ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

হিমালয়ের রহস্যময় ইয়েতি (পর্ব: ১)

প্রকাশনার সময়: ১৯ এপ্রিল ২০২২, ১৩:১১

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু সিরিজের পাহাড়চূড়ায় আতঙ্ক যারা পড়েছেন অথবা এই গল্প অবলম্বনে ২০১৭ সালে সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ও প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘ইয়েতি অভিযান’ সিনেমা যারা দেখেছেন তাদের ‘ইয়েতি’ সম্পর্কে জানার কথা। কাকাবাবু হিমালয়ে কী খুঁজে পেয়েছেন, সেটা না হয় বই বা সিনেমা দেখে জানা যাবে। তবে, এই প্রতিবেদনের প্রথম পর্বে হিমালয়ের জনমানবহীন তুষারঢাকা অঞ্চলে বাস করা কথিত ভয়ংকর এই ইয়েতি জীবটির খোঁজ করা যাক।

ব্যুৎপত্তিগতভাবে ইয়েতি মূলত তিব্বতি শব্দ। ইংরেজিতে যাকে দেয়া হয়েছে গালভরা একটি প্রতিনাম— অ্যাবোমিনেবল স্নোম্যান। এই ইয়েতি হচ্ছে হিমালয় পর্বতমালার দুর্গম অঞ্চলে বাস করা এক শ্রেণির দ্বিপদী প্রাণী। স্নোম্যান বা তুষারমানব নাম হওয়ার কারণ ইয়েতি দেখতে অনেকটা মানুষের মতোই। নেপালি টাইমস এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, রহস্যময় এই প্রাণীটির দেহ ধূসর-কালো বা লালচে-বাদামি পশমে ঢাকা, দৈহিক গঠন বলিষ্ঠ। এখন পর্যন্ত অনেক মানুষই ইয়েতিকে দেখেছেন বলে দাবি করলেও বাস্তবে ইয়েতির সন্ধান আজ পর্যন্ত কেউ পায়নি। সেদিক থেকে বলতে গেলে ইয়েতির ধারণাটি একটি মিথ। তবে হিমালয় অঞ্চলে অনেক সময় বিশালাকৃতির পায়ের ছাপ, শরীরের পশম ইত্যাদি পাওয়া গেলেও সেগুলোর বেশিরভাগ ছিল তুষার ভাল্লুকের। কিন্তু একই রকম কিছু আবিষ্কারের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা পুরোপুরি ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি বলে ইয়েতির অস্তিত্ব একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। হিমালয়ের বিশালতার কোনো এক অংশে হয়তো প্রাণীটি মনুষ্য সমাজের চোখ ফাঁকি দিয়ে বহাল তবিয়তে এখনো টিকে রয়েছে, আবার হয়তো বাস্তবিক অর্থেই ইয়েতি বলে কোনোকালেই কিছু ছিল না, বরং এটি হিমালয়ে বাস করা শেরপাদের একান্ত নিজস্ব ড্রাকুলার গল্প।

ইয়েতির আদি উৎস তিব্বত ও নেপালের হিমালয় অঞ্চলে বাস করা শেরপাদের লোকগাথা। মূলত তিব্বত অঞ্চলেই ইয়েতি মিথের প্রথম উৎপত্তি। পরে শেরপাদের মাধ্যমে তা নেপালে ছড়িয়ে পড়ে। শেরপাদের এসব লোকগল্প সংগ্রহ করেছেন শিব ধাকাল নামের একজন লেখক। ১২টি গল্পের এই সংগ্রহটির নাম ফোক টেইলস অব শেরপা অ্যান্ড ইয়েতি। শেরপাদের এই গল্পগুলোতে ইয়েতিকে সবসময় ভয়ংকর প্রাণী হিসেবে দেখা হয়েছে। কখনো ইয়েতিকে অনিষ্টকারী হিসেবে, কখনো দুর্ভোগের উৎস হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। এমনকি একটি গল্পে তো ইয়েতিকে ধর্ষণকারী হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে! এসব গল্পে ইয়েতিকে প্রতিকূল চরিত্র হিসেবে বিচার করার কিছু কারণ রয়েছে। প্রত্যেক গোষ্ঠীরই এরকম কিছু কাল্পনিক চরিত্র থাকে, যা ভয়ের উদ্রেক করে, মানুষের চোখে সেগুলো জুজুর মতো কাজ করে। ইয়েতি হচ্ছে শেরপাদের সেই জুজু। শেরপারা হিমালয়ের দুর্গম তুষারাবৃত অঞ্চলে ঘুরে বেড়ায় তাদের জীবিকার জন্য। এসব অঞ্চলে রয়েছে পদে পদে মৃত্যুর হাতছানি। তুষারধস, বরফের চোরা গর্ত এসব তো আছেই, পাশাপাশি রয়েছে জন্তু-জানোয়ারের আক্রমণের ভয়। এই আক্রমণকারী জানোয়ারদের কাছ থেকে সাবধান থাকার জন্য শেরপাদের যে জুজুর ভয় দেখানো হয়, তা হচ্ছে ইয়েতি। ধাকালের মতে, এই জুজুর সৃষ্টির পেছনে হয়তো এমন উদ্দেশ্য ছিল যে, শেরপাদের সন্তানরা যেন তাদের আবাসস্থল ছেড়ে দূরে কোথাও চলে না যায়। কারণ বরফের বিশাল প্রান্তরে একবার হারিয়ে গেলে তার আর ঘরে ফেরার কোনো উপায় নেই। সুতরাং, শেরপা শিশুদের যদি ইয়েতির ভয় দেখানো যায়, তাহলে তারা নিশ্চয়ই ঘর থেকে দূরে পা ফেলতে কিছুটা সাবধানতা অবলম্বন করবে।

দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটও ইয়েতির খোঁজ করেছিলেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে তিনি সিন্ধু উপত্যকা জয়ের সময় ইয়েতির গল্প শুনে ইয়েতি দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্থানীয়রা তাকে জানিয়েছিল, ইয়েতি কম উচ্চতায় বেঁচে থাকতে পারে না, তাই তাদের পক্ষে ইয়েতি ধরে সম্রাটের সামনে হাজির করা সম্ভব নয়। গবেষক মিরা শ্যাকলি তার স্টিল লিভিং? ইয়েতি, সাসকোয়াচ, অ্যান্ড দ্য নিয়ান্ডারথাল এনিগমা (১৯৮৩) বইতে দুইজন হাইকারের ইয়েতি দর্শনের বর্ণনা দিয়েছেন। ১৯৪২ সালের কোনো একদিন ওই দুই হাইকার তাদের থেকে সিকিমাইল দূরে বরফের ওপর দুটো কালো বিন্দু চলাচল করতে দেখেছেন। এত দূর থেকে দেখার পরও তারা খুব স্পষ্ট বিবরণ দিয়েছিলেন: উচ্চতা একেবারে আট ফুটের কম ছিল না। চৌকো মতন মাথা। লালচে বাদামি অধোমুখী পশম। আরেকজন ব্যক্তির দর্শনলাভের অভিজ্ঞতা মোতাবেক, ইয়েতির আকার গড়পড়তা মানুষের মতোই। মাথাভর্তি লম্বা চুল থাকলেও মুখমণ্ডল আর বুকে লোমের বালাই নেই বললেই চলে। লালচে-বাদামি দু’পেয়ে প্রাণীটি মনোযোগ দিয়ে শেকড় তুলছিল আর সময়ে সময়ে চড়া ও তীক্ষ গলায় কান্না করছিল।

পর্বতারোহী রাইনহোল্ড মেসনার ১৯৮৬ সালে একটা বিশেষ রুট ধরে চলছিলেন। সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে। জঙ্গুলে খাড়াই বেয়ে ওঠার সময় হঠাৎ তার সামনে বিশাল ও কালো রঙের কিছু একটা উদয় হলো। বিস্মিত মেসনার দেখলেন প্রাণীটি দৌড়ে এক গাছ থেকে আরেক গাছের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। তার দৌড়ানোর ভঙ্গি মানুষের মতোই, কিন্তু স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে অনেক দ্রুত। গাছের শাখা-প্রশাখা বা বরফের ওপর থাকা গর্ত কিছুকেই পরোয়া করছে না। দশ গজের মতো গিয়ে প্রাণীটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ল এবং তারপরই মেসনারের চোখের সামনে হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেল। রাতে চাঁদের আলোয় সেটিকে আবারো দৌড়াতে দেখেন মেসনার। সাত ফুটের চেয়েও বেশি লম্বা, বলিষ্ঠ ও চটপটে শরীর। ছোট ছোট পা, পশমে ঢাকা দেহ আর লম্বা, শক্তিশালী হাতওয়ালা প্রাণীটি রাগান্বিত স্বরে শব্দ করছিল। সেই রাতে আবারো গাছপালার আড়ালে হারিয়ে যায় প্রাণীটি।

১৯৮৬ সালে অ্যান্থনি উলরিজ নামক আরেকজন হাইকার ইয়েতি দেখেন বলে দাবি করেন। তিনি দেড়শ’ মিটার দূর থেকে একটি ইয়েতিকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন। তিনি দুটো ছবিও তুলে নেন। সেই ছবি পরখ করে দেখা গেল, সেগুলো কোনো মেকি ছবি নয়।

ইয়েতির অস্তিত্বে বিশ্বাসী মানুষদের মধ্যে ছবিজোড়া ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। পরের বছর গবেষকরা উলরিজের ইয়েতি দর্শনের স্থানে গিয়ে বুঝতে পারেন, উলরিজ আসলে একটি পাথুরে-পৃষ্ঠের ওপরের অংশ দেখতে পেয়েছিলেন। ২০১৯ সালে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতীয় সেনাবাহিনী দাবি করে, তারা ওই বছরের ৯ এপ্রিল ইয়েতির পায়ের ছাপ দেখতে পেয়েছে। এমনকি সে সময় তারা নিজেদের টুইটারে ইয়েতির পায়ের ছাপের ছবিও প্রকাশ করে।

নয়া শতাব্দী/এম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ