২০২১ সাল থেকেই বাড়তে শুরু করে নিত্যপণ্যের দাম। যা ’২২ সালে আরও বেড়ে যায়। ফলে দিশেহারা হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ। এর সঙ্গে বছর শুরুতেই যোগ হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যাতে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আগেই বাড়তে থাকা দ্রব্যমূল্য কয়েকগুণ বেড়ে যায়। আয় ব্যয়ে বড় বৈষম্যে দেখা দেয়। ব্যয় অনুপাতে আয় না বাড়েনি। এদিকে আয়ের অধিকাংশই চলে যায় বাজারে।
সাধারণ ভোক্তারা বলছেন, বছরজুড়েই নিত্যপ্রয়োজনী দ্রব্যমূল্য ছিল ঊর্ধ্বমুখী। একবার কোনো পণ্যের দাম বাড়লে তা আর কমার কোনো নাম নেই। সয়াবিন তেল তো বেশ কয়েকবার দাম বেড়েছে। যা কমেছে তা শুধুই নামের। এছাড়া সব পণ্যই এখন সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। সরকারি হিসাবেই দেশের মূল্যস্ফীতি এক যুগের মধ্যে রেকর্ড গড়েছে। গত আগস্ট মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির পারদ ৯ দশমিক ৫ শতাংশে ওঠে। পরের মাসে তা কমে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ১ শতাংশে। অক্টোবর ও নভেম্বরে তা ৯ শতাংশের নিচে নেমে আসে। যদিও বেসরকারি হিসাবে এই মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে।
ফলে বাধ্য হয়েই সঞ্চয় ভাঙার দিকে ঝোঁকে সাধারণ মানুষ। করোনার সময় থেকেই মানুষের সঞ্চয় কমতে থাকে। তার বড় আঁচড় লাগে সব পণ্যের দাম বাড়লে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২২ অনুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় দেশজ সঞ্চয় কমে আসছে। অর্থাৎ জিডিপি যে হারে বাড়ছে, সঞ্চয় সেভাবে বাড়ছে না। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশজ সঞ্চয় ছিল ২৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে হয়েছে ২১ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
মেয়াদ শেষে সঞ্চয়পত্রের টাকা তুলে নেয়ার হার বেড়ে যায়। অন্যদিকে নতুন করে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ কমে। এর ফলে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণের পরিশোধ বাড়ছে। তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর পাঁচ মাসে এক হাজার ৬১০ কোটি ৯৮ লাখ টাকা বেশি বিনিয়োগকারীদের পরিশোধ করেছে সরকার। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে সরকার মুনাফা ও মূলধন বাবদ পরিশোধ করেছে ৩৬ হাজার ৫৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। আর নতুন করে বিক্রি হয়েছে ৩৪ হাজার ৯৩৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। একক মাস হিসেবে নভেম্বর মাসেও ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নভেম্বর মাসে মুনাফা ও আসল পরিশোধ করা হয়েছে সাত হাজার ৮৬৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা। আর বিক্রি হয়েছে ছয় হাজার ৮৮৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। এক মাসে পরিমাণ গিয়ে দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৯৭৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকায়। এর ফলে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে যে পরিমাণ ঋণ প্রাক্কলন করা হয়েছিল, সেই লক্ষ্য ব্যাহত হওয়ার উপক্রম তৈরি হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণে সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষে মানুষ টাকা তুলে নিচ্ছে, নতুন করে আর বিনিয়োগ করছে না। তবে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে কড়াকড়ি করাও সঞ্চয়পত্র বিক্রির অন্যতম কারণ।
মূল্যস্ফীতির এই প্রভাব পড়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমার কারণ ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত বলেন, এমনিতেই আড়াই বছরের করোনা মহামারির কারণে মানুষের আয়-উপার্জন কমে গেছে। অনেকে চাকরি হারিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। কারও বেতন কমেছে। এরপর শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশে ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক দরপতন হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছে সরকার। বাজারে জিনিসপত্রের দাম এমনিতেই বেশি ছিল। যুদ্ধের কারণে তা আরও বেড়ে গেছে।’
তিনি বলেন, এর ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় অর্থাৎ বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় মানুষের সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমে গেছে। এ কারণে মানুষ আর আগের মতো সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছে না।
এদিকে জিনিসপত্রের দামে বড় ধাক্কা লাগে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যই বলছে, নিত্যপণ্যের বাজারে প্রায় প্রতিটি নিত্যপণ্যেরই বাড়তি দাম। চালের কথা যদি ধরা হয়, মধ্যবিত্ত মানুষ সাধারণত সরু ও মাঝারি চালের ভোক্তা। এ বছরের ২ জানুয়ারি সরু চালের কেজি ছিল ৫৯ থেকে ৬৮ টাকা কেজি। গতকাল তা প্রতি কেজিতে ৩ থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত বেড়ে হয় ৬২ থেকে ৭৫ টাকা। মাঝারি মানের চালও বেড়েছে কেজিতে দুই টাকা।
নয়াশতাব্দী/এমএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ