছর আয়ু পেয়েছিলেন। উত্তর কাশ্মিরের ‘বানডিপুরা’ জেলার ‘জুরিমিনজ’ গ্রামে ১৯২৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫০ সালে তার পিতা-মাতা নিজেদের গ্রাম ছেড়ে ‘ডরুসপুরে’ হিজরত করেন। ‘বুটুংগুসপুরার’ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করে ‘সুপুর’ হাই স্কুলে ভর্তি হন। এরপর সুদীর্ঘ ১২ বছর কাশ্মিরের বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন।

১৯৫৩ সালে জম্মু-কাশ্মিরের ‘জামায়াতে ইসলামিতে’ যোগদান করেন। ১৯৬২ সালের ২৮ আগস্ট জীবনে প্রথমবার ভারতীয় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন এবং ১৩ মাস কারাভোগ করেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে সংগ্রাম-স্বাধিকার আন্দোলনের কারণে অসংখ্যবার দখলদারদের হাতে আটক হয়েছেন। জীবনের প্রায় চৌদ্দ বছর তিনি কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দি অবস্থায় কাটিয়েছেন!

সৈয়দ আলী গিলানি ‘জামায়াতে ইসলামির’ পক্ষ থেকে ১৯৭২-১৯৭৩ এবং ১৯৮৭ সালে ‘সুপুর’ আসন থেকে প্রাদেশিক সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তবে ১৯৮৯ সালের ৩০ আগস্ট তিনি সাংসদ পদ থেকে পদত্যাগ করেন। উল্লেখ্য, আলী গিলানি পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটির ওরিয়েন্টাল কলেজের গ্রাজুয়েট ছিলেন। মরহুম আবুল আলা মওদুদির সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল। দু’জনের কয়েকবার সাক্ষাতও হয়েছে। ‘জামায়াতে ইসলামি’ থেকে রাজনীতির পাঠ শেষে ২০০৪ সালের ১৭ আগস্ট কাশ্মিরের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে তিনি ‘তাহরিকে হুররিয়াত’ নামক দল গঠন করেন। আলী গিলানি একই সাথে ‘তাহরিকে হুররিয়াত’ এবং ‘হুররিয়াত কনফারেন্সের’ চেয়ারম্যান ছিলেন। সৌদি আরবভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘রাবেতা আলমে ইসলামির’ সদস্য ছিলেন। ৩০টির অধিক গুরুত্বপূর্ণ বই রচনা করেছেন।

মারাত্মক শারীরিক দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও তিনি কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান প্রাণপুরুষ ছিলেন। ভারত সরকারের নানা জুলুম-অত্যাচারের ভয়ে ভীত হননি, লোভের সামনে আত্মমর্যাদা বিকিয়ে দেননি, জেলবাসের কাছে পরাজয় বরণ করেননি। নানা প্রকার হুমকি, ভয় ও প্রলোভনের পরও তিনি কাশ্মিরী জনগণের স্বাধীনতা অর্জনে দৃঢ়পদ ছিলেন। কোনো প্রকার পদবি লালসা তাকে লড়াইয়ের পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। স্বৈরাচারের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে আমৃত্যু লড়ে গেছেন কাশ্মিরের বিজয়ের লক্ষ্যে। গোলা-বারুদের পাহাড় টপকে গিলানি ছিনিয়ে আনতে চেয়েছিলেন স্বাধীনতার লাল সূর্য। অসুস্থতাজনিত কারণে প্রায় ১৭ বছর পর ২০২০ সালের ৩০ জুন তিনি সর্বদলীয় ‘হুররিয়াত কনফারেন্সের’ চেয়ারম্যানের পদ থেকে স্বেচ্ছায় ইস্তফা গ্রহণ করেন।

কোনো সন্দেহ নেই, সৈয়দ আলী গিলানি কাশ্মিরী স্বাধীনতা আন্দোলনের সবচেয়ে শক্তিশালী ও বলিষ্ঠ আওয়াজ ছিলেন। পাকিস্তানের কল্যাণকামী ও সমর্থক ছিলেন। কাশ্মিরী জনগণের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য পাকিস্তানের সকল ফোরামের পক্ষ থেকে চেষ্টা ও সাহায্যের পক্ষপাতি ছিলেন। ‘আমরা পাকিস্তানি, পাকিস্তান আমাদের’, তার এই ঐতিহাসিক উক্তি কোনো কাশ্মিরীর ভোলার কথা নয়। পাকিস্তান নিজের ৭৩তম স্বাধীনতা দিবসে সৈয়দ আলী গিলানিকে ‘নিশানে পাকিস্তান’ পদক প্রদান করেছে। গিলানির পক্ষ থেকে হুররিয়াত নেতৃবৃন্দ ইসলামাবাদের প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে পদকটি গ্রহণ করেছেন। গিলানির মৃত্যুতে পাকিস্তান এবং কাশ্মিরে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল কমর জাবেদ বাজওয়া, প্রাদেশিক মূখ্যমন্ত্রী ও গভর্নরবৃন্দ, মন্ত্রী পরিষদ সদস্যবৃন্দ, আজাদ কাশ্মিরের মূখ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীবর্গ, ভারতের জেলে বন্দি কাশ্মিরী নেতা ইয়াসিন মালিকের স্ত্রী মেশাল মালিকসহ সমগ্র পাকিস্তানি জনগণ সৈয়দ আলী গিলানির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন, রুহের মাগফিরাত কামনায় প্রার্থনা করেছেন।

অপরদিকে গিলানির মৃত্যুর পর তার লাশের ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছে ভারত সরকার। মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে ভারত সরকার পুরো কাশ্মির জুড়ে নজিরবিহীন টহল ও নজরদারি জোরদার করেছে। কারফিউ জারি করেছে। ভারতীয় সিকিউরিটি ফোর্স গিলানির বাড়ির চতুর্দিকে তারকাটা দিয়ে ঘেরাও করে রেখেছে। মানুষের চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে।

গণমাধ্যমের বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে, ভারতীয় বাহিনী আলী গিলানির জানাজার নামাজে অল্প সংখ্যক মানুষকে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিয়েছে। কাশ্মিরী জনগণের জোরালো দাবি ছিল, গিলানির অসিয়ত অনুযায়ী তাকে ‘শহিদ মাজারে’ দাফন করা হোক। কিন্তু জুলুমবাজ ভারত সরকার এর অনুমতি দেয়নি। প্রতিবাদী জনসমুদ্র এড়াতে ভোর সাড়ে ৪টায় তার বাড়ির নিকটে ‘হায়দারপুরায়’ জোরপূর্বক দাফন করা হয়েছে। ভীতু ভারত সরকার কর্তৃক গিলানির লাশের সঙ্গে এহেন কর্মকা- বর্বরতা প্রদর্শন ও আতঙ্ক বিস্তার নয় তো আর কী? এর থেকে বোঝা যায়, এমন কোনো জুলুম নেই, যেটা ভারত সরকার অধিকৃত মুক্তিকামী কাশ্মিরী জনগণের ওপর করেনি।

সৈয়দ আলী গিলানির মৃত্যু, জানাজা থেকে দাফন পর্যন্ত ভারত সরকার মানবাধিকারকে দুই পায়ে পদদলিত করেছে। মানবতার বুলি আওড়ানো বিশ^শক্তির মুখে সজোরে চপেটাঘাত করেছে। বিশ^বাসীর এখন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসে গেছে, তারা ভারত সরকার কর্তৃক কাশ্মিরের ওপর অবৈধ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, নাকি ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও মানবতার ওপর প্রলেপ লাগিয়ে দেবে! পাকিস্তানের জনগণ কাশ্মিরের প্রতি সব ধরনের সহযোগিতা চালু রাখবে, যতক্ষণ পর্যন্ত সৈয়দ আলী গিলানির স্বপ্ন অনুযায়ী কাশ্মির স্বাধীন না হবে। আল্লাহ তায়ালা মরহুম সৈয়দ আলী গিলানিকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন। আমিন!

পাকিস্তানের দৈনিক জঙ্গে প্রকাশিত বিখ্যাত সাংবাদিকের কলাম থেকে

অনুবাদ আমিরুল ইসলাম লুকমান

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ