মহামারি করোনার পাশাপাশি আতঙ্ক তৈরি করেছে ডেঙ্গু। দোলাচলে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে কখনো শনাক্ত কমছে, কখনো বাড়ছে। কখনো বা চলতি বছরের রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ডেঙ্গুর এমন পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, চলতি বছর থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় এডিস মশার উৎপাদন বেড়েছে। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে যে মশক নিধন কার্যক্রম চালায় এটা অনেকটা অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো। ডেঙ্গুতে অন্য অঞ্চল থেকে রাজধানীতে ঝুঁকিটা বেশি থাকে। জুন থেকেই ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হয়। যদি ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি হয় তবে তা সামাল দেয়া কঠিন হবে। বাংলাদেশে ১২৩ প্রজাতির মশা রয়েছে। বর্তমানে ঢাকায় প্রায় ১৪ প্রজাতির মশা পাওয়া যায়। তাই মশা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মশার প্রজাতি ও আচরণভেদে আলাদা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিতে হবে এবং জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। কেননা, চলতি মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে।
জানতে চাইলে প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়েছে কারণ এখন সময়টাই ডেঙ্গুর। মে-জুন থেকে শুরু করে শীতের আগ পর্যন্ত দেশে এর প্রাদুর্ভাব বাড়ে। এবার বাড়ার কারণ বৃষ্টিটা ঠিকমতো হচ্ছে না। মাঝে মধ্যে হচ্ছে, যা মশার প্রজননে সহায়তা করছে। মশা সৃষ্টির শুরু থেকেই ছিল এবং থাকবে। এটিকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা সম্ভব না। আর মশা থাকলে ডেঙ্গুও থাকবে। তবে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্যোগ নিয়েছে। তবে আরো উদ্যোগ নেয়া দরকার। সতর্ক হলে রোগীর সংখ্যা কমানো সম্ভব।
সম্প্রতি রাজধানীতে বেড়েছে এডিস মশার উপদ্রব। ঢাকার দুই সিটি করপোশনের ৯৮টি ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকায় জরিপ করে এডিস মাশার লার্ভা পেয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপতরের বিশেষ টিম। এডিস মশার লার্ভার পাশাপাশি মশার দৌরাত্ম্য বেড়েছে অনেক এলাকায়। মাঝে মাঝে বৃষ্টি ও ঠাণ্ডা জ্বরের কারণে অনেকেই ভয়ে ডেঙ্গু পরীক্ষাও করাতে হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে যাচ্ছেন। মশার দৌরাত্ম্য বাড়ার কারণে অনেকেই কয়েল জ্বালিয়ে রাখছে সারাক্ষণ।
মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা নাছমা আক্তার নয়া শতাব্দীকে বলেন, সম্প্রতি মশার উপদ্রব এতটাই বেড়েছে যে, নিজের পরিবারের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে সারাক্ষণ কয়েল জ্বালিয়ে রাখতে হচ্ছে। কারণ, ২০১৯ সালে আমাদের বাসায় দুইজন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল। সে সময় চোখের সামনে তাদের কষ্ট দেখে এতটাই খারাপ লেগেছে আর দোয়া করেছি তাদেরসহ ডেঙ্গু রোগীদের সুস্থতা কামনা করেছি।
তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে মাঝে মধ্যে কীটনাশক স্প্রে করে যায়, খুব একটা বেশি আসে না, মাঝে মধ্যে দেখা মেলে; তাছাড়া না। এভাবে চলতে থাকলে আর মশার উপদ্রব বাড়তে থাকলে অবস্থা কেমন হবে সেটা এখনই উপলদ্ধি করতে পারছি। এখনই সিটি করপোরেশন যদি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তাহলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেরও বাইরে চলে যাবে।
এলাকাভিত্তিক মশক নিধন কর্মীরা কীটনাশক স্প্রে করার কথা থাকলেও সপ্তাহজুড়েই তাদের দেখা মেলে না এমন অভিযোগ অহরহ। কয়েকজন নগরবাসীর জানান, আগে মশকনিধন কর্মীরা কীটনাশক দিয়ে স্প্রে করে গেলে এখন তাদের দেখা মিলছে না। যদিও মাঝে মধ্যে তাদের দেখা পেলে দীর্ঘ সময় পর পর স্প্রে করার প্রশ্ন করা হলেও উত্তর মেলে না। ফলে বরাবরের মতো ডেঙ্গু রোধে সিটি করপোরেশন অনেকটা ব্যর্থই বলা চলে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীসহ সারাদেশে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯০ জন। এ সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। এ নিয়ে বর্তমানে সারাদেশে মোট ৭৭৬ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি আছেন। আক্রান্ত ৯০ জনের মধ্যে ৭১ জন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিচ্ছেন ১৯ জন। এ নিয়ে বর্তমানে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ৭৭৬ জন ভর্তি রয়েছেন। তাদের মধ্যে ঢাকার ৪৭টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৬৫২ জন। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ১২৪ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, চলতি বছরে ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ছয় হাজার ৪৪৭ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন পাঁচ হাজার ৬৪৯ জন। এ সময়ে ঢাকায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন পাঁচ হাজার ৩০৫ জন ও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন চার হাজার ৬৪৩ জন। ঢাকার বাইরে ভর্তি হয়েছেন এক হাজার ১৪২ জন এবং সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন এক হাজার ৬ জন। এর আগে গত ২৯ আগস্ট ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২০১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। এদিন একজনের মৃত্যুও হয়।
জানতে চাইলে প্রখ্যাত ভাইরোলজিস্ট ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত রোগ। এটি বাড়ার কারণ মশা বেড়ে গেছে। অর্থাৎ মশা বাড়ার কারণগুলোই ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়ার কারণ। এক্ষেত্রে আমরা যতই উদ্যোগ নেই, তা কার্যকর হচ্ছে না বলা যায়। আমাদের উত্তর সিটি করপোরেশনের আতিক সাহেব ডেঙ্গু মশা নিধনে খুবই দৌড়াদৌড়ি করছেন। কিন্তু টায়ার, ডাবের খোসা এসব কিছু রয়ে যাচ্ছে বলে আমার মনে হয়। ফলে মশা বৃদ্ধির হারটা বেড়ে গেছে।’
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক থেমে থেমে বৃষ্টিপাত বেশি হচ্ছে। এটি যদি থেকে যায়, তাহলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়ার সম্ভাবনা আছে। একটানা যদি অনেক বৃষ্টি হয়, তাহলে বাড়বে না। কিন্তু থেমে থেমে বৃষ্টি হলে তা বাড়বে। কারণ এতে অল্প পানি জমে। আর এতে মশার প্রজনন বৃদ্ধি পায়।
অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, হাসপাতালে প্রস্তুতি যতটা থাকা দরকার তা নেয়া হয়েছে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা দক্ষ, তাদের অতীতে এর থেকেও খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। আমরা দেখছি তারা ভালোই কাজ করছে। এখন পর্যন্ত হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের সেবা দিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত সেবা দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। আশাকরি কোনো সমস্যা হবে না।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ