ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ভাড়ার ডাক্তারে চলে সেবা

প্রকাশনার সময়: ০১ ডিসেম্বর ২০২২, ১৩:২৫

নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম, তার ওপর আরও নেই দক্ষ ডাক্তার ও নার্স। তারপরেও হাসপাতালের সামনে সাঁটিয়ে দেয়া হয়েছে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের নামের লম্বা তালিকা। এভাবে রোগীদের ভুল বুঝিয়ে বেড আর কিছু ইক্যুপমেন্ট বসিয়ে ভাড়া করা ডাক্তার দিয়ে চলছে এনআইসিইউ, আইসিইউ ও সিসিইর নামে প্রতারণা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই কেন্দ্রসমূহের কার্যক্রম নির্বাহ হয়ে থাকে অত্যন্ত উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, সেবিকা এবং শ্বাসপ্রশ্বাস কার্যক্রম সম্পর্কে অভিজ্ঞ থেরাপিস্টদের দ্বারা। যারা সংকটপূর্ণ অবস্থায় সেবাদানের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ। কিন্তু এসব হাসপাতালে রোগীর কাছে ডাক্তার বা নার্স থাকে না সর্বক্ষণ। ভুক্তভোগী রোগীর স্বজনদের অভিযোগ— জ্বর, সর্দি, সিজার, মাথাব্যথা কিংবা হাতভাঙা— এ ধরনের যে কোনো রোগী এলেই ভর্তি করানোর অভিযোগ বিশেষায়িত ইউনিট (আইসিইউ)। এভাবে সেবার নামে গ্রাম থেকে আসা অসহায় রোগী থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। সেবার আড়ালে অসাধু ব্যবসায়ীরা গড়ে তুলেছেন নামসর্বস্ব হাসপাতাল। এক ডাক্তারের কথা বলে ভর্তি করে অপারেশন হচ্ছে অন্য ডাক্তার দিয়ে। সরেজমিন রাজধানীর শ্যামলী, মোহাম্মদপুর, মগবাজার, মিরপুর, বাড্ডা, উত্তরা, সাভার, বনানী, মালিবাগ, রামপুরা, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকাজুড়ে মিলেছে হাসপাতাল নামের কসাইখানা।

সম্প্রতি র‍্যাব ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের বেশ কয়েকটি অভিযান থেকে জানা গেছে, তাদের বেশির ভাগেরই নেই কাগজপত্র। যাদের আছে তাদেরও নেই মেয়াদ। কিন্তু চিকিৎসার নামে প্রতারণা করে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। তাদের নেই কোনো নিজস্ব ডাক্তার। ভাড়া করা ডাক্তার দিয়ে হাসপাতাল পরিচালনা করছে তারা। নয়া শতাব্দীর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে নামসর্বস্ব হাসপাতাল নামের কসাইখানায় মানুষের সেবার নামে জিম্মি করে কীভাবে হাতিয়ে নেয় টাকা। শুধু তাই নয়, মরদেহ জিম্মি করেও টাকা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে এদের বিরুদ্ধে।

রাজধানীর মগবাজার মৌচাক এলাকায় অবস্থিত ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিরুদ্ধে অপচিকিৎসার অভিযোগ তোলেন রোগীর এক স্বজন। ভুক্তভোগীর অভিযোগ— ১৩ দিনেও সিজারের রোগীর রক্ত বন্ধ হয়নি। রোগীকে জিম্মি করে রেখে হাসপাতালের বিল বাড়ানোর নামে অপচিকিৎসা করে আসছে ডাক্তার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।’ তিনি বলেন, ‘১৩ দিনেও উঠে বসতে বা দাঁড়াতে পারছে না রোগী।

বাংলাদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘বিভিন্ন হাসপাতালে যে চার্জ আছে সেটিকে আমরা নির্ধারণ করে দেয়ার চেষ্টা করছি। কোনো কোনো জায়গায় দেখা যায়, একটি বিশেষ পরীক্ষার জন্য ১০ হাজার টাকা, অন্য জায়গায় আবার ৫০ হাজার টাকা। এই বিরাট বৈষম্য আমরা দূর করতে চাই। এটি হতে দেয়া যাবে না।’

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘সেবার মানকে উন্নত করে এ, বি ও সি ক্যাটাগরি করে দেবো। ক্যাটাগরি সার্বিক ব্যবস্থাপনা অনুযায়ী নির্ধারণ করা হবে। যে ক্যাটাগরিতে যে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার উপযোগী সেই প্রতিষ্ঠান তার বাইরে সেবা দিতে পারবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘দরিদ্র জনগণ যাতে সঠিক চিকিৎসা পায়, তারা যেন কষ্ট না পায় সেদিকে নজর রাখতে হবে। তাদের যাতে বাড়তি মূল্য না দিতে হয়।

জমির আলী নামের এক ভুক্তভোগী নয়া শতাব্দীকে জানান, ‘গত কয়েক মাস আগে ১১ বছরের ছেলে গাছ থেকে পড়ে হাত ভেঙে যায়। তাকে নিয়ে প্রথমে পঙ্গু হাসপাতালে যাই। সেখানে ভর্তি করাতে ব্যর্থ হই। পরে এক নারী দালাল ১৮ হাজার টাকায় রোগীর চিকিৎসা করে দেবেন বলে জানান। তার কথায় ছেলেকে নিয়ে মোহাম্মদপুর সেবিকা জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে প্রতারণার শিকার হই। ২ দিন পার হতেই বলা হয় রোগী নিয়ে যেতে। বিল ৭০ হাজার টাকা। পরে র‍্যাবের সহযোগিতায় সেখান থেকে রেহাই পাই।’ তিনি বলেন, ‘বিলের কথা শুনে বিপদে পড়ে যাই। পরে র‍্যাবের সহযোগিতায় সেখান থেকে রেহাই পাই। র‍্যাব অভিযান চালিয়ে তাদের নয় লাখ টাকা জরিমানা করে। সেবিকা জেনারেল হাসপাতালের মালিকের ছোট ভাই সেলিম জানান, আমরা তার চিকিৎসা করেছি কিন্তু তার পরেও আমাদের র‍্যাব দিয়ে ধরিয়ে দিলো।’

র‍্যাবের নির্বাহী মাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু জানান, ‘সেলিম দাখিল পাস করে নিজেকে ‘ওটিবয়’ পরিচয় দিয়ে নিজেই অপারেশন রুমে অপারেশন করতেন। যা সম্পূর্ণ অন্যায়। এমন অপরাধের জন্য ৯ লাখ টাকা জরিমানা করা হয় এবং তাকে সশ্রম কারাগারে পাঠানো হয়। অনুসন্ধান বলছে, শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রধান ফটকের বিপরীত পাশে গড়ে উঠেছে মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট। এই মার্কেট ঘিরে গড়ে উঠেছে মক্কা মদিনা জেনারেল হাসপাতাল, সেবিকাসহ প্রায় ৫-৬টি হাসপাতাল। তার পাশের ভবনেও গড়ে উঠেছে কয়েকটি হাসপাতাল।

জানা যায়, শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল ও নিউরোসাইন্স হাসপাতালে আসা রোগীদের দালালের মাধ্যমে নিয়ে আসা হয় নামসর্বস্ব এসব হাসপাতালে। কুষ্টিয়া থেকে পঙ্গু হাসপাতালে আসা মায়া রানী সরকার নামের একজন নয়া শতাব্দীকে জানান, গাছ থেকে পড়ে স্বামী সুবীর পঙ্গু হয়েছে। স্বল্প খরচে ভালো চিকিৎসার জন্য সরকারি পঙ্গু হাসপাতালে এসে কোনো চিকিৎসা পাইনি। ডাক্তার, আনসার সবাই বলে প্রাইভেট হাসপাতালে যেতে। সেখানেই নাকি এখানের ডাক্তার ভালো করে দেখবেন। ডাক্তাররাই আমাদের কসাইখানাতে যেতে বাধ্য করছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা সামছুদ্দিন আলী। কুমিল্লার দাউদকান্দির একটি স্থানীয় হাসপাতালে সিজার করার সময় শিশুটির নারী কেটে যায়। এ অবস্থায় নাতনিকে নিয়ে এসেছেন রাজধানীর শিশু হাসপাতালে। কিন্তু ৩ দিনেও মিলেনি কোনো সিট।

সামছুদ্দিন আলী বলেন, ‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও অসুস্থ শিশু নাতিকে ভর্তি করাতে পারিনি। কিন্তু দালালের খপ্পরে পড়ে মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ২ দিনে আইসিইউর নাম করে খুইয়েছি ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু কোনো সেবা পাইনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ফের শিশু হাসপাতালে ফিরে আসি। সিট না পেয়ে বাড়ি ফিরে যাই। এক দিন পরে জানা যায়, সেই শিশুটি মারা গেছে।’

নয়া শতাব্দী/জেআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ