ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

হাওড়া ব্রিজে পিলার বা নাট-বোল্ট নেই কেন?

প্রকাশনার সময়: ০৪ জুলাই ২০২২, ১২:০৮

কলকাতার নাম শুনলেই যে কয়েকটি নাম সবার প্রথমে মাথায় আসে, তার মধ্যে হাওড়া ব্রিজ অন্যতম। বহু চলচ্চিত্র এবং টিভি সিরিয়ালে এই সেতুর দেখা মেলে, তা সে বলিউড হোক বা টলিউড। এই সেতু হাওড়া এবং কলকাতার (হাওড়া-কলকাতা সেতু) ধীরে ধীরে পরিবর্তনের সাক্ষী। মানুষ, গাড়ি, গঙ্গার চলাচলের পাশাপাশি কীভাবে শহর কলকাতা উন্নতির পথ ধরে এগিয়ে গেল, তা প্রত্যক্ষ করেছে হাওড়া ব্রিজ।

ভারতের সমস্ত এলাকা ও সৌধের নাম কোনও না কোনও বিখ্যাত মানুষের নামে দেওয়া। ১৯৬৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামানুসারে এই সেতুর নামকরণ করা হয় রবীন্দ্র সেতু। তবে সেই নামকে ছাপিয়ে হাওড়া ব্রিজই লোকের মুখে মুখে ঘোরে।

এই হাওড়া ব্রিজ তৈরির সূচনালগ্ন থেকেই এর সাথে অনেক গল্প মিশে আছে, যা আজও অনেকেরই অজানা।

যখন তৈরি হয় তখন এটি বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম ছিল। বর্তমানে এটি বিশ্বের ষষ্ঠ দীর্ঘতম কান্টিলিভার ব্রিজ। দৈর্ঘ্যে ব্রিজটি ৭০৫ মিটার লম্বা ও চওড়ায় ৭১ ফুট। সঙ্গে পথচারীদের জন্য ১৪ ফুট চওড়া ফুটপাথ দুদিকে।

ইতিহাসে পাওয়া যায়, আজকের হাওড়া ব্রিজ যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেখানে একটি পুরানো সেতু ছিল। যাকে বাংলার মানুষ পুরানো ব্রিজ বলে জানে। সেই সেতুর জায়গায় ১৮৭৪ সালের ১৭ অক্টোবর শুরু হয়েছিল এই হাওড়া ব্রিজের নির্মাণ।

১৮৫৫-৫৬ সালে ব্রিটিশ প্রশাসন প্রথম একটি সেতু তৈরির কথা ভেবেছিলেন। সেই মতো তৈরি হয়েছিল কমিটিও। সেই সময়ে নদীর দু'পাড়েই জাঁকিয়ে বসেছিল ইংরেজরা।

সেতু কমিটি চর্চা শুরু করলেও, কোনও এক অজ্ঞাত কারণে বছর চারেক পরে ১৮৫৯-৬০ সালে সেতু নির্মাণের প্রস্তাব ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

এরপর ১৮৬২ সালে বাংলার সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির চীফ ইঞ্জিনিয়ার জর্জ টার্নবুলকে হুগলি নদীর উপর একটি ব্রিজ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বলায়, তিনি প্রয়োজনীয় নকশা উপস্থাপন করেন। কিন্তু সে সময়ে ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়নি।

এর ঠিক আট বছর পর তৎকালীন বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর সিদ্ধান্ত নেন, সেতু নির্মাণের যাবতীয় দায়িত্ব সরাসরি সরকারের হাতে থাকবে না। ফলস্বরূপ ১৮৭১ সালে তৈরি হয় একটি ট্রাস্ট।

সেই ট্রাস্টের অধীনেই হাওড়ার প্রথম ভাসমান সেতু নির্মাণের ভার দেওয়া হয়। নদীর ওপর ছিল ভাসমান সেতু। নিচে নৌকা, উপরে পাটাতন। মাঝ বরাবর খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা। জাহাজ-স্টিমার চলাচলের জন্য সেতুর মাঝখানে ২০০ ফুট খুলে দেওয়া হতো।

১৮৭১ সালে বাংলার ছোট লাট যখন 'হাওড়া ব্রিজ অ্যাক্ট' তৈরি করেছিলেন, তখনই সেতু পেরোতে টোল বসানো হয়েছিল। টোলের টাকাতেই চলত সেতুর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ। ১৮৭১-এর আইন হওয়ার পর স্যার লেসলিকেই সেতু নির্মাণের ভার দেওয়া হয়।

১৮৭৪ সালে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় সেই সেতু। অর্থাৎ ১৮৫৫ সালে ব্রিটিশ প্রশাসন যা পরিকল্পনা করেছিল, তা রূপায়িত হল ১৯ বছর পর।

তবে এই সেতুর কোনও উদ্বোধন হয়নি। তার কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝেই ১৯৪২ সালে হাওড়া ব্রিজ তৈরির কাজ শেষ হয়েছিল। এবং ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিজটি জনগণের ব্যবহারের জন্য খুলে দেওয়া হয়। তবে এই বিষয়টিকে সারা বিশ্বের সামনে গোপন রাখা হয়েছিল। কারণ ইতিমধ্যে জাপান পার্ল হারবারে বোমা ফেলেছিল। এই ব্রিজের কথা জানলে যদি এটিকেও টার্গেট করা হয়, সেই ভেবেই ঘটা করে উদ্বোধন না করে ব্রিজটি খুলে দেওয়া হয়।

এছাড়াও, ব্রিটিশ ভারতে কোনও কিছু তৈরি করতে হলে শুধু কাঁচামাল নয়, পুরো তৈরি প্রোডাক্টই জাহাজে চাপিয়ে ভারতে আনা হতো। তারপর এখানে এনে জুড়ে দেওয়া হতো। ব্রিজের সরঞ্জাম ইংল্যান্ড থেকে কলকাতা আসার কথা ছিল। সেজন্য প্রয়োজন ছিল ২৬ হাজার টন স্টিল। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলায় সেই জাহাজ ঘুরিয়ে নেওয়া হয়। মাত্র তিন হাজার টন কাঁচামাল ইংল্যান্ড থেকে সাপ্লাই হয়েছিল। বাকী ২৩ হাজার টন কাঁচামাল বা স্টিল সরবরাহ করেছিল ভারতের টাটা স্টিল কোম্পানি। এমনকী নতুন ব্রিজ তৈরির সময়ে স্থানীয় ইঞ্জিনিয়ারদের সাহায্যেই কাজ হয়েছিল।

শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও হাওড়া ব্রিজের মতো সুবিশাল ব্রিজ তৈরিতে একটিও নাট-বোল্ট লাগাতে হয়নি। মেটাল প্লেটগুলিকে এমনভাবে বসিয়ে চেপে দেওয়া হয়েছে যাতে কোনও নাট-বোল্ট ও স্ক্রু ছাড়াই এত বড় ব্রিজ সফলভাবে জুড়ে দেওয়া গিয়েছে।

এছাড়াও, হাওড়া ব্রিজের ছবি ভালো করে দেখলে দেখবেন, কোনও পিলার বা স্তম্ভ ছাড়াই ব্রিজটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। এটিকে বলা হয় সাসপেন্ডেড-টাইপ ব্যালান্সড কান্টিলিভার ব্রিজ।

হাওড়া ব্রিজে প্রতিদিন লাখো লোক হেঁটে অথবা গাড়ি-বাসে যাতায়াত করেন। তবে ব্রিজ তৈরি হওয়ার পর প্রথম যুগে কলকাতা ও হাওড়ার দুদিক থেকেই লোককে পার করার জন্য ট্রাম ব্রিজের উপরে চলাচল করত। বস্তুত, প্রথম যে গাড়িটি ব্রিজে চলেছিল সেটি ট্রামই ছিল। তবে বাড়তে থাকা ট্রাফিকের চাপে ১৯৯৩ সালে ট্রাম চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।

হাওড়া ব্রিজ সম্ভবত বিশ্বের ব্যস্ততম কান্টিলিভার ব্রিজ। দিনে ১ লক্ষ গাড়ি-ঘোড়া ও দেড় লক্ষ মানুষ হেঁটে এই ব্রিজের উপর দিয়ে যাতায়াত করে। ১৯৪৬ সালে দিনে ২৭ হাজার গাড়ি, ১ লক্ষ ২১ হাজার পথচারী ও ৩ হাজার গরুর গাড়ি নবনির্মিত হাওড়া ব্রিজের উপর দিয়ে যাতায়াত করত।

আদি কলকাতার স্বাদ পেতে গেলে একবার না একবার হাওড়া ব্রিজে আসতেই হবে। ব্রিজের উপরে উঠে গঙ্গার দৃশ্য ভোলার নয়। হাওড়ার দিক থেকে হোক অথবা কলকাতার দিক থেকে, হাওড়া ব্রিজকে দেখতে অসাধারণ লাগে। ইংরেজ আমলে তৈরি হলেও এই ব্রিজটি ভারতীয়ত্বের প্রতীক।

হাওড়া ব্রিজ পরিদর্শনের সঠিক সময় হল ভোর বেলায়। অন্ধকার নামার পরেও এই ব্রিজের আলোকসজ্জা দেখার মত হয়। দিনের বিভিন্ন সময় এই ব্রিজ বিভিন্ন রূপ ধারণ করে।

নয়া শতাব্দী/ এডি

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ