মানুষ মাত্রই মুক্ত বিহঙ্গে ঘুরে বেড়াতে চায়। মানুষ এমন এক জাতি এরা বন্দি থাকতে মোটেও পছন্দ করে না। কিন্তু সময় বড় নিষ্ঠুর। একটা সময় সব কিছু থাকতেও শুধুমাত্র সময়ের অভাবে মনের ভিতর ঘুরে বেড়ানোর শখটাকে গলা টিপে ধরতে হয়। প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়াতে প্রচুর টাকার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু জগৎ সংসারে নানান ঝামেলায়, ভ্রমণ শখ পূরণের জন্য সময় আর বের করা যায় না। তাই সময় কারো জীবনে নিষ্ঠুর হবার আগেই ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়ানো চাই।
হুট করেই এক রাতে সময়কে তুরি মেরে, আমি আর মেহেদি কমলাপুর ট্রেন স্টেশন গিয়ে উঠে পড়ি হাওর এক্সপ্রেসে। গন্তব্য ভাটি অঞ্চল মোহনগঞ্জ। বহু বছর পর ট্রেনে চড়লাম। বাদ দিয়েছিলাম যে বছর খুলনা স্টেশনে ঢাকাগামী রাত ৯টার ট্রেন প্রায় ভোর রাতে স্টেশন ত্যাগ করেছিল। যাক এবার আর তেমন হয়নি। প্রায় পৌনে একঘণ্টা লেট। হুইসেল বাজিয়ে ঝিকঝিক শব্দ তুলে ট্রেন ছুটেছে তার ঠিকানায়। ত্রপানুকূল কেবিন। বেশ পরিপাটি। কেবিন বয় নাশতার কথা জানাল। পেট ভরা তবুও হ্যাঁ সূচক জবাব দিতেই সার্ভ করতে দেরি হলো না। খেয়েদেয়ে দুজনেই খুব আরামের একটা ঘুম দিয়ে, সকাল ৬টায় মোহনগঞ্জ রেল স্টেশনে নামলাম।
বহু বছর পর এদিকটায় আসলাম। কালের পরিক্রমায় অনেক কিছুই বদলে গেছে। যে বদলানোর ঢেউ মানুষের চরিত্রের ওপরও আছড়ে পড়েছে। রেল স্টেশনের পাশের হোটেলে, তেল ছাড়া মচমচা পরোটা আর ডিম ভাজা দিয়ে সকালের নাশতা সারলাম। আমি আবার ভাটি অঞ্চলে এলে রাস্তার ধারের হোটেলগুলোতে পরোটা খাই, না খেলেই নয়। কেন জানি আমার কাছে অন্যরকম স্বাদ লাগে।
এবার ফুপা বাড়িতে যাওয়ার জন্য অটোতে চড়লাম। চতুর চালক সম্ভবত ইচ্ছে করেই প্রথমে ভুল জায়গায় নিয়ে অতিরিক্ত কিছু টাকা খসালো। ওই যে বললাম না, চরিত্রের মাঝেও আছড়ে পড়েছে। গাড়ি ঘুরিয়ে এবার গার্লস স্কুলের সামনে এলাম। ফুপাতো ভাই তৌহিদ আগেই অপেক্ষায় ছিল। বিয়ে বাড়ি, অনেক স্বজন সমাবেশ। কিন্তু আমার মন তো পড়ে আছে হাওরের হিজল-করচ গাছের ছায়াতলে। খুব সংক্ষেপে কোনোরকমে সবার সঙ্গে হাই-হ্যালো সেরে ছুটলাম তেতুলিয়া। এবার মনে হয় ভাগ্য ভালো। অটোচালককে বেশ ভালোই মনে হলো। গ্রাম্য পথে অটো চলে। যেথায় খুশি সেথায় থামি। অন্যরকম মজা।
মোহনগঞ্জ একটি প্রাচীন জনপদ। ভাটি অঞ্চলের রাজধানী হিসেবেও খ্যাত। চালক রইস, আমাদের নানান অনুসন্ধানী প্রশ্নে একজন দক্ষ গাইডের মতোই উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। গ্রাম্য পথে চলার সময় বাড়তি আনন্দ জোগায়, অচেনা পাখির মিষ্টি সুর, পুকুরে দুরন্ত শিশুদের সাঁতার-ডিগবাজি, কৃষাণ-কৃষাণীর হাসি। চলতে চলতে একটা সময় বুঝে গেলাম, এই অটোচালক লোকটা আসলেই ভালো।
নানান আলাপচারিতায় ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তেতুলিয়া গ্রামে পৌঁছে গেলাম। গ্রামটা খুব সুন্দর। একেবারে ডিঙ্গীপোতা হাওরের তীরেই। গ্রামের মানুষগুলোর সঙ্গে পরিচিত হই। এটা সেটা দোকানিদের হতে কিনে খাই। বলা যায়, এটা আমাদের দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ’র অন্যতম শখ। ঘাটে গিয়ে ট্রলারে ওঠি/চড়ি। ট্রলারে বসে বিশাল হাওরের বুকে ভেসে বেড়াই। চারদিকে থইথই নতুন পানি। ভটভট শব্দ তুলে ট্রলার ডিঙ্গীপোতা হাওরে ভেসে বেড়াই। দূরের এক হিজল গাছের ছায়ায় যাই।
চারদিকে অথৈ পানি। মাঝে গাছটি শির উঁচু করে জেগে রয়েছে। এক অন্যরকম ভালোলাগার মুহূর্ত। তাছাড়া বর্ষাতে হাওরের সৌন্দর্য এমনিতেই বহুগুণ বেড়ে যায়। গাছের ডালের সঙ্গে লাগা পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। ট্রলার ছেড়ে গাছে চড়ি। পা ভিজাতেই সারাদেহে অদ্ভুদ শিহরণ। আকাশে ভেসে বেড়ায় চিল। নয়া পানিতে মাছের লুকোচুরি খেলা। মৎস্য শিকারিরা হন্তদন্ত। আমরা খুঁজি জীবনের সুখ। সেই সুখের খোঁজে উকিল মেহেদি বাঁদুড়ের মতো গাছের ডালে ঝুলতে গিয়ে, ধপাস করে পানিতে। ও হয়তো জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছে। শেষে আরো কিনা কী খুঁজবে, কে জানে!। তাই আর দেরি নয়।
মাঝি আবারো ট্রলার ভাসালো। রইস জানাল, শুকনো মৌসুমে এই ডিঙ্গীপোতা হাওরের বুকে বিভিন্ন জাতের ধান চাষাবাদ হয়। যা দেশের খাদ্য ভাণ্ডারের চাহিদা মেটাতে বেশ সহায়ক হয়। এই মোহনগঞ্জের হাওরগুলো হতে প্রচুর মিঠাপানির মাছ আহরণ করা হয়ে থাকে। ডিঙ্গীপোতা হাওর হয়ে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়া হাওর পর্যন্ত যাওয়া যায়। যা ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য নতুন কিছু দেখার শখ মিটাবে। নীল আসমানের তলায় মৃদু বাতাসে, হাওর জলে ভাসতে ভাসতে বেলা গড়িয়ে প্রায় মধ্য দুপুর। দিনটি ছিল জুমাবার। নিতে হবে নামাজের প্রস্তুতি। এবার তীরে যাই।
যাবেন কীভাবে: বাস ও ট্রেন, দু’ভাবেই যাওয়া যায়। সবচাইতে আরামদায়ক হবে রাতের বাস বা ট্রেনে গেলে। ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল ও কমলাপুর হতে দিনে-রাতে বাস, ট্রেন মোহনগঞ্জের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। মোহনগঞ্জ রেল স্টেশন হতে অটোতে তেতুলিয়া নৌঘাট।
খরচপাতি: জনপ্রতি দুই রাত এক দিনে মাত্র দুই হাজার টাকা হলেই যথেষ্ট। অবশ্য এটা নির্ভর করবে আপনার ইচ্ছা ও বিলাসিতার ওপর।
ভ্রমণ তথ্য: রাতের বাস/ট্রেনে গেলে, সারাদিন ঘুরে আবার রাতেই ঢাকা ফেরা যাবে।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ