রাজধানীসহ ছোট শহর ও মফস্বল এলাকার কোয়াক ডাক্তারদের সঙ্গে ঢাকার অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের মালিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অলিখিত চুক্তি রয়েছে। তারা জীবন ঝুঁকির ভয় এবং স্বল্প খরচে উন্নত চিকিৎসার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিদিন শতশত রোগী ওইসব চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানে পাঠান।
মার্কেটিং বা সেলস অফিসার নামধারী হাসপাতালের নির্ধারিত দালালরা এ কাজে মধ্যস্বত্বের ভূমিকা পালন করেন। এর বিনিময়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর মোট চিকিৎসা ব্যয়ের অর্ধেক তারা দালালি হিসেবে পান। যা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সপ্তাহান্তে কিংবা মাস শেষে তাদের হাতে তুলে দেয়। কখনো কখনো রোগী বিল পরিশোধ করার সঙ্গে সঙ্গে ‘কেস টু কেস’ এ পেমেন্ট দেয়া হয়। সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে দালালবিরোধী অভিযানে এসব তথ্য উঠে এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সূত্রমতে, গত ২২ ফেব্রুয়ারি হার্টের সমস্যা নিয়ে জন্ম নেয়া শিশু সন্তানের চিকিৎসার জন্য নারায়ণগঞ্জ শহরে একজন চিকিৎসকের কাছে এসেছিলেন বন্দর এলাকার গৃহবধূ নাসরীন আক্তার। বেশকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তিনি জানান, শিশুটির হার্টে ছিদ্র রয়েছে। উন্নত চিকিৎসা করাতে হলে ঢাকার যাত্রাবাড়ীর এক হাসপাতালে কর্মরত একজন প্রখ্যাত শিশু হূদরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখাতে হবে। দ্রুত চিকিৎসা করানো না হলে শিশুর মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে। স্বল্প ব্যয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য ওই চিকিৎসক ঢাকার হাসপাতালের মার্কেটিং ম্যানেজার আব্দুল মতিনের মোবাইল ফোন নম্বরটি দিয়ে দেন তিনি।
পরদিনই ওই গৃহবধূ এক নিকটাত্মীয়কে নিয়ে ঢাকায় ছুটে আসেন এবং নারায়ণগঞ্জের ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী অসুস্থ শিশু সন্তানকে নির্ধারিত হাসপাতালে ভর্তি করেন। তবে হাসপাতালের মার্কেটিং ম্যানেজার যে শিশু হার্ট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের আন্ডারে তাকে চিকিৎসাসেবা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন ৩ দিনেও তার দেখা পাননি। পরে ওই গৃহবধূ খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, তার সন্তানকে যে চিকিৎসক দেখভাল করছেন তিনি সদ্য এমবিবিএস পাস। শিশু হূদরোগ চিকিৎসায় তার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। অথচ এরই মধ্যে কেবিন ভাড়াসহ হাসপাতালের বিল ৩৫ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু হতভাগা ওই মা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেননি ওই টাকার একটা বড় অংশই গিয়েছে নারায়ণগঞ্জ থেকে রোগীকে ঢাকায় পাঠানো চিকিৎসক এবং সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের মার্কেটিং ম্যানেজার আব্দুল মতিনের পকেটে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা সাইনবোর্ড সর্বস্ব বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টারগুলোর হিসাব খাতায় রোগী বাগিয়ে আনার এ কমিশনকে ‘রেফারেল মানি’ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। কেউ কেউ আবার এটিকে ‘বিজনেস ডেভেলপমেন্ট কস্ট’ হিসাবে খতিয়ানে লিপিবদ্ধ করছেন। ওইসব চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান এ টাকার জন্য কৌশলে রোগীদের পকেট কাটছে। কখনো কখনো দামি ওষুধ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ভুয়া বিল যুক্ত করে দেয়া হচ্ছে।
এদিকে উপযুক্ত চিকিৎসক ও চিকিৎসাসেবা না থাকা সত্ত্বেও শুধু নিজেদের কমিশন বাণিজ্য চাঙ্গা রাখতে ওইসব দালালরা নানা ফাঁদ পেতে রাখছে। এতে পা দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার রোগী অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছেন। এমনকি ভুল চিকিৎসায় কখনো কখনো রোগীর মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। তবে মধ্যস্বত্বভোগী ওইসব ডজনখানেক কোয়াক চিকিৎসক ও মার্কেটিং অফিসারের সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে তাদের ন্যূনতম অনুতপ্ত বা লজ্জিত হতে দেখা যায়নি।
বরং এর মাধ্যমে তারা অসহায় মানুষ সেবা দিচ্ছেন বলেও কেউ কেউ গর্ব করেছেন। রাজধানীর মাতুয়াইলের একটি বেসরকারি হাসপাতালের মার্কেটিং অফিসার আবুল হোসেন স্বীকার করেন তিনি একজন মধ্যস্বত্বভোগী। কমিশন নেয়াকে দোষের কিছু মনে করেন না তিনি। তার ভাষ্য, হাসপাতালে রোগী পাঠানোর জন্য তিনি কোনো কমিশন না নিলেও রোগীদের একই খরচ বহন করতে হবে। বরং তার মাধ্যমে রোগীরা কিছু ডিসকাউন্ট (ছাড়) পান।
তাকে কমিশন হিসেবে হাসপাতাল থেকে যে টাকা দেয়া হয় তা ওই প্রতিষ্ঠানের লাভের একটি অংশ বলে দাবি করেন আবুল হোসেন। সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগানোর কাজে জড়িত আব্দুল মোত্তালেব নামের অপর একজন যুবক জানান, শুধু তারা কিংবা কোয়াক ডাক্তাররাই নন, অনেক এমবিবিএস চিকিৎসক ‘রেফারেল মানি’ হিসেবে মোটা অঙ্কের উৎকোচ নিচ্ছেন। রোগী ভাগানোর জন্য বেসরকারি হাসপাতালগুলো সেলস বা মার্কেটিং অফিসার নামে বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষকে নিয়োগ দিলেও তাদের বাইরে সরকারি হাসপাতালের আয়া, বুয়া, নার্স, ওয়ার্ড বয় ও সিকিউরিটি গার্ডসহ অনেকেই এ কাজের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টার থেকে পাওয়া কমিশন এদের সবার মধ্যে নির্ধারিত হারে ভাগ হয়।
চিকিৎসা খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের বেশির ভাগ হাসপাতাল, ক্লিনিক, ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টারই এ দালালচক্রের ওপর নির্ভরশীল। দালালদের কমিশন দেয়া বন্ধ করে দিলে এ ধরনের বেশির ভাগ চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সরল হিসাবে তাদের ৪০ শতাংশ কমিশন দেয়া হলেও কখনো কখনো তা ৫০ শতাংশও ছাড়িয়ে যায়। যার চাপ পুরোটাই রোগীর ঘাড়ে পড়ে। এ কারণে নিম্নমধ্যবিত্ত রোগীরা অনেক সময় সাধারণ চিকিৎসা নিতে গিয়ে হিমশিম খান। অনেক সময় পুরোপুরি চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হওয়াও তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মধ্যস্বত্বভোগীদের কমিশন বন্ধ করে দেয়া গেলে দেশে চিকিৎসার মান অনেক উন্নত হবে এবং রোগীদের চিকিৎসা খরচও অনেক কমবে। তাদের ভাষ্য, দালালদের মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক রোগী ভাগিয়ে এনে যেনতেন চিকিৎসা দিয়ে অর্থ উপার্জন সহজ হওয়ায় অনেকেই এখন হাসপাতাল-ক্লিনিক বাণিজ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এমনকি কোথাও কোথাও রোগী ভাগানো দালালরা কয়েকজন মিলে এ ধরনের চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান খুলে বসেছেন।
হাসপাতাল-ক্লিনিক পরিচালনার জন্য নির্ধারিত চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ড বয় এবং অবকাঠামোগত সুবিধা না থাকা সত্ত্বেও তারা চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের গোপন আঁতাত থাকায় ওইসব চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের কোনো অঘটন না ঘটা পর্যন্ত কোনো ধরনের সমস্যা হচ্ছে না। স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ আব্দুস সবুর বলেন, সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগানো মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ করা গেলে দেশে চিকিৎসা ব্যয় ৫০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব।
তিনি বলেন, বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাত নিয়ন্ত্রণ না করতে পারার একটি কারণ দেশে বিদ্যমান প্রাইভেট হাসপাতালসংশ্লিষ্ট আইন এত বেশি পুরোনো এটা বর্তমান সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিলেও আইনটি বিভিন্ন কারণে আর সংশোধন করা যায়নি। আর এ কারণে এ খাত এখন সম্পূর্ণ অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় আছে, কোনো জবাবদিহিতা নেই। শুধু এ জন্যই দেশের বহু মানুষ আকাশচুম্বী এ চিকিৎসা ব্যয়ের কারণে প্রতি বছর দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে, লাভবান হচ্ছে এক শ্রেণির মানুষ ও মধ্যস্বত্বভোগীরা। এদিকে ডায়াগনোস্টিক সেন্টারগুলোর কমিশন বাণিজ্যে মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হলেও স্বল্প আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। এছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানসম্মত পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে না বললেই চলে।
স্বাস্থ্য খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারি হাসপাতালগুলোর কোথাও কোথাও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল্য তালিকা টাঙানো থাকলেও বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতালে তা চোখে পড়ে না। এতে ফাঁদে পড়েন রোগী ও তার অভিভাবকরা। কেননা চিকিৎসা বিজ্ঞান যত আধুনিক হচ্ছে ততই নানাবিধ পরীক্ষার প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে। আগের মতো রোগীর নাড়ি টিপে কিংবা লক্ষণ বিচার করে রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করা হয় না। বিশেষ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অধিকাংশই এখন একাধিক পরীক্ষা ছাড়া ওষুধ দিতে চান না। শতভাগ সঠিক রোগ নির্ণয় করতে হলে প্যাথলজি ডায়াগনোস্টিক পরীক্ষার ফলাফল জানা আবশ্যক।
আর এ সুযোগে দেশে রোগ নির্ণয় প্রতিষ্ঠানগুলো অলিখিত কমিশন চুক্তির মাধ্যমে রোগীদের পকেটশূন্য করছে। চিকিৎসা ব্যয়ের ১৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসক, স্বাস্থ্য সহকারী, পরিবার পরিকল্পনা কর্মী, রিসিপশনিস্ট ও পেশাদার দালালচক্র হাতিয়ে নিচ্ছে। বেসরকারি স্বাস্থ্য খাত নিয়ে টিআইবির এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রোগ নির্ণয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ডাক্তার ও দালালদের ১৫ থেকে ৫০ ভাগ কমিশন চুক্তি রয়েছে। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক মো. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, উচ্চ মুনাফার জন্য বেসরকারি চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রগুলোতে ব্যবসা চলছে, সেবা গ্রহীতাকে জিম্মি করে অতিরিক্ত মুনাফা আদায় হচ্ছে। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতের বিধিমালা না থাকা এবং আইনের হালনাগাদ না হওয়াকেই স্বাস্থ্য খাতের এ সমস্যার জন্য দায়ী করা হয় প্রতিবেদনে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত চিকিৎসকদের ‘কমিশন ব্যবসা’র কারণে বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যয় সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আকাশ-পাতাল ব্যবধান থাকে। যেসব চিকিৎসক বেসরকারি ক্লিনিক বা ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে রোগী পাঠান, তাদের একেকটি পরীক্ষার মোট চার্জের একটি নির্দিষ্ট শতাংশ কমিশন দেয়া হয়। তাদের এ কমিশন দিয়ে অতিরিক্ত মুনাফা নিশ্চিত করতেই বিভিন্ন পরীক্ষার চার্জ প্রকৃত খরচের চেয়ে অনেকগুণ বেশি নেয়া হয়।
সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দুর্বল মনিটরিং, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিকদের অতিরিক্ত মুনাফা করার প্রবণতা এবং একশ্রেণির চিকিৎসকের ‘কমিশন বাণিজ্যের’ কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণ সহজ-সরল নিরীহ মানুষগুলো এর শিকার হচ্ছেন। এতে করে অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে রোগীর চিকিৎসা ব্যয়। নিয়ন্ত্রণহীন আকাশচুম্বী প্যাথলজি ফির কারণে মধ্যবিত্ত রোগীরা অনেক সময় বিনা চিকিৎসায় জটিল সব রোগে ভোগেন।
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ