ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রূপে-গুণে অনন্য সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর 

প্রকাশনার সময়: ২০ আগস্ট ২০২২, ১৪:৫৩

দেশের অন্যতম সুন্দর, বড় ও জীব-বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির হাওরও এটি। দেশের বৃহত্তম হাওর হাকালুকির অবস্থান মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলায়। পরিযায়ী পাখি আর দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য টাঙ্গুয়ার হাওর সুন্দরবনের পর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বাংলাদেশের দ্বিতীয় ‘রামসার সাইট’।

রামসার কনভেনশন (ইংরেজি: Ramsar Convention) হলো বিশ্বব্যাপী জৈবপরিবেশ রক্ষার একটি সম্মিলিত প্রয়াস। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ইরানের রামসারে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশসমূহ কনভেনশন অন ওয়েটল্যান্ডস নামক একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। পরবর্তিতে এই চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ মোট ১৫৮টি দেশ স্বাক্ষর করে এবং পৃথিবীর ১৬৯ মিলিয়ন হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ১,৮২৮টি স্থান আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়।

রামসার সাইটে বাংলাদেশের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত স্থান গুলো হলো-

১. সুন্দরবন রিজার্ভ ফরেস্ট

২. টাঙ্গুয়ার হাওর

৩. হাকালুকি হাওর

শীত আর বর্ষা, এ দুই সময়ে হাওরে পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে যায় বহু গুণ। যান্ত্রিকতায় মোড়ানো শহুরে জীবনকে কিছু দিনের জন্য হলেও বিদায় জানিয়ে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় অজানায়। আর সেই অজানা যদি হয় হাওর বেষ্টিত অঞ্চল, তাহলে তো আর কথাই নেই। হাওরের কথা আসলেই প্রথমে পর্যটকের মনে যে নামটি আসে তা হলো টাঙ্গুয়ার হাওর।

টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলার মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০টিরও বেশি ঝরা (ঝরণা) এসে মিশেছে এই হাওরে। একসময় গাছ-মাছ-পাখি আর প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের আধার ছিল এই হাওর। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে টাঙ্গুয়ার হাওরকে 'প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা' হিসেবে ঘোষণা করা হয়, তখনই অবসান হয় দীর্ঘ ৬০ বছরের ইজারাদারির।

২০০০ খ্রিস্টাব্দে ২০ জানুয়ারি এই হাওরকে 'রামসার স্থান' (Ramsar site) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। হাওর এলাকার মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, সম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ড সরকারের মধ্যে ২০০১ খ্রিস্টাব্দে ১২ ফেব্রুয়ারি একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ নভেম্বর থেকে হাওরের নিয়ন্ত্রণ নেয় জেলা প্রশাসন।

শীত মৌসুমে পানি শুকিয়ে কমে গেলে এখানকার প্রায় ২৪টি বিলের পাড় (স্থানীয় ভাষায় কান্দা) জেগে উঠলে শুধু কান্দা'র ভিতরের অংশেই আদি বিল থাকে, আর শুকিয়ে যাওয়া অংশে স্থানীয় কৃষকেরা রবিশস্য ও বোরো ধানের আবাদ করেন। এসময় এলাকাটি গোচারণভূমি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। বর্ষায় থৈ থৈ পানিতে নিমগ্ন হাওরের জেগে থাকা উঁচু কান্দাগুলোতে আশ্রয় নেয় পরিযায়ী পাখিরা রোদ পোহায়, জিরিয়ে নেয়। কান্দাগুলো এখন আর দেখা যায় না বলে স্থানীয় এনজিও ও সরকারি ব্যবস্থাপনায় সেখানে পুঁতে দেয়া হয়েছে বাঁশ বা কাঠের ছোট ছোট বিশ্রাম-দণ্ড।

টাঙ্গুয়ার হাওরকে বলা হয় দেশি মাছের আধার বা ‘মাদার ফিশারিজ’। এ হাওরে আছে প্রায় ১৪১ প্রজাতির বেশি স্বাদু পানির মাছ। এছাড়াও হাওরে ১৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ, প্রায় ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি ও ২১ প্রজাতির সাপ দেখা যায়। অস্তিত্বের হুমকিতে থাকা ২৬ প্রজাতির বন্য প্রাণীর আবাসভূমিও এই হাওর। টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রায়ই দেখা মেলে বিরল প্রজাতির প্যালাসার ফিশ ইগলের।

টাঙ্গুয়ার হাওর মূলত সুনামগঞ্জের ছোট-বড় প্রায় ১২০ টি বিলের সমন্বয়ে গঠিত। তবে প্রধান বিল ৫৪টি। এছাড়াও এ হাওরের ভেতরে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য খাল ও নালা। বর্ষা মৌসুমে সব খাল, বিল ও নালা মিলেমিশে একাকার হয়ে রূপ নেয় সমুদ্রে। তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার ৪৬টি গ্রামসহ পুরো হাওর এলাকার আয়তন প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার, যার ২ লক্ষ ৮০ হাজার ২৩৬ হেক্টরই জলাভূমি।

বর্ষায় দিগন্তবিস্তৃত জলরাশির ওপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে হিজল ও করচ গাছের বাগান। তখন হাওরের গ্রাম গুলোকে মনে হয় ছোট ছোট দ্বীপ। হাওরের উত্তরে সবুজে মোড়া মেঘালয় পাহাড় আর পাহাড়ের পাদদেশে হাওর পারে স্বাধীনতা উপত্যকা, শহীদ সিরাজ লেক, নিলাদ্রী ডিসি পার্ক। হাওরে ঘেরা এ অঞ্চলে সারাদিনই আকাশে শুভ্র মেঘের ওড়া উড়ি চলে। বিকেলের রোদে মেঘের ছায়া পড়ে নীল হয়ে ওঠে হাওরের জল। তখন পুরো এলাকাকে স্বপ্নের মতো মনে হয়।

প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য পর্যটক টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরতে যান। একসময় মনে করা হতো এই হাওরে শুধু বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গেই ঘুরতে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে থাকার জন্য আধুনিক ও আরামদায়ক নৌকা প্রচলিত হওয়ায় এখন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও অনায়াসে এই হাওর ঘুরে আসা সম্ভব। এছাড়া পুরো হাওরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক ভালো। স্থানীয় প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পর্যটকদের জন্য সর্বোচ্চ স্তরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। পুরো হাওরকে দৃষ্টি সীমানায় নিয়ে আসতে রয়েছে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার।

কীভাবে যাবেন :

ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ

প্রতিদিন ঢাকার সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস সরাসরি সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় এবং মহাখালী থেকেও ছেড়ে যায় বাস। সুনামগঞ্জ পৌঁছাতে প্রায় ছয় ঘণ্টা সময় লাগে।

সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ

সিলেটের কুমারগাঁও বাস স্ট্যান্ড থেকে সুনামগঞ্জ যাবার লোকাল ও সিটিং বাস আছে। সুনামগঞ্জ যেতে দুই ঘণ্টার মত সময় লাগবে। অথবা শাহজালাল মাজারের সামনে থেকে সুনামগঞ্জ যাবার লাইট গাড়ি তে ভাড়ায় যাওয়া যায়।

সুনামগঞ্জ থেকে টাঙ্গুয়ার হাওড়

সুনামগঞ্জ নেমে সুরমা নদীর উপর নির্মিত বড় ব্রীজের কাছে লেগুনা/সিএনজি/বাইক করে তাহিরপুরে সহজেই যাওয়া যায়। তাহিরপুরে নৌকা ঘাট থেকে সাইজ এবং সামর্থ অনুযায়ী নৌকা ভাড়া করে বেড়িয়ে আসুন টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে। তবে শীতকালে পানি কমে যায় বলে আপনাকে লেগুনা/সিএনজি/বাইক যোগে যেতে হবে সোলেমানপুর। সেখান থেকে নৌকা ভাড়া করে নিতে পারবেন। আর শীতকালে গেলে আপনি অতিথি পাখির দেখা পাবেন।

নয়া শতাব্দী/জেআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ