আপনি যে বাংলাদেশের নাগরিক, আপনার সে পরিচয় বহন করে জাতীয় পরিচয়পত্র। দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন কর্ম সম্পাদনে পরিচয় সংক্রান্ত প্রমাণাদির সাপেক্ষে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় নথি এটি। দেশের নাগরিক হিসেবে সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার জন্য হোক কিংবা দেশ ছাড়ার অনুমতির জন্য পাসপোর্ট বানানোর জন্য সকল ক্ষেত্রে আপানার এই নথি থাকা আবশ্যক। জাতীয় পরিচয় পত্র না থাকলে আপনি বাংলাদেশের নাগরিক বলেই গণ্য হবেন না।
বাংলাদেশে ২০০৮ সাল থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া শুরু হয়। অনেকে জানেন না কীভাবে নতুন ভোটার হতে হয়। তবে জাতীয় পরিচয়পত্র থাকা স্বত্তেও অনেক সময় অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এই যেমন প্রায়শই কার্ডে নানা ভুল তথ্য চলে আসে, কারো আবার পকেটমার কিংবা ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে হারিয়ে যায়।
কিন্তু হারিয়ে ফেলা হোক কিংবা ভুল তথ্য থাকা, জাতীয় পরিচয় পত্রে ছোট ছোট ভুলের জন্য পরতে হয় বড় বিপদে। এমনকি ছোটখাট হয়রানি থেকে একদম আইনি ঝামেলারও অবতারণা হতে পারে।
আমাদের আজকের প্রতিবেদনে আমরা জানবো কীভাবে নতুন ভোটার হওয়া যায়, জাতীয় পরিচয়পত্র হারিয়ে গেলে করণীয় কী, অনলাইনে ভোটার হতে চাইলে কী করতে হবে, জাতীয় পরিচয়পত্রে তথ্য ভুল হলে সংশোধন করা যায় কীভাবে এবং জাতীয় পরিচয়পত্র হারিয়ে গেলে কি করতে হবে?
নতুন ভোটার হতে যা লাগবে
আপনার বয়স যদি আঠার পূর্ণ হয় তবেই আপনি ভোটার হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন। সাধারণত প্রতি তিন বছর পর পর আদম শুমারীর মাধ্যমে নতুন ভোটার নিবন্ধন করা হয়। সেই সময় নির্বাচন কমিশনের লোকজন বাড়ী বাড়ী গিয়ে নতুন ভোটারের তালিকা করে থাকেন।
যারা বাদ পড়েন তারা অনলাইনে আবেদন করে নতুন ভোটার হতে পারে। নির্বাচন কমিশন প্রতি বছর জানুয়ারী মাসের শেষে নতুন ভোটারের তালিকা প্রকাশ করে থাকে।
নতুন ভোটার হওয়ার জন্য নির্বাচন অফিসে জন্ম সনদ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) অথবা এসএসসি বা সমমান পরীক্ষা বা যেকোনো পাবলিক পরীক্ষা পাসের সনদের ফটোকপি; নাগরিক সনদ, প্রত্যয়নপত্র/বাড়ি ভাড়া/হোল্ডিং ট্যাক্স/যেকোনো ইউটিলিটি বিল পরিশোধের রসিদের কপি জমা দিয়ে নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হবে।
অনলাইনে ভোটার হতে চাইলে
কেউ যদি লাইনে দাঁড়িয়ে ভোটার হওয়ার আবেদন করতে না চান তাহলে অনলাইনেও আবেদন করতে পারেন। নতুন ভোটার হিসেবে নিবন্ধন করতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের services.nidw.gov.bd এই ঠিকানায় লগ অন করতে হবে। এরপর ফরম ডাউনলোড ক্যাটাগরিতে ক্লিক করে ফরমটি ডাউনলোড করে ভালভাবে পূরণ করতে হবে।
এক্ষেত্রে আপনার লাগবে এসএসসি সনদ - (বয়স প্রমানের সনদ), জন্ম নিবন্ধন - (বয়স প্রমানের সনদ), পাসপোর্ট / ড্রাইভিং লাইসেন্স / টি.আই.এন - (বয়স প্রমানের সনদ), ইউটিলিটি বিলের কপি/বাড়ী ভাড়ার রশিদ/হোল্ডিং ট্যাক্স রশিদ – (ঐ এলাকায় সচরাচর বসবাস করেন এরূপ কোন প্রমান), নাগরিকত্বের সনদ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) বাবা, মা, স্বামী/স্ত্রীর আই.ডি কার্ডের কপি (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)
যে ভাবে ফরম পূরণ করবেন...
* ধাপে ধাপে সকল তথ্য সঠিকভাবে পূরণ করতে হবে।
* নিজের পূর্ণ নাম ছাড়া সকল তথ্য বাংলায় ইউনিকোডে পূরণ করতে হবে।
* সকল ধাপ সম্পন্ন হবার পরে প্রিভিউ এর মাধ্যমে সকল তথ্য পুনরায় যাচাই করে নিতে হবে।
* পিডিএফ ফাইল তৈরি করে সেটি প্রিন্ট করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ নিকটস্থ নির্বাচন অফিসে জমা দিতে হবে।
* আপনার প্রদত্ত তথ্যাদি যাচাই এবং ঠিকানা যাচাইয়ের পরে তথ্যাদি সঠিক নিশ্চিত হলে আপনার কার্ড তৈরি হবে।
* কার্ডের রশিদ জমা দিয়ে কার্ড সংগ্রহ করতে হবে।
প্রয়োজনীয় তথ্য
ফরম পূরণের আগে সকল তথ্য সাথে রাখুন ফরমের সাথে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের কপি জমা দিন।
এনআইডির ওয়েবসাইটে গিয়ে সেবা নেবেন যেভাবে
এনআইডি উইংয়ের ওয়েবসাইটে (https://services.nidw.gov.bd) গিয়ে অনলাইনে এই সেবা পাওয়া যাবে। এই ওয়েবসাইটে গিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি সংগ্রহ (ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছেন কিন্তু এনআইডি কার্ড পাননি), জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর সংগ্রহ, জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন, হারানো জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য আবেদন এবং নতুন ভোটার নিবন্ধন করা যাবে।
এসএমএসের মাধ্যমে এনআইডি নম্বর
মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এনআইডি নম্বর পেতে হলে প্রথমে nid<formNo><dd-mm-zzzz> লিখে ১০৫ নম্বরে এসএমএস পাঠাতে হবে। ফিরতি এসএমএসের মাধ্যমে এনআইডি নম্বর পাবেন ভোটার।
নতুনদের এনআইডি কপি সংগ্রহ
সর্বশেষ হালনাগাদ করা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া ভোটারের মধ্যে যারা কার্ড পাননি, তারা তাদের নিবন্ধন ফরম নম্বর ও জন্ম তারিখ দিয়ে অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করবেন। বায়োমেট্রিক তথ্য যাচাই শেষে এনআইডি কপি বা নম্বর পাবেন তারা। তবে দ্বৈত ভোটার হলে এনআইডি কপি বা নম্বর পাওয়া যাবে না।
এনআইডি নম্বর পেতে হলে
যারা রেজিস্ট্রেশন করেছেন কিন্তু এনআইডি কার্ড পাননি তারা (https://services.nidw.gov.bd) ওয়েবসাইটে ‘অন্যান্য তথ্যের’ ট্যাবে গিয়ে এনআইডি নম্বর লিংকে ফরম নম্বর ও DOB (Date of Birth) দিলে এনআইডি নম্বর পাবেন।
নতুন ভোটারদের অনলাইনে এনআইডি পেতে চাইলে
যারা এনআইডি নম্বর পেয়েছেন তারা (https://services.nidw.gov.bd) ওয়েবসাইটে তথ্য ও মোবাইল নম্বর দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে লগইন করতে পারবেন। লগইনের পর আবেদনকারী তার ফরমের এন্ট্রি করা সকল ডাটা দেখতে পাবেন। রেজিস্ট্রেশন করা ব্যক্তি যদি আগে কার্ড না পেয়ে থাকেন, তিনি এনআইডি ডাউনলোড করতে পারবেন।
জাতীয় পরিচয়পত্রে তথ্য ভুল হলে যেভাবে সংশোধন করবেন
এখন অনলাইনেই তথ্য সংশোধন করার সুযোগ রয়েছে। শুরুতেই এনআইডি পোর্টালে ঢুকে একটি অ্যাকাউন্ট তৈরি করতে হবে।
সেখানে এনআইডি নম্বরটি দরকার হবে। অ্যাকাউন্টে ঢুকলে সেখানে লিংক পাবেন অনলাইনে অর্থ পরিশোধের।
ওকে ওয়ালেট ও রকেটের মাধ্যমে নির্ধারিত ফি পরিশোধ করা যায়। সোনালি ব্যাংকের মাধ্যমেও পরিশোধ করতে পারেন।
জাতীয় পরিচয়পত্রে যেসব তথ্য লেখা থাকে সেগুলোর যেকোনো একটি সংশোধন করতে চাইলে প্রথমবার আবেদনের জন্য ২০০ টাকা, দ্বিতীয়বার ৩০০ টাকা এবং পরবর্তী যতবার আবেদন করবেন ৪০০ টাকা ফি দিতে হবে।
এছাড়া আরও কিছু তথ্য রয়েছে যেগুলো পরিচয়পত্রে লেখা থাকে না। সেগুলোও সংশোধন করা যায়।
সেক্ষেত্রে প্রথমবার ১০০ টাকা, দ্বিতীয়বার ৩০০ টাকা এবং পরবর্তীতে প্রতিবার ৩০০ টাকা ফি দিতে হবে।
জাতীয় পরিচয়পত্র হারিয়ে গেলে যা করবেন
থানায় জিডি (জেনারেল ডায়েরি) করা
জাতীয় পরিচয়পত্র হারানোর সাথে সাথেই সর্বপ্রথম যে কাজটি করণীয় তা হচ্ছে নিকটস্থ থানায় তা লিখিতভাবে জানানো বা একটি সাধারণ ডায়েরি করা। থানা কর্তৃক জিডি গৃহীত হওয়ার পর জিডি গ্রহণকারী পুলিশ কর্মকর্তার নাম ও ফোন নম্বর সংগ্রহ করতে হবে। কেননা জিডির কপিটির সাথে এই তথ্যগুলোও পরবর্তীতে প্রয়োজন হবে।
অনলাইনে জাতীয় পরিচয়পত্র রি-ইস্যুর জন্য আবেদন
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের আওতাভুক্ত জাতীয় পরিচয়পত্র সেবার ওয়েবসাইট বা এনআইডি উইংয়ে গিয়ে অনলাইন নিবন্ধন করতে হবে। ইতোমধ্যে নিবন্ধিত হয়ে থাকলে এনআইডি নাম্বার ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগ ইন করা যাবে। আর পাসওয়ার্ড ভুলে গেলেও সমস্যা নেই। পাসওয়ার্ড রিসেট করে নতুন পাসওয়ার্ড সেট করে পুনরায় অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করা যাবে।
যাবতীয় ব্যক্তিগত তথ্য প্রদান করে নিবন্ধনের সম্পন্ন করার পর ফেইস ভেরিফিকেশন হবে। এই প্রক্রিয়া সফলভাবে সম্পন্ন হলেই পুনরায় লগ ইন করতে অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করা যাবে।
অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করলেই পাওয়া যাবে রিইস্যু অপশনটি। এতে ক্লিক করার পর পাওয়া যাবে জাতীয় পরিচয়পত্র রিইস্যু করার আবেদন ফর্ম। ফর্মটি যথাযথভাবে পূরণ করে সাবমিটের পর আসবে ফি প্রদানের সেকশন। এখানে জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে পাওয়ার জন্য বিতরণের ধরন (রেগুলার অথবা আর্জেন্ট) নির্বাচন করতে হবে। অতঃপর ফি প্রদান করার পর পরের স্ক্রিণে আসবে জিডির সেকশন।
এখানে থানা থেকে নিয়ে আসা জিডির কপিটি স্ক্যান করে আপলোড করতে হবে। মোবাইল দিয়ে ছবি তুলে আপলোডের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যেন জিডির লেখাগুলো স্পষ্ট বোঝা যায়। জিডির যাবতীয় তথ্যাবলি প্রদান করা হলে চুড়ান্তভাবে আবেদনটি সম্পন্ন হয়ে যাবে।
জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে পাওয়া
সাধারণত অনলাইনে আবেদন জমা দেয়ার সাত থেকে পনের দিনের মধ্যে আবেদনটির অনুমোদন হয়ে যায়। জাতীয় পরিচয়পত্র রি-ইস্যুর আবেদন অনুমোদিত হলে আবেদনের সময় সরবরাহকৃত মোবাইল নাম্বারে একটি বার্তা দেয়া হবে। বার্তাটি পাওয়ার সাথে সাথেই এনআইডি উইংয়ে পুনরায় লগ ইন করে জাতীয় পরিচয়পত্র ডাউনলোড করে নিতে হবে। নতুবা নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে গেলে আর ডাউনলোড করা যায় না।
জাতীয় পরিচয়পত্রের এই অনলাইন কপি পরবর্তীতে প্রিন্ট ও লেমিনেটিং করে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
২০১৯-এর পর যাদের অনলাইনে জাতীয় পরিচয়পত্র হয়েছে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র হারিয়ে গেলে, এই এনআইডি উইংয়ে লগ ইন করে বিনামূল্যেই জাতীয় পরিচয়পত্রটি ডাউনলোড করে নেয়া যাবে।
২০১৯-এর আগের ভোটারদের ক্ষেত্রে অথবা যারা ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন থেকে স্মার্ট কার্ড পেয়েছেন, তারা এই পোর্টাল থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র ডাউনলোড করতে একটি নির্দিষ্ট ফি দিতে হবে।
জেনে রাখা ভালো--
স্মার্ট কার্ড হাতে পাওয়ার জন্য সরাসরি নির্বাচন কমিশনের স্থানীয় কার্যালয় থেকে সংগ্রহ করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। সেক্ষেত্রে জিডির কপিটি নিয়ে সরাসরি চলে যেতে হবে থানা বা উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ে। অতঃপর আবেদন করতে হবে পরিচালক বরাবর।
জাতীয় পরিচয়পত্র রি-ইস্যু ফি
হারানো জাতীয় পরিচয়পত্র উত্তোলন করতে বা রি-ইস্যুর জন্য আবেদন ফি সাধারণের ক্ষেত্রে ভ্যাট সহ ৩৪৫ টাকা। আর জরুরি ক্ষেত্রে ভ্যাট সহ দিতে হবে ৫৭৫ টাকা। ২০১৯ এর আগের ভোটারদের এনআইডি উইং থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র ডাউনলোড করতে ২৩০ টাকা দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র রি-ইস্যুর আবেদন করতে হবে।
এই টাকা দেশের মোবাইল ব্যাংকিং সেবাগুলো যেমন রকেট, বিকাশ ব্যবহার করে অনায়াসেই পরিশোধ করা যেতে পারে।
এভাবে অনলাইনের মাধ্যমে খুব সহজেই হারানো জাতীয় পরিচয়পত্র ফিরে পাওয়া যায়। তবে এই ঝামেলা পোহাতে না চাইলে প্রথম থেকেই সতর্ক হওয়া উচিত। এখন ব্যাংকের লেনদেন, পাসপোর্ট, বিভিন্ন লাইসেন্স প্রতি ক্ষেত্রেই যুক্ত হয়ে পড়ছে জাতীয় পরিচয়পত্র। তাই নিদেনপক্ষে জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম্বারটি আলাদা করে মোবাইল লিখে রাখা যেতে পারে। একাধিক জায়গায় বিশেষ করে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে (গুগল ড্রাইভ, ড্রপ বক্স, ওয়ান ড্রাইভ) সংরক্ষণ করা থাকলে বিভিন্ন কাজের সময় নাম্বারটা ব্যবহার করা যেতে পারে।
নয়া শতাব্দী/ এডি
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ