নদীর দেশ বাংলাদেশ। অনেক নদী রয়েছে এই বাংলায়। পদ্মা, মেঘনা, সুরমা, করতোয়া, আত্রাই, যমুনেশ্বরী, গড়াই, মধুমতি, বলেশ্বর, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, কপোতাক্ষ, বংশী, ঘাঘট, ধনু বাউলাই, নবগঙ্গা, কুশিয়ারা, কংস, ভোগল, ডাকাতিয়া, ছোট ফেনী, ভদ্রা, বেতনা, সাংগু, চিত্রা, বানার, কুমার, পুনর্ভবা, আড়িয়াল খাঁ, ধলেশ্বরী, ভৈরব, মাথাভাঙ্গা, রূপসা, পশুর, কর্ণফুলি, তিস্তাসহ অন্যান্য নদীতে বেড়াতে পারেন।
মেঘনার এপাড়ে চাঁদপুর- এরই পশ্চিম পাড়ে শরীয়তপুর জেলা। মেঘনা, পদ্মা দেখব বলেই ট্রলার ভাড়া করে এক সকালে বেরিয়ে পড়লাম আমরা চারজন। অপর তিনজন আমার বয়সে অনেক ছোট। ওরা আমাকে ‘চাচ্চু’ বলেই ডাকে। ওদের সঙ্গে আন্তরিকতা রয়েছে আমার। প্রদীপ, আশিষ আর শচী ওদের নাম। শীতে পদ্মা-মেঘনা শান্ত থাকবে বলেই এই দুই নদীপথে বেড়িয়ে বাংলার প্রধান নদীর রূপ দেখব- এও কী কম ভাগ্যের কথা। মুন্সীগঞ্জ আর শরীয়তপুর জেলার মধ্য দিয়েই বয়ে গেছে পদ্মা নদী। ওদিকে চাঁদপুর আর মতলবের পাশেই রয়েছে মেঘনা নদী।
পদ্মা এক জায়গায় এসে মেঘনার সঙ্গে মিলেছে। এ ভ্রমণে দুই নদীর মিলনস্থল দেখার জন্য ব্যাকুলও হলাম। ট্রলার এগিয়ে চলছে পশ্চিম দিকে। বারবার চোখে পড়ছে জেলেরা জাল ফেলছে আবার তা উঠাচ্ছে। শূন্য জাল, কোনো মাছ নেই। ততক্ষণে হতাশার ছাপ জেলেদের চোখে-মুখে। বললাম, ‘এই যে প্রদীপ মেঘনায় কী আজ কোনোই মাছ নেই?’ প্রদীপ হাসল- ‘জানেন চাচ্চু, জনসংখ্যা বাড়ছে দিন দিন, তেমনি মেঘনায় জেলেদের আনাগোনাও কয়েকগুণ বেড়েছে। দিনে-রাতে সমানে মাছ ধরা চলছে বলেই তো আজ মেঘনায় মাছের সন্ধান মিলছে না। মেঘনা পাড়ের জেলেরা আজ শান্তিতে নেই। মাছ মিলছে না, এ জন্য জেলেপাড়ায় দিন দিন অভাব-অনটন বেড়েই চলছে।’ এদিকে শচী কাছে এগিয়ে- ‘দ্যাখুন দ্যাখুন চাচ্চু, এ ইলিশ নয়, জাটকা ধরা পড়েছে জেলের জালে। দেখি, তাই তো!’ সেই মুহূর্তে বিস্মিত না হয়ে কী আর পারা যায়।
হঠাৎ কানে ভেসে এলো- ‘আমায় ভাসাইলিরে আমায় ডুবাইলিরে অকূল দরিয়ার বুঝি কূল নাইরে/কূল নাই কিনার নাই, নাইক গাঙের পাড়ি, তুমি সাবধানে চালাইও মাঝি আমার ভাঙা তরীরে।’ কান পেতে গানটি শুনলাম। স্মৃতিতে ভেসে উঠল কণ্ঠশিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমেদের নামটি। ট্রলার এগিয়ে চলছে। হঠাৎ করেই মনে পড়ল, স্টিমারে চড়ে পদ্মা, মেঘনা হয়ে বরিশালে যাওয়ার সেই রোমাঞ্চকর ঘটনার কথা। তখন আমার বয়স সতেরো, কলেজের ছাত্র, ১৯৭০ সাল। সেই রাতটি ছিল বড়ই ভয়ঙ্কর। জলোচ্ছ্বাসে সেই বছর দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকা মনপুরাসহ কত দ্বীপ তছনছ হয়ে গেল।
স্টিমারের ডেকে বসে দেখি বিশাল বিশাল ঢেউ। কখনও মনে হলো, এই বুঝি স্টিমার ডুবে যাচ্ছে। সব যেন তছনছ হয়ে যাচ্ছে। কত অশান্ত পদ্মা-মেঘনা। বন্ধু ফারুক ছিল সঙ্গে- ওদের বাড়ি হাতিয়া দ্বীপে। বারবার বলছিল, স্টিমার কী ডুবে যাবে। হায়রে এ কোন রাত- রাত কী পোহাবে না! এদিকে ঢাকা রেডিওতে বারবার প্রচার হচ্ছে- ‘ভোলা, নোয়াখালীর দ্বীপাঞ্চলের ওপর দিয়ে জলোচ্ছ্বাস বয়ে গেছে। কয়েক লাখ মানুষ ভেসে গেছে সাগরে।’ ততক্ষণে দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল ওর। বুঝতে অসুবিধা হলো না। ও বার বার বলল, মা-বাবা, ভাই-বোন ওরা কী কেউ বেঁচে নেই...। ওই হাতিয়া, মনপুরার দিকেও তো মেঘনা নদীর মোহনা। মনপুরার পাশ দিয়েই তো মেঘনা বয়ে গেছে হাতিয়ার দিকে। তারপর বঙ্গোপসাগর।
মেঘনার এক কূলে হরেক রকমের পাখি দেখে কেমন জানি উদাসী হলাম। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম মেঘনার পানে। প্রদীপ গান ধরল : ‘পৃথিবী আমারে চায় রেখো না বেঁধে আমায় খুলে দাও প্রিয় খুলে দাও বাহু ডোর...।’ গানখানি শুনে শচী বলল, বাহ্ তুই তো ভালো গান করিস! তা পুরনো এ গানটা কার কাছে শিখলি? প্রদীপ একটু হেসে- ঠাকুর মা’র কাছে এ গান শিখেছি। গানের শিল্পী কে জানিস, সত্য চৌধুরী। এক সময় অল ইন্ডিয়া রেডিওতে, ফিল্মে আর রেকর্ডে তিনি অনেক গান করেছিলেন। ‘চন্দ্রশেখর’ ছবিতে তো সত্য চৌধুরী গেয়েছিলেন, ‘তুমি কি জানরে বন্ধু কাঁদাও যে আমায়...।’ এই গান তো বহুদিন ধরে ছিল মানুষের মুখে মুখে।
ট্রলারের আরেক দিকে বসা আছে আশিক ও শচী। শচী বলল, দেখুন-দেখুন মেঘনার কূল-কিনারা নেই। এ শীতেও কত অশান্ত এই মেঘনা। ট্রলার ততক্ষণে চলে এসেছে মেঘনার মাঝামাঝি। এদিকে কাছাকাছি একটি নৌকা দেখেই আশিক বলল, দেখো দেখো প্রমত্তা মেঘনার বুকে চলছে নৌকা...। আমরা নৌকায় এলে কী ভালো হতো! নৌকাতে বসে থাকা ২ জন ছেলে, ২ জন মেয়ে আমাদের উদ্দেশে হাত নেড়ে বলল- ‘দেখুন দেখুন, এই শীতে পদ্মা-মেঘনায় বেড়াব বলেই তো নৌকা ভাড়া করে চলেছি- দূর অজানা দেশে। আসুন না আমাদের নৌকাতে। শচী হেসে- তোমাদের মোবাইল নাম্বারটা দাও, পরে ফোনে কথা হবে। আরেকবার না হয় আমরা একত্রে ঘুরে বেড়াব, আমরা দেখব বাংলার প্রধান নদী পদ্মা-মেঘনার রূপ! একটি মেয়ে হাত বাড়িয়ে মোবাইল নাম্বারটি শচীর হাতে তুলে দিল। দাদা, ভুলে যাবেন না তো, ফোন করবেন তো। আবার একত্রে না হয় বেড়াব আমরা।
ট্রলার এগিয়ে চলছে। আমরা দু’নয়ন ভরে দেখছি মেঘনার রূপ, ভাবছি- নদী ভ্রমণ কতই না আনন্দের। শচী বলল, ওই যে দেখা যাচ্ছে চর। ট্রলার চালক বললেন, এর পরেই যে পদ্মা নদী- ওই চরে ঘুরে বেড়াবেন নাকি! সম্মতি জানাতেই ট্রলারচালক ট্রলার ভিড়াল এক অজানা চরে। শচী বলল, এই চরের নাম ‘আশিক চর’ দিলে কেমন হয়। প্রদীপ একটু হেসে- বেশ তো ভালোই হয়। শচী, প্রদীপ, আশিক আর আমি নেমে পড়লাম চরে। তখন দুপুর গড়িয়ে পড়েছে পদ্মার চরে। আশিক বলল, খাওয়া-দাওয়া এখানেই সেরে নিলে কেমন হয়। শচী- ভালোই তো হয়। খাওয়া-দাওয়া শুরু করতেই দেখি, কতগুলো পাখি উড়ে এসে পড়ল আমাদের সামনে। রং-বেরঙের পাখি দেখে মুগ্ধ না হয়ে কী আর পারা যায়। দেখি কতগুলো সাদা রঙের বক এসে পড়ল পদ্মার চরে। মুরগির রানটা মুখে দিয়ে প্রদীপ বলল, বকের মাংস কখনও খেয়েছেন? দারুণ স্বাদ...। হাসলাম ওর কথায়। কেন জানো না, আমার জন্মস্থান পিরোজপুর শহরে, ওখানে আমাদের বাড়ির চারপাশে আছে কত নারকেল, সুপারি গাছ। গাছে গাছে বাসা বাঁধত শত শত বক। তখন কত বকের মাংস খেয়েছি। বল, তা কী ভোলার!
এদিকে বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে, ট্রলারে গিয়ে বসলাম। চলছি এবার পদ্মা নদী হয়ে শরীয়তপুরের ডামুড্যা, গোসাইরহাটের দিকে। ভ্রমণ শেষ হবে ওপারে গিয়ে। আমার পাশে বসে আছে আশিক, হাতে হাত রেখে বলল- নৌকা ভাড়া করলেই তো ভালো হতো! নৌকা যে নেইনি ঠিকই করেছি। বিশাল পদ্মা-মেঘনায় নৌকা ডুবলে তো আর ঘরে ফিরতে পারব না। এই পদ্মায় নৌকাতে চড়ে কত মানুষের সলিল সমাধি ঘটেছে। শচী বলল, তুই কী নৌকাডুবির কাহিনী জানিস! আশিক শুনিনি! বল না। শচী শুরু করল : ‘বিয়ের পরের দিন রমেশ তার নতুন স্ত্রীকে নিয়ে নদীপথে ফিরছিল তখন ভীষণ ঝড়ে তাদের নৌকা জলমগ্ন হয়। রমেশ জ্ঞান লাভের পর দেখে নদীর চড়ায় শুয়ে আছে সে আর নববধূ। বিয়ের রাতে আগে সে স্ত্রীর মুখ দেখেনি তাই তাকে চিনতে পারল না। কিন্তু পরে জানল সে কমলাও নববিবাহিতা, তাদেরও নৌকাডুবি হয়েছিল, তবে সে অন্যের স্ত্রী...।
কাহিনীটা শেষ করতে না দিয়েই প্রদীপ জানাল, এত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা নৌকাডুবির কাহিনী বলছে। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে ‘নৌকাডুবি’ ছবিটা দেখেছিলাম। ছবিতে রমেশের চরিত্রে অভি ভট্টাচার্য, হেমামালিনীর চরিত্রে মীরা সরকার এবং কমলার চরিত্রে ছিলেন মীরা মিশ্র। কী অসাধারণ তাদের অভিনয়। কোনো দিনই ভুলব না! আমাদের কথাগুলো বড্ড মনোযোগ দিয়ে শুনেছিল ট্রলারচালক। জানেন, আমার নাম শংখ ঘোষ। বাবা আমাকে ‘শংখ’ বলেই ডাকতেন। পূজার সময় দল বেঁধে আমরা যেতাম মামার বাড়িতে। মানে যে গ্রামে আমার জন্ম, সেখানে। কাজে-কর্মে সবাই তো বছরজুড়ে ছড়িয়ে থাকত বাংলার এ জেলায় ও জেলায়। পূজার কয়েকটা দিনের জন্য সবাই ছুটত নিজেদের বাড়ির দিকে। সেটাই ছিল সবার বেড়ানো। সে বেড়ানোর কি তুলনা আছে কোথাও?
শচী বলল, সেটা আবার কেমন বেড়ানো। সে তো কেবল যাওয়া! চালক- যাওয়া কি বেড়ানো নয়? যাওয়াটাই তো আসল বেড়ানো। ভেবে দেখুন কত পথঘাট কত নতুন নতুন জনপদের মধ্য দিয়ে চলেছেন, কতরকম ভাবেই-বা যাচ্ছেন, দেখছেন কতরকম লোক, এই যে পদ্মা-মেঘনা দেখছেন সেটা কী বেড়ানো নয়? আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেমন বেড়ানো সেটা? বল দেখি শুনি।’ চালক- এক সময় আমরা ছিলাম পাকশীতে, পাবনা জেলায়। পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে ছড়ানো মস্ত একটা ব্রিজ, হার্ডিং ব্রিজÑ লোকে যাকে ভুল করে হার্ডিঞ্জ বলে, তার ঠিক পূর্ব পাড়ে ওই পাকশীর রেল স্টেশন।
গল্পে গল্পে আমরা সন্ধ্যার ক্ষণে এসে গেলাম শরীয়তপুরের পাড়ে। মেঘনা আর পদ্মা পেরিয়ে এপাড়ে আসা- ভাবলাম আজ আমরা সফল হয়েছি। ট্রলারচালক একটু হেসে- এই যে, আপনারা চাঁদপুর থেকে এপারে শরীয়তপুরে এলেন, ভ্রমণে এসেছেন বলেই হয়তো পেরেছেন। ভ্রমণ না করলে হয়তো বদ্ধ ঘরেই থাকতেন। জানেন, রাতের বেলা এই পথে চলে বড় বড় স্টিমার। কত চলেছি স্টিমারে, পর্দা ফাঁক করে উঁকি দিয়ে দেখেছি প্রবহমান জলধারা। দেখেছি, তীরের আবছা গাছপালা কেমন সরে সরে যাচ্ছে আর হঠাৎ হঠাৎ তার ভেতর থেকে দেখা দেয় ক্ষীণ দু’-একটা আলোর টান। তখন বুঝতাম, হবে কোনো বসতি আছে কাছেই। দেখলাম, দূর থেকে নৌকা চলে যায়। স্টিমারের তোলা বড় ঢেউয়ের ধাক্কা গিয়ে লাগত নৌকার তোলা ছোট ঢেউয়ে, অমনি একটু উথাল-পাথাল করে নৌকা, তারপর আবার শান্ত হয়ে যায় সব। মাঝে মাঝে ভাবতাম, খোলামকুচির মতো দুলতে থাকা ও নৌকা ডুবে না তো? ডোবে না অবশ্য, ঠিকই চলে যায় ছন্দে ছন্দে।
ট্রলার এসে ভিড়ল পদ্মার পাড়ে। কাছে দূরে ভাসছে যেসব কচুরিপানা, তারাও যেন চেনা আমাদের। দেখি মাঝে মাঝে জল থেকে ঝাঁপ দিয়ে ওঠানামা করছে শুশুকগুলো। তীরে উঠে দাঁড়ালাম আমরা চারজন। দেখি ধান কেটে ঘরে ফিরছে। আরেক দিকে পাকা ধানের ক্ষেত। তখন বারবার মনে পড়ল- ‘ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি...’ জাতীয় সংগীতের এই কথাগুলো। ততক্ষণে দেখি প্রিয় বন্ধু কৃষ্ণ সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, চলুন দাদা জলপান করবেন। মেঘনা-পদ্মা ভ্রমণ শেষে অবশেষে চললাম কৃষ্ণের পিছু পিছু। এবার যে খেতে হবে কৃষ্ণের আখড়ায়।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ