ভ্রমণ পাগলদের মন সব সময়ই ঘুরে বেড়ানোর জন্য ব্যাকুল থাকে। সুযোগ পেলেই যেদিকে চোখ যায় উড়াল দিতে ইচ্ছে করে। কিছুতেই তাদের শখ কমানো যায় না, তাদের দমিয়ে রাখা যায় না। জগত সংসারের অনেকেই বিবিধ নেতিবাচক ভাবনায় গলাটিপে ধরতে চায়। কিন্তু তারা হয়তো জানেন না, প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়াতে প্রচুর টাকার প্রয়োজন হয় না। কিংবা নৈতিক চরিত্র অধঃপতনেরও তেমন সম্ভাবনা থাকে না।
আলহামদুলিল্লাহ সেদিক হতে আমি সৌভাগ্যবান। তাইতো মাঝেমধ্যেই প্রাণের সংগঠন দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের সঙ্গে দেশের নানান নয়নাভিরাম জায়গায় হুটহাট করেই ছুটে যাই। তেমনি এবার দেখতে বের হলাম খাগড়াছড়ির বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে। যেখানে এখনো সাধারণ ভ্রমণপিপাসুদের পদচারণা তেমন নয়, সেসব জায়গাতেই দে-ছুট যেতে বেশি পছন্দ করে। লোক চক্ষুর আড়ালে থাকা বছর দেড়েক আগে আবিষ্কৃত তাবাক্ষ গুহা হতে ঘুরে এলাম। তাবাক্ষ নামটার মাঝেই কেমন যেন আদিমতা ভর করে আছে।
ভ্রমণ পরিকল্পনা সব ঠিকঠাক। কিন্তু যাব অচেনা-অজানা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল। তাই দীঘিনালার বাসিন্দা মি. রকি বিশ্বাসের সহযোগিতা নিলাম। তিনি গ্রিন সিগন্যাল দিতেই এক বৃহস্পতিবার রাতের গাড়িতে ছুটলাম খাগড়াছড়ি। ভোরে নেমে প্রথমে হোটেলে সাফসুতর হয়ে, নাশতা সেরে আবারো উঠে বসলাম দাদার আমলের চান্দের গাড়িতে। প্রায় একঘণ্টা চলার পরে মহাসড়ক ছেড়ে তাবাক্ষ গুহার দিকে, পাহাড়ি পথে কিছুটা অগ্রসর হতেই গাড়ি খাদে আটকে যায়। ঠেলা ধাক্কা নাকে দড়ি বেঁধেও গাড়ি আর চলমান কার্যক্রমে আনা গেল না। খাদে আটকা অচল গাড়ি সচল করতে গিয়ে, ভ্রমণকালীন মহা মূল্যবান একটি ঘণ্টার পুরোটাই বিফলে। অতঃপর দুই পা’ই ভরসা। হাঁড়িপাতিলসহ বাজারসদাইর নিয়ে ট্র্যাকিং শুরু।
প্রখর রৌদ্র ওপেক্ষা করে হাইকিং ট্র্যাকিং চলছে। মাঝেমধ্যে ছায়াঘেরা কোন গাছতলায় একটু জিরিয়ে নেই। চলতে চলতে চোখে ধরা দেয় নীল আকাশে পেজা তোলা শুভ্র মেঘের ভেলা। কখনো বা কালো মেঘের ঘনঘটা। সবুজের ঢেউ খেলানো পাহাড়। জুমের ফসল। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ অরণ্য। উঁচু নিচু পাহাড়। নলখাগড়ার জঙ্গল।
পাহাড়ের সবুজ সতেজ রূপ শুধু চোখ জুড়ায় না, মনও ভরিয়ে দেয়। আর এসবই সামনে এগিয়ে যাবার প্রাণ শক্তি। এই শক্তি বেড়ে আরো দ্বিগুণ হলো যখন একটা সময় পুরোপুরি জঙ্গলি পথে ঢুকে গেলাম। শরীরে সাপ প্যাচাবে নাকি কোনো হিংস্র জন্তু পা কামড়ে ধরবে, সেদিকে কোনো খেয়ালই ছিলো না। সে এক রোমাঞ্চকর ব্যাপার। সব মিলিয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা হাইকিং-ট্র্যাকিং করতে করতে পৌঁছি বড় মাইরুং ঝর্ণার উপরে। গড়িয়ে যাওয়া টলটলে পানির ঝাপটা চোখেমুখে দিতেই সব ক্লান্তি যেন নিমিষেই উবে যায়। আহ্ কি শান্তি।
এবার জমবে আসল খেলা। দঁড়ি বেয়ে যখন সবাই তরতর করে ঝর্ণার পাদদেশে নামছিলো,তখন নয়া সঙ্গীদের অনেকেই আমাকে নিয়ে মজা লুটছিলো। তাদের ভাবনা আমাকে হয়তো ১১০ কেজির দেহটা নিয়ে ঝর্ণার উপরেই বসে থাকতে হবে। কিন্তু না, আমি মোটেই দমে যাওয়ার পাত্র নই। গাইড মিলন ত্রিপুরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলো। সাহস যোগালো স্কাউট রেদওয়ান সহ ঘুরতে আসা স্থানীয় তরুণ দিপায়ন ত্রিপুরা। তাদের সহযোগিতায় তরতর করে প্রায় ৯০ডিগ্রী খাড়া পাহাড়ের আনুমানিক ৫০/৬০ ফিট নীচে নেমে এলাম।
এখানে রয়েছে বড় মাইরুং নামক একটি ঝর্ণা। এর শ্বেত শুভ্র হিমহিম ঠান্ডা পানি মন কেড়ে নেয়। বয়ে চলা ঝিরির পরিবেশ ও নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতেও বেশ চমৎকার। ঝর্ণার পানি রিমঝিম ছন্দ তুলে অবিরাম গড়িয়ে পড়ে। এর শীতল পানি চুম্বুকের মতো দেহটাকে টেনে নেয়ায় ইচ্ছেমত ভিজতে থাকি। সবুজের গালিচায় মোড়ানো গহিন পাহাড়ের বুক চীরে, জেগে থাকা বড় মাইরুং ঝর্ণার সৌন্দর্যও কম যায় না।
ওদিকে দে-ছুট এর স্বেচ্ছ্বাসেবকদের কেউ কেউ জঙ্গল হতে লাকড়ি কুড়িয়ে আনে। কেউবা বড় বড় পাথর বসিয়ে চুলা বানায়। রন্ধন কারিগররা আগুন জ্বালিয়ে রান্নায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে যায়। বাঁশ কোড়ল সংগ্রহ করতে যাওয়া স্থানীয় বগড়াছড়া পাড়ার তরুণীরাও আমাদের রান্না যজ্ঞে হাত মিলায়।
অল্প কিছুদূর গেলেই কাঙ্খিত তাবাক্ষ গুহার দেখা মিলবে। কিন্তু না। এখনি যাচ্ছি না। আগে দুপুরের আহার সেরে নেয়া হবে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই রেডি হয়ে যায় সাদা ভাত আর মুরগির তরকারি। আহ্ কি ঘ্রাণ! এই ঘ্রাণ কি তবে ঝর্ণার পানি দিয়ে রান্নার কারণে নাকি ভুবন ভুলানো প্রাকৃতিক নৈসর্গিক পরিবেশে বসে খাওয়ার জন্য। তা যাই হোক। সবাই মিলে পেট পুরে খাই। খেয়েদেয়ে এবার ছুটলাম তাবাক্ষ।
অল্প কিছুদূর মাইরুং তৈসা ঝিরিপথ ধরে আগাতেই গুহামুখের দেখা মিলে। দেখেই কেমন কেমন যেন রহস্যময় লাগে। ভেতরে ঢুকলে না জানি কি হয়। কিন্তু দে-ছুট এর দামালদের থামাবে কে। একে একে সবাই সরু গুহার ভেতর ঢুকে পড়ি। একটা সময় পুরোই ঘুটঘুটে অন্ধকার আমাদেরকে আচ্ছন্ন করে। তবুও সঙ্গে নেয়া টর্চের আলোয় আগাতে থাকি। তাবাক্ষর ভেতরটা ভয়ঙ্কর অদ্ভুদ সৌন্দর্যে ঘেরা। পাথরের পাহাড়ের মাঝে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট তাবাক্ষ গুহা। টর্চের আলোয় উপরের দিকে তাকালে, মনের মাঝে ভয়ানক শিহরণের দোল দেয়। তাবাক্ষর পাথুরে ছাদ জুড়ে যেন রহস্য খেলা করে। গুহার কিছুকিছু জায়গা মাত্র ১৭/১৮ ইঞ্চি পাশ। সেসব জায়গা দিয়েও কাতচিৎ হয়ে অবলিলায় ঢুকে পড়েছি।
দলের প্রত্যেকের মাথায় অদেখা কে দেখার নেশা চেপে ধরেছিলো। ভয় ডর সব তখন ফিকে হয়ে গিয়েছিল। কথা একটাই- তাবাক্ষর শেষ অব্দি পর্যন্ত দেখতে হবে । গুহার আঁকাবাঁকা পথে আগাতে আগাতে একটা সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায় সুরু পথের মাঝে থাকা এক খন্ড পাথর। হয়তো পাথরটি পথ আগলে না রাখলে আরো কিছুটা দূর যাওয়া যেতো। খানিকটা সময় পাথরের চিপাচাপা দিয়ে চোখ বুলিয়ে, সেখান থেকেই ফিরতি পথ ধরি। সাংবাদিক অপু দত্তর রিপোর্ট অনুযায়ী তাবাক্ষ গুহা প্রায় ১৬০ ফিট দৈর্ঘ্য ও ৩০ ফিট উচ্চতা সম্পন্ন। প্রায় সাড়ে তিন ফিট প্রশস্তের হলেও, কয়েকাটা স্থানে একেবারেই সরু। স্থানীয়রা তাবাক্ষ গুহাটিকে দেবতার গুহা নামেও ডাকে। ত্রিপুরা ভাষায় তাবাক্ষ অর্থ বাদুড়ের গুহা। যারা যেই নামেই ডাকুক না কেন, এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। নিঃসন্দেহে ভ্রমণ পিপাসুদেরকে তাবাক্ষ গুহা রোমাঞ্চিত করবে এটা নিশ্চিত।
যেভাবে যাবেন : ঢাকা হতে খাগড়াছড়ি রুটে বিভিন্ন পরিবহনের বাস সার্ভিস রয়েছে।
ভাড়া ৫০০টাকা থেকে ১২০০টাকা। খাগড়াছড়ি শহরের শাপলা চত্বর হতে চান্দের গাড়িতে ১৭ কিলোমিটার দূরত্বের দীঘিনালা উপজেলার আটমাইল নামক এলাকা হয়ে বড় পাড়া / বগড়াছড়া পাড়া পর্যন্ত যেতে হবে। এরপর প্রায় দুই কিলোমিটার পাহাড়ি পথে ট্র্যাকিং।
খাওয়া-থাকা: দিনে দিনে ঘুরে এসে শহরেই থাকতে হবে। তাবাক্ষ অবস্থানকালীন পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি ও শুকনো খাবার সঙ্গে নিতে হবে। সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র।
সতর্কতা: অবশ্যই স্থানীয় পাড়াগুলো হতে গাইড নিয়ে যেতে হবে। নতুবা পথ হারানো সম্ভাবনা রয়েছে।
ছবি: দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ