হারেম শব্দটি শুনলেই প্রথমে চোখে ভেসে ওঠে শত শত সুন্দরী রমণী আর তার মধ্যে কোনো রাজা/সম্রাট নিজের অবৈধ প্রণয় লীলা চালাচ্ছেন। হারেম শব্দটি তুর্কি শব্দ। কেউ কেউ বলেন হারেম শব্দটি আরবি শব্দ হারাম থেকে এসেছে। যার অর্থ নিষিদ্ধ। সহজ ভাষায় হারেম অর্থ মহিলাদের জন্য নির্ধারিত স্থান, যেখানে সাধারণ পুরুষদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ ছিল বলেই সেই সময়কার পুরুষদের কাছে হারেম ছিল অতি আগ্রহের জায়গা।
হারেমের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় তুর্কি সাম্রাজ্যে। মুঘল সাম্রাজ্যের হারেম ও ছিল অতি বিখ্যাত। তবে অন্য সাম্রাজ্যেও হারেম ছিল। ইউরোপ কিংবা চীন সাম্রাজ্যেও হারেমের উল্লেখ পাওয়া যায়। আসলে হারেম প্রায় সব রাজাদেরই ছিল। তবে তুর্কি ও মুঘলদের হারেম ছিল অন্যদের চেয়ে বহুগুণে প্রসিদ্ধ। হারেমে যে কেবল সম্রাটের ভোগ্যপণ্য সুন্দরী রমণী ও রানিরাই থাকত এমন ধারণা একেবারেই ভুল। হারেমে সুন্দরী রমণী নারীরা ছাড়াও সম্রাটের স্ত্রী, মা, মহিলা আত্মীয়, সাদা কালো খোজা যারা ছিল হারেমের পাহারাদার, সম্রাটের অবিবাহিত কন্যারা, এ ছাড়াও সম্রাটের যুবরাজরাও এই হারেমেই বেড়ে উঠতেন। হারেম ছিল একটা ছোটখাটো রাজ্যের মতো। সম্রাটের নিজের লোকজনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা রমণীদের সংখ্যা ছিল ২-৩ হাজারের অধিক। হারেমের দাসী পাহারাদার সব মিলিয়ে গড়পড়তায় একটি হারেমেই লোকজন ছিল প্রায় ৫ হাজারের কাছাকাছি। বিশেষত তুর্কি হারেমে এই সংখ্যাটা বেশিই থাকত। তবে অন্য সম্রাজ্যের হারেমে এই সংখ্যা কিছুটা কম। তবে এর চাইতেও বেশি সংখ্যা পাওয়া পাওয়া যায় দক্ষিণ ভারতের রাজাদের হারেমে। দক্ষিণ ভারতের রাজাদের যৌনদাসীই নাকি থাকত ১০ থেকে ১৫ হাজারের অধিক।
বিশেষ করে তুর্কি হারেম ছিল ছোটখাটো একটা রাজ্যের মতো এই হারেমে স্কুল, দোকান, রসুইঘর, মসজিদ, কারাগার, হামাম, বাগিচা, বস্ত্রালয় ও রত্নশালা প্রায় সবই ছিল। রাজাদের একাধিক পত্নী উপপত্নী থাকবে তখনকার সময়ে এটাই ছিল স্বাভাবিক বিষয়। মুঘল আমলের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, মুঘল সম্রাট আকবরের ছিল ১১ জন স্ত্রী, সম্রাট হুমায়ূনের ছিল ১২ জন, সম্রাট আকবরের ছিল ৪০ জনের অধিক স্ত্রী, সম্রাট জাহাঙ্গীরের ছিল ২৫ জন, সম্রাট শাহজাহানের ছিল ৯ জন, সম্রাট আওরঙ্গজেবের ছিল ৫ জন।
সম্রাটরা প্রতিদিন তাদের হারেম থেকে এক বা একাধিক সুন্দরী রমণী পছন্দ করে নিজের শয্যাসঙ্গী করতেন। এই রমণীরা ছিল দেশ ও পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগমন করা সুন্দরী রূপসী। সম্রাটের শয্যাসঙ্গী হিসেবে হারেম থেকে অগ্রাধিকার পেতেন হারেমে থাকা কুমারী রূপসীরা। সম্রাটের শয্যায় পাঠানোর আগে সেই রমণীকে অন্য দাসী ও নারীরা তাকে দুধ ও গোলাপে স্নান করিয়ে বিভিন্ন অলংকার ও প্রসাধনী ব্যবহার করে এবং দামী বস্ত্র পরিধান করিয়ে তাকে সুসজ্জিত করা হতো। সম্রাটের কাছে কেউ একবার ব্যবহার হয়ে যাওয়া বস্ত্র দ্বিতীয়বার পরিধান করে যেত না। প্রতিবার নতুন বস্ত্র পরিধান করে যেতে হতো।
হারেমের জন্য সুন্দরী রূপসী নারী সংগ্রহ করা হতো কীভাবে? যে সম্রাট বা রাজা বা সুলতান যত বেশি অভিজাত, ক্ষমতাশালী ও অর্থবিত্তের অধিকারী তার হারেমে নারীর সংখ্যাও তত বেশি থাকত। তখনকার রাজা বাদশাহদের আমলে যুদ্ধবিগ্রহ কম-বেশি লেগেই থাকত। আর যুদ্ধে পরাজিতদের স্ত্রী কন্যাকে দাস-দাসী হিসেবে হারেমে নিয়ে আসা হতো। কখনো বিয়ে কিংবা উপঢৌকন হিসেবে কাউকে আনা হতো। কাউকে দাসীরূপে ক্রয় করে আনা হতো। সেই দাসী কালক্রমে জায়গা পেত সম্রাটের হারেমে। এ ছাড়া সম্রাটের কোনো অনুচর তাকে জানাল, অমুক জায়গায় অমুকের একটা সুন্দর মেয়ে আছে। সম্রাট বলে দিতেন ঠিক আছে তাকে হারেমে নিয়ে আস। অনুচরেরা তাকে হারেমে নিয়ে আসত। কিংবা কোনো কৃষক খাজনা দিতে ব্যর্থ হলে খাজনাস্বরূপ তার পুত্র-কন্যাকে তুলে নেওয়া হতো। পুত্রকে দাস হিসেবে রাজার কাজে লাগানো হতো এবং কন্যাকে দাসী হিসেবে হারেমে প্রেরণ করা হতো। এভাবে নানা উপায়ে হারেমে নারী সংগ্রহ করা হতো।
হারেমের ভোজনবিলাস : হারেম হচ্ছে স্বর্গ, সুখের স্বর্গ! সারা দেশে দুর্ভিক্ষ লেগে থাকলেও হারেমে উচ্চাবিলাসী খাবারের অভাব ঘটত না কখনো। তুর্কি হারেমে নাকি রসুইঘরই থাকত ১০টার অধিক। আর সুঅভিজ্ঞ পাচক থাকত ১৫০ এর অধিক। এ ছাড়া জ্বাল, মসলা, জিনিসপত্র এগিয়ে কাটাকুটির জন্য থাকত আরও অনেক ভৃত্য। প্রতিদিন নাকি ২০০ গাড়ি জ্বালানিই লাগত হারেমের উনুন জ্বালানোর জন্য! সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকা হতো সুলতানের খাদ্য সম্পর্কে। সুলতানের রসুইঘর ছিল হারেমের অন্য রসুইঘর থেকে একদম আলাদা। রান্নার অর্ধেক শেষ হলে তা প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হতো, কারণ বাকি কাজ সেখানেই হতো। সবশেষে সুলতান খাবার টেবিলে বসার আগে খাবারে মেশানো হতো বিশেষ মসলা। এরপর সুলতান খেতে বসতেন একা, এরপর খেতেন রানি, দাসি-বাঁদি ও হারেমের রূপসীরা। তারা যা খুশি খেতেন। দেশে লাখো প্রজা হয়তো অনাহারে দিন কাটাচ্ছে কিন্তু হারেমে অঢেল খাদ্য। একটি তুর্কি হারেমে দৈনিক খাবারের ফর্দ ছিল: কচি ভেড়া ২০০টি, ভেড়া ১০০টি, গরু ৪টি, মোরগ ২০০টি, মুরগি ২০০টি, রাজহাঁস ২০টি, কবুতর ২০০টি। এর সঙ্গে ছিল পোলাও, মিঠাই, শরবতসহ আরও অনেক বিলাসী খাবার। প্রতিদিন সে সময়ে হাটেমের একদিনের খাবারের খরচই হতো লাখ টাকার অধিক। আজকের এই দিনে সেই টাকার পরিমাণ কত হতে পারে একবার চিন্তা করে দেখুন তো! এ ছাড়া ভোজন বিলাস ছাড়াও সম্রাট বিনোদনের জন্য হারেমে সংগীত কিংবা নৃত্যের আয়োজনের ও ব্যবস্থাও করতেন।
হারেমের একমাত্র প্রধান আকর্ষণ ছিলেন সম্রাট বা সুলতান। সুলতান একমাত্র পুরুষ যিনি হারেমে প্রবেশ করতে পারতেন। সুলতান ছাড়া অন্য কেউ হারেমে প্রবেশ করলে তার জন্য মৃত্যুদণ্ড ছিল অনিবার্য। সুলতান তার হারেম সুরক্ষিত করতে নিয়োগ করতেন খোজাদের। খোজা মূলত পুরুষ কিন্তু তাদের পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলা হতো। পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলার কারণ হচ্ছে যাতে তারা হারেমের সুন্দরীদের ভোগ করতে না পারে। খোঁজা তৈরি করার জন্য সে সময় ক্রীতদাস ব্যবসায়ীরা ছোট ছেলেদের যৌনাঙ্গ কেটে ফেলত। দেখা যেত একজন খোজা বানাতে গিয়ে ৩০ জনের মৃত্যু হচ্ছে। যেই একজন বেঁচে যেত সেই একজনকে তারা সুলতানের কাছে চড়া দামে বিক্রি করত। এই খোজারা হতেন অনেকটা মেয়েলি স্বভাবের তারা গান, নৃত্য, কবিতা ভালোবাসতেন যেমনটা নারীরা ভালোবাসতেন। নারীদের প্রায় সব স্বভাবই তাদের মধ্যে থাকত। একটি হারেমে খোজা থাকত ১০০ থেকে ১৫০ এর অধিক। খোজাদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ দুই রকমের খোজা ছিল।
শোনা যায়, সুলতানরা নাকি এই শ্বেতাঙ্গ খোজাদের সঙ্গে নিজের বিকৃত যৌনাচারও চালাতেন। মাঝেমধ্যে এই খোজাদের মধ্যে নতুন করে পরুষত্ব জেগে উঠত। তারা লুকিয়ে লুকিয়ে হারেমের রূপসীদের ভোগ করত। হারেমের রূপসীরাও তা গোপন রাখত। হারেমের কোনো খোজার নতুন করে পুরুষত্ব জেগে উঠেছে এমন খবর সুলতানের কাছে গেলে সুলতান তা হেকিমকে দিয়ে পরীক্ষা করতেন এবং আবার তার অস্ত্রোপ্রাচার করাতেন। ফলে দেখা যেত বেশির ভাগ খোজারই মৃত্যু হতো।
হারেমের অন্যতম জায়গা : হারেমের সবচেয়ে অভিনব আয়োজনগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে হামাম। হামাম অর্থ স্নানাগার। এই হামামের ক্ষেত্রে মুঘল কিংবা অন্য সাম্রাজ্যের হামাম থেকে তুর্কি হামামের জৌলুশ ছিল অন্য মাত্রার। তুর্কি হামামের এক প্রত্যক্ষদর্শী বর্ণনা, পৃথিবীতে এমন সুন্দর স্নানঘর দ্বিতীয়টি নেই। স্নানঘরের চারদিকে থাকত জলের ফোয়ারা। জলের নলগুলো থাকত সোনা ও রুপোয় মোড়ানো। পাত্রগুলো থাকত থাকত হীরা ও রৌপ্যমণ্ডিত। সোনা ও রুপার সেই পাত্রে গরম ও ঠান্ডা উভয় জল থাকত। মেঝে থাকত দামি পাথরে মোড়ানো। দেয়ালে থাকত গোপাল ও রকমারি সুগন্ধির উৎস। একবার চোখে দেখলে তার থেকে চোখ ফেরানো ছিল কষ্টকর। একটি হারেমে হামাম ছিল অনেক। হারেমের রূপসীরা সেখানে প্রায় সবাই একসঙ্গে স্নান করতেন। তাদের বেশির ভাগই তখন থাকতেন অর্ধনগ্ন কিংবা পুরোপুরি নগ্ন। সম্রাট/সুলতানরা কখনো কখনো লুকিয়ে লুকিয়ে সেই দৃশ্য উপভোগ করতেন।
হারেমের পরিসমাপ্তি : হারেমের পরিসমাপ্তি ঘটে উনিশ শতকের শুরু দিকে। হারেমে যে সব নারী একবার প্রবেশ করত তাদের বের হওয়ার খুব একটা সুযোগ ছিল না। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের শেষে সমাপ্তি ঘটেছিল মুঘল হারেমের। তার আরও অনেক পরে সমাপ্তি ঘটেছিল তুর্কি হারেমের কামাল পাশার মাধ্যমে। সে সময় নাকি নানা বয়সি প্রায় ৩৭০ জন নারী তুর্কি হারেমে ছিল।
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ