ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬
স্যার উইনস্টন চার্চিল

সেনা সদস্য থেকে প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশনার সময়: ১৫ জানুয়ারি ২০২২, ১০:০৯ | আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২২, ১০:১২

রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার আগে তারা ছিলেন অন্য পেশায়। রোজগারও ছিল সামান্য। কেউ ছিলেন বাদাম বিক্রেতা, কেউবা করেছেন পোস্টমাস্টারের কাজ, কেউবা ছিলেন প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিক্ষক ও খেলোয়াড়সহ বিভিন্ন পেশায়। সাধারণ মানুষ থেকে রাষ্ট্রপ্রধানদের প্রতিবেদনের আজ ১৪তম পর্বে পড়ুন সাংবাদিক ও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সদস্য থেকে দেশটির দুইবারের প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টন চার্চিলের ইতিহাস।

দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডশায়ারে ১৮৭৪ সালের ৩০ নভেম্বর দাদার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন উইনস্টন লিওনার্ড স্পেন্সার চার্চিল। দাদা জন স্পেন্সার চার্চিল ছিলেন সে সময়কার ডিউক। বাবা বিখ্যাত রাজনীতিবিদ লর্ড র‌্যান্ডলফ চার্চিল ও মা জেনি জেরোমের দুই ছেলের মধ্যে উইনস্টন চার্চিলই বড়। ছোট ভাই জ্যাক চার্চিল মিলিটারি অফিসার ছিলেন। উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, চার্চিলের শৈশব, কৈশোর দুই-ই কাটে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন শহরে। ইতিহাসের সফলতম এ রাষ্ট্রনায়ক ছাত্র হিসেবে সাফল্য লাভ করেননি। স্কুলের গণ্ডি পেরুতে তাকে তিনটি স্কুল বদলাতে হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই তিনি স্বাধীনচেতা ও বিদ্রোহী স্বভাবের ছিলেন।

সামরিক জীবনে প্রবেশ করতে পরীক্ষায় পাস করেন তিনবারের প্রচেষ্টায়। ভর্তি হন হ্যারোও রাইফেল করপোরেশনে এবং কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন সেনাবাহিনীকে। এরপর বিভিন্ন সময়ে ভারত, সুদান, মিসরসহ কয়েকটি দেশে মিলিটারি সার্ভিসে নিযুক্ত ছিলেন। ১৮৯৫ সালের পর ব্রিটেনের চতুর্থ রানির নিজস্ব অশ্বারোহী বাহিনীতে যোগদান করেন এবং সুদানের সীমান্তে অবস্থান করে অমদুরমানের যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেন। সে সময় যুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে পাইওনিয়ার মেইল এবং ডেইলি টেলিগ্রাফকে নিয়মিত প্রতিবেদন লিখতেন। এ ছাড়াও তিনি লন্ডন থেকে প্রকাশিত মর্নিং পোস্টেও কাজ করেছেন। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে অধিক সমাদৃত স্যার উইনস্টন চার্চিল সাহিত্যকর্মেও ছিলেন জগৎখ্যাত।

তিনি লিখেছেন ‘দ্য ম্যালাকান্ড ফিল্ড ফোর্স’ (১৮৯৮), ‘দ্য রিভার’ (১৮৯৯), ‘লেডিস্মিথ’ (১৯০০) এর মতো বিখ্যাত বই। ১৯৫৩ সালে ২য় রানি এলিজাবেথ স্যার উইনস্টন স্পেন্সার চার্চিলকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনিই একমাত্র ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, যিনি ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। সফল রাজনীতিবিদ ও ইতিহাসবিদ চার্চিল চল্লিশটির বেশি বই রচনা করেছেন। তার স্ত্রীর নাম ক্লেমেন্টাইন ওগিলভি হোজিয়ের। তাদের প্রথম দেখা হয় ১৯০৪ সালে এবং ১৯০৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বিয়ে করেন। পাঁচ সন্তানের বাবা-মা ছিলেন ইতিহাসখ্যাত এই দম্পতি।

ব্রিটানিক.কমের তথ্য মতে, ১৯০০ সালে ম্যানচেস্টারের ওল্ডহ্যামের কনজারভেটিভ পার্টির সদস্য হিসেবে যোগ দেন উইনস্টন চার্চিল। বাবার স্বাধীন চেতনাকে অনুসরণ করে সামাজিক সংস্কারক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তোলেন। তার এই স্বাধীনচেতা ভাবনার সঙ্গে মিল না থাকায় তিনি কনজারভেটিভ পার্টি ছেড়ে ১৯০৪ সালে লিবারেল পার্টিতে যোগ দেন।

১৯০৮ সালে লিবারেল পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং বোর্ড অফ ট্রেডের সভাপতি হিসেবে মন্ত্রীসভায় দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চ্যান্সেলর লয়েড জর্জের সঙ্গে নৌবাহিনী সম্প্রসারণের বিরোধিতা করেন। এ ছাড়াও কারাগার ব্যবস্থার জন্য বেশ কিছু সংস্কার করেন। তিনিই প্রথম শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি চালু করেন এবং শ্রম বিনিময় ও বেকারত্ব বিমা তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

১৯১১ সালে এডমিরালটির প্রথম লর্ড হিসেবে নিযুক্ত হন উইনস্টন চার্চিল। ব্রিটিশ নৌবাহিনীকে আধুনিকায়নে সহায়তা করেন এবং যুদ্ধজাহাজগুলোতে কয়লাভিত্তিক ইঞ্জিনের পরিবর্তে তেলে চালিত ইঞ্জিন ব্যবহারের নির্দেশ দেন, যা ছিল একটি অভাবনীয় সিদ্ধান্ত। ১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অংশ হিসেবে ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সেদিনই চার্চিল এডমিরালটির প্রথম লর্ড ও যুদ্ধ সভার সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হন।

১৯৪০ এর এপ্রিলে তিনি সামরিক সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত হন। মে মাসের দিকে জাতীয় সংসদে নরওয়েজিয় সংকটের কারণে প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেইনের ওপর সবাই আস্থা হারিয়ে ফেলে। একই কারণে ১৯৪০ সালের ১০ মে রাজা ষষ্ঠ জর্জ চার্চিলকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। এর কয়েক ঘণ্টা পরেই জার্মান সেনাবাহিনী নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম ও লুক্সেমবার্গ আক্রমণ করে, যা মিত্রবাহিনীর ওপর প্রথম বড় আক্রমণ ছিল। দুই দিন পর হিটলারের জার্মান বাহিনী ফ্রান্সে প্রবেশ করে।

ব্রিটেন তখন হিটলারের জার্মান সেনাবাহিনীকে একাই প্রতিহত করতে থাকে। প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি লেবার, লিবারেল ও কনজারভেটিভ পার্টির নেতাদের সমন্বয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করেন। বুদ্ধিমান ও প্রতিভাবানদের নিযুক্ত করেন গুরুত্বপূর্ণ সব পদে। ১৯৪০ সালের ১৮ জুন ‘হাউজ অব কমন্স’ এ গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন স্যার উইনস্টন চার্চিল। ততদিনে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে গেছেন। ১৯৪১ সালে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে চার্চিল জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেন। তার সুকৌশলী যুদ্ধনীতি ও মিত্রপক্ষের সম্মিলিত জোটের কাছে জার্মান বাহিনী পরাজিত হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে সামাজিক সংস্কারের পরিকল্পনা করেন তিনি, কিন্তু তা তিনি সাধারণ জনতাকে বোঝাতে পারেননি। যার ফলে ১৯৪৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য নির্বাচনে পরাজয়ের ছয় বছরের মধ্যে তিনি প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। ১৯৪৬ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্র সফরে তিনি তার বিখ্যাত ‘আয়রন কার্টেন’ ভাষণ প্রদান করেন, যা ছিল ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্যের ওপর সতর্কবাণী। ১৯৫১ সালের নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করেন এবং দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত হন।

বিশ্বে তিনি ‘সুপার হিরো’ হলেও ভারতবর্ষে তাকে ‘ভিলেন’ হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে প্রায় ত্রিশ লাখ মানুষের মৃত্যুর জন্য অনেকেই চার্চিলের নীতিকে দোষারোপ করে থাকেন। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছরেই ব্রিটিশদের যুদ্ধ জয় এবং তাতে নিহতদের স্মরণ করা হয়, কিন্তু এ একই সময়ে ব্রিটিশশাসিত বেঙ্গলে যে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছিল সেটা একেবারেই বিস্মৃত হয়ে পড়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বর্ণনা করেছেন সে সময় শকুন ও কুকুরে খাওয়া মরদেহ জমিতে ও নদীর ধারে পড়ে থাকার কথা।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ