ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

হা- ভাতে

প্রকাশনার সময়: ১৯ ডিসেম্বর ২০২১, ১৭:৫০

টিনের চাল বেয়ে টপ টপ করে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পড়ছিল ঘরের ভেতর। আর কোনো ঘটি-বাটি নেই যে, পানির নিচে দেয়া যেতে পারে। আজ কাজে যেতে দেরি হয়ে যাবে তার। একদিকে বৃষ্টি অন্যদিকে ছেলেটার প্রচণ্ড জ্বর। আজ তো বিবি সাহেব খুবই ক্ষিপ্ত হবেন। বাসায় মেহমান আসবে তাই ভালো-মন্দ রান্না হবে। সেই কাজে সহযোগিতা করবে আলেয়া।

আলেয়ার রান্নার হাত ভালো। কাদের তার হাতের খিচুড়ি আর গরুর মাংস খেয়ে বলত, ‘বউ তুই এত ভালা রান্ধস?’ এই বলে তার আঁচলে মুখ মুছত কাদের। কোথায় গেল সেই সুখের দিন!

কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রামে ভালোই তো ছিল সে। একমাত্র ছেলে আর স্বামী কাদেরকে নিয়ে। গ্রামের লোকের নানারকম গুঞ্জন তার কানে এসেছে, তারপরও অন্ধভাবে বিশ্বাস করেছে সে কাদেরকে। আলেয়া কি জানত জেলা শহরে অষ্টাদশী এক মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে কাদের? তাকে নিয়েই সংসার পেতেছে সে।

বাড়িঘর তৈরির নির্মাণ কাজে ঠিকাদারির কাজ করত কাদের, পাশেই ইটের ভাটায় কাজ করত তরুণী সায়েরা। মানুষ কেমন করে বিশ্বাসঘাতকতা করে বুঝতে পারেনি আলেয়া। যেদিন চোখের সামনে সত্য উদ্ঘাটিত হলো, সেদিন একদলা থুতু ফেলে সন্তানকে বুকে নিয়ে বেরিয়ে আসে সে। ঢাকায় এসে কাজ করার বুদ্ধি দেয় দুঃসম্পর্কের চাচাতো বোন জমিলা। মনকে শক্ত করে আলেয়া। এই কঠিন পৃথিবীতে সন্তানকে নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে তার। নিয়তি বড়ই কঠিন। ছেলে সাকিবের ডাকে চমক ফিরল তার! ‘মা বিরানি খাইতে মন চায়, আমারে একটু বিরানি আইনা দিবা?’ ‘হ, রে! বাজান আইজ আমি যেহানে কাম করি সেহানে ভালা রান্ধা হইব, আমি নিয়া আমুনে তোমার লাইগ্যা।’ ছেলের মাথার জলপট্টি বদলে দিয়ে বিরাট দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল সে। এখনই বের হতে হবে, বেলা অনেক হয়েছে।

রাস্তা বৃষ্টির পানিতে ডুবে গিয়েছে। হাজারিবাগ ট্যানারির মোড়ে বস্তির ছাপড়ায় একটা ক্ষুদ্র টিনের চালায় মা-ছেলের জায়গা হয়েছে। ‘বাবা তুমি শুইয়া থাকো, এইহানে একটা বনরুটি আর কলা আছে খিদা লাগলে খাইও, আমি তাড়াতাড়ি আমু অনে! মাকে ছাড়তে মন চায় না সাকিবের কিন্তু বিরায়ানির কথাটা বারবার মনে হচ্ছিল তার। কখন খাবে সে বিরানি! বিরিয়ানির সুঘ্রাণ যেন ভুর ভুর করে ঘুরে ফিরছিল সাকিবের আশপাশ দিয়ে।

‘এত দেরি করে এসেছ আলেয়া, আজ বাড়িতে কত কাজ? আমার সঙ্গে রান্নায় হাত লাগাও!’ ‘খালাম্মা আমার পোলাটার খুব জ্বর তারে ফেলাইয়া আইছি। আমার তাড়াতাড়ি যাওন লাগব।’ ‘তোমাদের তো শুধু কাজ ফাঁকি দেয়ার উছিলা’ বলে গজগজ করতে করতে খালাম্মা আর আলেয়া পোলাও-রোস্টসহ নানা পদের রান্না শেষ করল। তারপরও আলেয়া মনে প্রশান্তি অনুভব করছে, অসুস্থ ছেলের জন্য আজ তার মনমতো খাবার নিয়ে যাবে। নিশ্চয়ই খালাম্মা বাচ্চাটাকে খাবার দেবেন।

‘খালাম্মা তয় অহন আমি যাই, কাম তো শ্যাস।’ ‘ঠিক আছে যাও।’ অনুমতি মিলল যাওয়ার। আলেয়া কথাটা বলতে খুব লজ্জা পাচ্ছিল, তার পা সরছিল না। যেতে চেয়েও সে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ‘তুমি না যাবে বললে যাও, বাকি কাজ মিমের মা শেষ করবে।’ ‘কইছিলাম কি একটু পোলাও-মাংস যদি আমার পোলাটারে দিতেন, ওর অনেক জ্বর, খাইতে চাইছিল। কইতে শরম লাগতাছে খালাম্মা, কিন্তু পোলাটার মুখের দিকে চাইতারি না।’

‘এত খাবার দেই তাও কি তোমাদের মন ভরে না, কত খাবার লাগে শুনি? ফ্রিজ থেকে না দুই-তিন দিন আগের ভাত-তরকারি দিলাম। মেহমান আসেনি এখনই দিতে হবে পোলাও-মাংস!’ ঝাঁঝাল কণ্ঠের উত্তর শুনে ভয় পেয়ে গেল আলেয়া।

‘যতই দেই তোমাদের হয় না, লোভের কোনো শেষ নেই। যাও তো মাথা নষ্ট কর না আমার। এখনো ভালো মতো রেডি হতে পারিনি।’ আর কোনো কথাই বলতে পারে না আলেয়া। জীবনে কখনো এতটা অসহায় বোধ করেনি সে। মায়ের কাছে সন্তানের আকুতি বোধ হয় পৃথিবীর সব লজ্জা সংকোচকে দূরে ঠেলে দেয়। দ্রুত লিফটে ওঠে আলেয়া, দশ তলা থেকে নিচে নামতে যেন একযুগ লেগে যায়। বস্তির আরেক পাশে বড় বড় ইমারতকে আজ তার দৈত্যের মতো মনে হয়। এ যেন আলো অন্ধকারের খেলা। চোখের পানিতে ভেসে যায় বাসি খাবারগুলো। আলেয়ার কেবলই মনে হয় গরিবের বিরিয়ানি খাওয়ার কোনো অধিকার নেই। খিদা ক্যান লাগে এ প্রশ্নের উত্তর কারো কি জানা আছে?

নয়া শতাব্দী/জেআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ