করোনাভাইরাসে দেশে দৈনিক রোগী শনাক্ত, মৃত্যু এবং শনাক্তের হার সবই কমছে। গত এক সপ্তাহ ধরে শনাক্ত হার ৫ শতাংশের নিচে। সংক্রমণ নিয়ে স্বস্তি এসেছে। এই সময়ে আরো বেশি সতর্ক থাকা দরকার। তবে সংক্রমণ হার কমে আসার স্বস্তিতে স্বাস্থ্যবিধির সব শর্তই বেমালুম ভুলে আছেন দেশের মানুষ। সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কমে আসায় স্বস্তিতে তুষ্ট হয়ে স্বাস্থ্যবিধিতে ঢিলেঢালাভাব চলে এসেছে। পরিবার নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সাগর তীর, পাহাড়-পর্বতে। হোটেল-মোটেল-গণপরিবহনে মাস্ক ব্যবহারসহ নানা নির্দেশনা এখন শুধু কাগুজে পরিণত। কোথাও নেই বাস্তবায়ন। মাস্ক পরছে না, শপিং মল, গণপরিবহন, বেসরকারি অফিস, রেস্টুরেন্ট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে অভিভাবকদের ভিড়, হাসপাতালসহ কোথাও মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। মানুষের এমন বেপরোয়া আচরণে সংক্রমণ ঝুঁকি আবারো বাড়ার শঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, স্বস্তিতে ভুগে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চললে আবারো বিপর্যয় আসতে বেশি সময় লাগবে না। কারণ হিসেবে বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর উদাহরণ রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল ভিয়েতনাম। তবে বর্তমানে যে কয়েকটি দেশে সংক্রমণ বেশি, তার মধ্যে একটি ভিয়েতনাম। আমেরিকাতেও সংক্রমণ অনেক বেশি। সংক্রমণের এই নিম্নমুখী হারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে তারা টিকার ওপর জোর দিয়েছেন, সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধির। ফলে আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মানার এই ঢিলেমি ত্যাগ করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে কেবল টিকার ওপর নির্ভর করলে সেটা হবে বোকামি।
সরজমিনে গতকাল দেখা গেছে, রাজধানীর সব জায়গাতেই কাঁচাবাজার, শপিংমল, গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। স্বাস্থ্যবিধি ভুলে দেদার ঘুরছে সবাই। ব্যক্তিগত দূরত্ব বজায় রাখা তো দূরের কথা, মাস্ক ব্যবহারেও অনীহা। ঢাকার বাইরের চিত্রও একই। স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে মানুষের এই বেপরোয়া আচরণে আবারো করোনার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার শঙ্কায় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিনই জ্বরে আক্রান্ত রোগী আসছেন চিকিৎসা নিতে। জ্বরের সঙ্গে সর্দি, কাশি, শরীর ব্যথা এগুলো থাকায় মানুষের ভয় করোনা কিংবা ডেঙ্গু নিয়ে। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কিছু মানুষের করোনা ও ডেঙ্গু ধরা পড়ছে। তবে অধিকাংশই অন্য কোনো ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, পরিবেশগত কারণে আক্রান্ত হওয়া জ্বর-সর্দি-কাশিতে ভুগতে হচ্ছে তিন থেকে সাত দিন পর্যন্ত। অনেকের ক্ষেত্রে ৮-১০ দিনও অসুস্থতা থাকে। কারো জ্বর কমে যায়, থেকে যায় শুকনো কাশি, শারীরিক দুর্বলতা। অনেকের গলাব্যথাও হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু করে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত শনাক্ত নি¤œমুখী প্রবণতার দিকে। বর্তমানে সংক্রমণ হার এক হাজারের নিচে। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে রোগীর সংখ্যা ছিল ১১ হাজার ৭৭ জন, জুলাই মাসে সেখানে রোগী সংখ্যা হয় তিন লাখ ৩৬ হাজার ২২৬ জন। তবে বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে আগস্ট মাসে নতুন শনাক্ত কমে এসেছে। আগস্টে রোগী শনাক্ত হয়েছেন দুই লাখ ৫১ হাজার ১৩৪ জন। সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু কমতির দিকে।
গত ছয় জুলাই দেশে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা প্রথম ১০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। অতিসংক্রমণশীল ‘ডেল্টা’ ভ্যারিয়েন্টের তা-বে জুলাই ছিল করোনা মহামারিকালে ভয়ঙ্কর। যদিও তার আগের মাস জুন থেকে দৈনিক শনাক্তের হার উঠে যায় ২০ শতাংশের ওপরে। তবে জুলাইতে প্রায় প্রতিদিনই শনাক্ত ও মৃত্যুতে তার আগের দিনের রেকর্ড ভাঙতে থাকে। এরই মধ্যে দেশে এক দিনে সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত হয় গত ২৮ জুলাই ১৬ হাজার ২৩০ জন। শনাক্তের হার উঠে যায় ৩২ শতাংশের বেশি। ভয়ঙ্কর জুলাই শেষ হওয়ার পর তার রেশ চলতে থাকে আগস্ট মাস পর্যন্ত। গত ১২ আগস্ট পর্যন্ত ৩৮ দিনের মধ্যে ৩০ দিনই শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি ছিল। আর এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয় আগস্ট মাসের দুইদিন। গত ৫ এবং ১০ আগস্ট এক দিনে সর্বোচ্চ ২৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। তবে আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে রোগী শনাক্তের হার ক্রমেই কমছে। আর সেপ্টেম্বর মাসে সংক্রমণের হার কমে এসেছে পাঁচের নিচে। শনাক্ত নেমে এসেছে এক হাজারে ও মৃত্যু ৩০-এর নিচে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলছেন, করোনার শনাক্ত ও মৃত্যুর দিক দিয়ে এখন ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। সংক্রমণ পরিস্থিতি এখন একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে আছে। তবে তার মানে এই নয় যে, করোনা একদম চলে গেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এখন তেমন কোনো বিধিনিষেধ নেই। অনেকে স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না, মাস্ক পরছেন না। তবে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। এদিকে করোনা সংক্রমণ কমে আসায় নেই কোনো বিধি-নিষেধ। খুলে দেয়া হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীদের আক্রান্ত সংখ্যাও বাড়ছে। কোথাও স্বাস্থ্যবিধি না মানায় শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের গঠিত পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য অধ্যাপক আবু জামিল ফয়সাল বলেন, সংক্রমণের হার কমাতে স্বস্তি রয়েছে, তবে যেভাবে চলাফেরা করছে মানুষ তাতে আবারো আমার ভেতরে সাংঘাতিক আশঙ্কাও রয়েছে। করোনা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। এখনো সংক্রমণের হার পাঁচ শতাংশের নিচে রয়েছে, সংক্রমণ চলছে। আর যে কোনো সংক্রমণশীল রোগের চরিত্রই হচ্ছে যে কোনো সময় এটা আবার বেড়ে যেতে পারে। কেননা, এর মধ্যে হয়তো এই ভাইরাসের স্ট্রেইন বদলাবে, নতুন ভ্যারিয়েন্টও আসতে পারে। তিনি বলেন, আমরা যদি স্বাস্থ্যবিধি ভুলে যাই তাহলে হঠাৎ করে আবার বেড়ে যাবে, তখন আবার সেই আগের অবস্থাতে ফেরত যাব। আবার অক্সিজেন ও আইসিইউ নিয়ে হাহাকার, হাসপাতালে বেড পাওয়া যাবে না, অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে রোগী মারা যাবে, হাসপাতালের বারান্দায় রোগীরা পড়ে থাকবে। আবু জামিল ফয়সাল আরো বলেন, মৌলিক তিন স্বাস্থ্যবিধির ভেতরে প্রথমেই রয়েছে মাস্ক পরা। কিন্তু মাস্কের ব্যবহার কোথাও নেই। ভয় পাচ্ছি-২০২০ সালের জুন-জুলাইতে বা ২০২১ সালের জুন-জুলাইতে পুরোনো চিত্র আবারো দেখতে হয় কিনা। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি ভুলে গেলে তার মাশুল দিতে হবে। এটা যেন আমরা ভুলে না যাই। তাই সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। একই সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে টিকা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে হবে।
মানুষ স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার শঙ্কার কথা জানিয়ে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, সংক্রমণ হার যে কোনো সময়েই বাড়াতে পারে। পৃথিবীর বহুদেশে সংক্রমণ হার এখনো অনেক বেশি। ফলে পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় ভাইরাসের পরিবর্তন হতে পারে। এটা অনবরত পরিবর্তনশীল ভাইরাস। তিনি বলেন, ভ্যারিয়েন্ট বদলাতে পারে, সংক্রমণশীল ভ্যারিয়েন্ট আসতে পারে। এখনো অসতর্ক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই, সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সাবধানে এবং সচেতন থাকতে হবে। সামাজিক অবস্থার চেয়েও ব্যক্তিগত সচেতনতার ওপর বেশি জোর দিতে হবে। বর্তমান স্বস্তি নিয়ে যদি স্বাস্থ্যবিধিতে ঢিলেমি দেয়া হয় তাহলে আবারো বিপর্যয় আসতে পারে। ডা. এ এস এম আলমগীর আরো বলেন, যাদের সুযোগ রয়েছে, তাদের অবশ্যই টিকা নিতে হবে, টিকাও সংক্রমণ কমার অন্যতম কারণ, যদিও একমাত্র নয়। টিকার সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে সংক্রমণের হার পাঁচ শতাংশের নিচে ধরে রাখা সম্ভব, নয়তো যে কোনো সময় এটা বেড়ে যেতে পারে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সঙ্গে সঙ্গে টিকা নেয়ার ওপর জোর দেন তিনি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, জ্বরের মাত্রা ১০০ ডিগ্রির বেশি হলেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হবে। সাধারণ জ্বর ভেবে বসে থাকলে হবে না। করোনা বা ডেঙ্গু কোনোটার আশঙ্কাই উড়িয়ে দেয়া যায় না। ইনফ্লুয়েঞ্জার ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী করাতে হবে র্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা। সঙ্গে ডেঙ্গুরও পরীক্ষা করাতে হবে। কারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা ও কোভিডের উপসর্গ অনেকটা একই। তাই জ্বর হলে কোনোভাবেই অবহেলা করা ঠিক হবে না।
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ