স্বেচ্ছাচারিতা আর অনিয়ম-দুর্নীতিই নয়, চাকরির প্রলোভনেও ফাঁসাচ্ছেন তরুণীদের। আবার ফাঁদে পা দিয়ে কেউ পিছু হটলে তাকে দেয়া হয় নানা অপবাদ। আর এই অপবাদ দিতে নেন বিভিন্ন কৌশল। একের পর এক অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন তিনি। কোনো কিছুতেই তোয়াক্কা নেই তার। রয়েছেন বহাল তবিয়তে। এমন সব অভিযোগ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর খুলনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জামানুর রহমানের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী বরাবরে গত ৮ সেপ্টেম্বর দাখিলকৃত এক অভিযোগে দেখা যায়, তিন পৃষ্ঠার ওই অভিযোগের ২০ নম্বর দফায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর খুলনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জামানুর রহমানের নারীলিপ্সুতা উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, সংস্থার প্রধান প্রকৌশলী সাইফুর রহমানকে চাকরিতে নিয়োগের প্রার্থী জোগান দেন প্রকৌশলী জামানুর রহমান। তারই ধারাবাহিকতায় এক তরুণীকে চাকরি দেয়ার কথা বলে দীর্ঘদিন সম্মানহানির পর তাকে চাকরি দিতে না পারায় ভুক্তভোগী তরুণী মুখ খুলতে পারে— এমন ভয় থেকে তরুণীকে প্রথমে শিকল বন্দি করে আটকে রাখে এবং পরে পাগল অপবাদে পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন প্রকৌশলী জামানুর রহমান।
অভিযোগপত্রের ২৩টি দফায় অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে রয়েছে রোমহর্ষক অনেক ঘটনা। আছে বিভিন্ন পত্রিকা-টেলিভিশনে প্রকাশিত প্রতিবেদনের উদ্ধৃতিও।
অভিযোগ রয়েছে, খুলনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জামানুর রহমান চাকরির প্রলোভনে নিজের জালে ফাঁসাতেন বিভিন্ন তরুণীকে। ফাঁদে পা দিয়ে আবার কেউ রাজি না হলে তাকে দেয়া হয় নানা অপবাদ। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি এক তরুণী সীমাকে (ছদ্মনাম) পাগল অপবাদে ভর্তি করিয়েছেন পাবনা মানসিক হাসপাতালে। পরে মানসিক হাসপাতাল থেকে মুক্তি মিললেও ওই তরুণীর দিন কাটছে অজানা আতঙ্কে আর রয়েছেন আত্মগোপনে। চাকরিপ্রার্থী তরুণী সীমার জীবন সংগ্রামের গল্পটা কোনো সিনেমার চেয়ে কম নয়। এক প্রকৌশলীর অনৈতিক প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় শিকলে বন্দি জীবনের পর, দীর্ঘ সময় থাকতে হয়েছে মানসিক হাসপাতালে। অজ্ঞাত ফোন কল পেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন স্বামী। এরপর পাবনা মানসিক হাসপাতাল থেকে মুক্তি মেলে তরুণীর।
ভুক্তভোগী ওই তরুণীর স্বামী জানান, ফেনী থেকে একটা ফোন কল আসে এবং অপর প্রান্ত থেকে আমার স্ত্রীর নাম করে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি বলে তিনি পাবনা মেন্টাল হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এরপরই আমি বিষয়টি নিয়ে আদালতের শরণাপন্ন হই এবং আদালতের নির্দেশে আমার স্ত্রীকে মানসিক হাসপাতাল থেকে মুক্ত করি।
তিনি বলেন, তাদের অনেক টাকা এবং লোকজন আছে। তাই আমরা জীবন ও সম্মান রক্ষার্থে আত্মগোপনে আছি। ক্ষতি যা হওয়ার তা তো হয়েছে, এখন বেঁচে থাকতে চাই।
আদালতে তরুণী সীমার দেয়া জবানবন্দিতে দেখা যায়, দীর্ঘদিন কীভাবে জনস্বাস্থ্য বিভাগের প্রকৌশলী জামানুর রহমান সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চাকরি বাণিজ্য চালিয়ে আসছেন। পাশাপাশি চাকরি দেয়ার নামে কীভাবে তরুণীদের ফাঁসাতেন নিজের জালে।
ভুক্তভোগী তরুণী সীমা বলেন, জামানুর রহমানের কাছে চাকরির জন্য গেলে তিনি বিভিন্ন ধরনের স্বপ্ন দেখান। এমনকি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলীও তার খুবই ঘনিষ্ঠ বলে জানান তিনি। তাকে যা বলবে তাই প্রধান প্রকৌশলী করবেন বলে জানান জামানুর রহমান। তার কাছে একটা চাকরি দেয়া তো মামুলি ব্যাপার। যেন আমার চাকরি হয়েই গেছে। এরপর এক পর্যায়ে প্রকৌশলী জামানুর আমাকে বলেন, ‘এমনি এমনি এ জগতে কেউ কাউকে কিছুই দেয় না— চাকরি তো দূরের কথা। কিছু পাইতে হলে কিছু দিতে হয়।’
জামানুর রহমানের এমন মন্তব্যের পর সীমা প্রকৃত বিষয়টি বুঝতে পেরে পিছু হটতে শুরু করলেই তার জীবনে শুরু হয় অমানিসার অন্ধকার। বানানো হয় পাগল। ভর্তি করানো হয় মানসিক হাসপাতালে।
ভুক্তভোগী তরুণী সীমা বলেন, চাকরিপ্রার্থী হিসেবে যাতায়াত করাকালে আমি বিভিন্ন সময় দেখেছি প্রকৌশলী জামানুর রহমান বিদেশে লোক পাঠানো, বিভিন্ন স্কুল-কলেজে ভর্তি বাণিজ্য এবং চাকরি বাণিজ্য করছেন। এসব বিষয়ে তার কাছে লোকজন আসছেন এবং তারা অনেক টাকা লেনদেনও করেছেন।
চাকরির প্রলোভনে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জামানুর রহমানের তরুণীদের নিজের জালে ফাঁসানোর ঘটনাটি শিহরিত হয়ে ওঠার মতো। এমনকি প্রকৌশলী জামানুর রহমান তার অনৈতিক র্কমকাণ্ডের প্রমাণ নষ্ট করতে ভুক্তভোগী তরুণী সীমার পরিবারের সহযোগিতা নিয়ে কীভাবে তাকে মানসিক রোগী সাজিয়েছেন তা পিবিআই তদন্তে উঠে এসেছে।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্ত কর্মকর্তা নাজমুল হক এ ব্যাপারে বলেন, চাকরির প্রলোভনে তরুণীদের ফাঁসানো এই মামলাটি শিহরিত করার মতো। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জামানুর রহমান তার অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বেশ কিছু তথ্য প্রমাণ ভুক্তভোগী তরুণী সীমার কাছে ছিল। যেসব তথ্য প্রমাণে প্রকৌশলী জামানুর রহমানের অকাজ-কুকাজের সহসাই অনুমেয় ছিল। আর এসব প্রমাণ বিলুপ্ত করতেই তরুণী সীমার কাছ থেকে প্রকৌশলীর নির্দেশে তার মোবাইল কেড়ে নেয়া হয়। এরপর পরিবারের সহযোগিতা নিয়ে তরুণীকে মানসিক রোগী সাজিয়ে শিকল বন্দি করে প্রথমে বাড়িতে আটক করে রাখা হয় দীর্ঘদিন। পরে অপহরণ করে পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এ বিষয়ে মামলা থাকার কথা অস্বীকার করে ভুক্তভোগী তরুণী সীমাকে চেনেন না বলে জানিয়ে প্রকৌশলী জামানুর রহমানের বলেন, ‘জরুরি মিটিংয়ে আছি—পরে কথা হবে।’ যদিও তিনি আর ফোন করেননি বা ধরেননি। মোবাইলে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
জামানুর রহমানের বিরুদ্ধে অপর এক অভিযোগে জানা যায়, পাবনা জেলার সুজানগরসহ তিনটি পৌরসভার আর্সেনিকমুক্ত সুপেয় পানি সরবরাহ ও পানি নিষ্কাশনের জন্য ২০১০-১১ অর্থবছরে পাইপ ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল স্যানিটেশন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এর জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় ১৪ কোটি টাকা। প্রকল্পে পাবনার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী এবং বর্তমানে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর, খুলনা সার্কেল খুলনার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জামানুর রহমান এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন। তিনি স্বেচ্ছাচারিতা ও ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে যেনতেনভাবে প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত করেন। কাজ সমাপ্তের পর গত ৬ বছরে সুজানগর ও অন্য দুই পৌরবাসী এই প্রকল্পে কোনো সুফল পায়নি। বরং দুর্নীতি ও অর্থ-আত্মসাতের কারণে উপকারেই আসছে না। যার ফলে এ বিষয়ে সুজানগর পৌরসভার পক্ষ থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসের ৫ তারিখে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরে লিখিত অভিযোগ করা হয়। অভিযোগে প্রকল্পটিতে ব্যবহার করা সব পাইপ লাইনে নিম্নমানের পাইপ ব্যবহার করার কারণে নলকূপ ও পাম্প হাউস অকেজো হয়ে পড়ে আছে বলে উল্লেখ করা হয়।
অভিযোগে প্রকাশ তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জামানুর রহমানের বিরুদ্ধে এই অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের পর তার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ডিপিএইচই প্রধান প্রকৌশলী সাইফুর রহমান কাজ করেছেন। এমনকি বিভিন্ন সময় জামানুর রহমানের বিরুদ্ধে করা অভিযোগগুলো থেকে তাকে পরিত্রাণে নেপথ্যে থেকে প্রধান প্রকৌশলী কাজ করছেন বলেও অভিযোগে প্রকাশ। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী সাইফুর রহমান বলেন, ‘পাইপ ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল স্যানিটেশন প্রকল্পের কাজগুলো আমার আমলে হয়নি, তাই এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারব না। তাছাড়া আমি তাকে পৃষ্ঠপোষকতা করি— এ কথাটিও ঠিক নয়। আমি কোনো অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত নই।’
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ