উত্তর চট্টলার প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ঘেরা মিরসরাই উপজেলা। পাহাড়-পর্বত ঝর্ণা লেক সবই মিলবে এ উপজেলাটিতে। প্রাকৃতিক সৃষ্ট ঝর্ণা ও কৃত্রিম লেকগুলো এর সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে আরও বহুগুণ। এসব পর্যটন স্পটগুলো সৌন্দর্যে মুগ্ধ পর্যটকেরা দল বেধে ছুটছেন এ উপজেলাটিতে। অনেক পর্যটকের কাছে এটি ঝর্ণার রাজ্য হিসেবে সুপরিচিতি রয়েছে। এই ঈদে পরিবার পরিজনকে সঙ্গে নিয়ে ঈদের ছুটি কাটানোর আদর্শ স্থান হতে পারে ঝরনার রাজ্য মিরসরাই। পাহাড়-পর্বত ঝর্ণা, কৃত্তিম লেক ও সুবিশাল সাগরের তীর কি নেই এই উপজেলাটিতে।
মিরসরাইয়ে সুপরিচিত ঝর্ণাগুলোর মধ্যে অন্যতম খইয়াছড়া, নাপিত্তাছড়া, রূপসী, বোয়ালীয়া ঝর্ণা। এর বাইরে ছোট বড় অসংখ্য ঝর্ণা দ্বারা বিস্তৃত এই উপজেলা। এর পাশাপাশি রয়েছে মহামায়া, বাওয়াছড়া, সোনাইছড়াসহ ৩টি কৃত্তিম লেক, মুহুরী সেচ প্রকল্পসহ অসংখ্য সমুদ্র সৈকত। এই পর্যটন স্পটগুলো একদিকে পর্যটকদের কাছে টানছেন অন্যদিকে ভাগ্য খুলে দিয়েছেন কৃষকদের। যার দ্বারা অনেক অনাবাদি জমি আবাদের আওতায় এসেছে।
খইয়াছড়া ঝর্ণা :
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অবস্থিত খইয়াছড়া ঝর্ণা। নিঝুম পাহাড়ি প্রকৃতির ঘুম ভাঙ্গিয়ে অবিরত ছুঁটে চলে এ ঝর্ণা। পাহাড়ের গাঁ বেয়ে ছন্দে আনন্দে আঁকাবাকা পথে গড়িয়ে যায় স্বচ্ছ জল। আর এই ঝর্ণা সৃষ্টি করে মন ভোলানো সৌন্দর্য। যা আকৃষ্ট করে ভ্রমণ পিপাসুদের। সবুজ বনবৃক্ষের আচ্ছাদিত পাহাড়ের গভীরে এই ঝর্ণা। যেমন সুন্দর এই ঝর্ণা তেমনি এর চারপাশের প্রকৃতি। উপজেলার খইয়াছড়া ইউনিয়নের বড়তাকিয়া বাজারের উত্তর পার্শ্বে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়েকের প্রায় ৪.২ কি.মি পূর্বে এই ঝর্ণার অবস্থান। ধারণা করা হয় অনেক বছর আগে থেকে নির্জন পাহাড়ে নিরবে বয়ে চলেছে এই ঝর্ণা। তবে সবুজ বৃক্ষ, গুল্ম,বনলতার আড়ালে এটি অবিষ্কার হতে সময় লেগেছে প্রায় ৫০ বছরের মতো । আবার অনেকে মনে করছেন পাহাড়ি ঢলের ফলে সৃষ্টি হয়েছে এই ঝর্ণা। ২০১০ সালে সরকার বারৈয়াঢালা ব্লক থেকে বড়তাকিয়া ব্লকের প্রায় ২৯৩৪ হেক্টর পাহাড়কে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করায় খইয়াছড়া ঝর্ণা জাতীয় উদ্যানের আওতাভুক্ত হয়। তাছাড়া বাংলাদেশ সরকার ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের রামগড়-সীতাকুণ্ড রিজার্ভ ফরেস্টের খইয়াছড়া ঝর্ণাকে কেন্দ্র করে ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যার অন্যতম মূল লক্ষ্য হলো খইয়াছড়া ঝর্ণার সংরক্ষণ।
খইয়াছড়া ঝর্ণায় মোট ৯টি বড় ঝর্ণার ধাপ রয়েছে। তাছাড়া রয়েছে অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন ধাপ। মূলসড়ক থেকে এই ঝরর্ণায় যেতে হলে কিছুছা পথ সিএনজি-আটোরিক্সা করে যেতে হয়। বাকিটুকু পাহাড়ি উচুঁ নিচু পথ পাড়ি দিতে হয় পাঁয়ে হেঁটে। যেতে যেতে উপভোগ করা যায় মনভোলানো সবুজের সমারোহ। গুল্মলতায় ঘিরে রেখেছে চারপাশ। মাঝে মাঝে দেখা যায় পাহাড়ি ফুল। আর একাধারে পাখির গান যেন পর্যটকদের স্বাগতম জানিয়ে যাচ্ছে। একটু পথ পাড়ি দিলে দেখা যাবে ছোট খাল। ঘাস আর নুড়ি পাথরে ভর্তি এই খাল। এই পথ দিয়েই ঝর্ণার পানি প্রবাহিত হয়। মাঝে মাঝে বড় পাথরও রয়েছে। আবার ঝর্ণার পানিতে ডুবে অনেক পাথর হয়েছে মসৃণ। এই পাথরে একটু বসে চলতি পথের ক্লান্তি দূর করা যায়। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় ঘণ্টা দু থেকে আড়াই ঘণ্টা হাঁটলেই যাওয়া যাবে এই ঝর্ণার নিচের ধাপে। এর উপরে ধাপে ধাপে রয়েছে অন্যসব ঝর্ণা। প্রত্যেক স্তরই অপরূপ সুন্দর। উপরের পাহাড়ি প্রকৃতি থেকে নেমে আসছে সুপ্ত জলরাশি। আর এই জলে শরীর ভিজিয়ে আনন্দে মেতে উঠে পর্যটকরা। কেউবা ছবি তুলে, কেউবা ঝর্ণায় গোসল করে ক্লান্তি দূর করে। আবার কেউ তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবতে থাকে এই সৃষ্টির রহস্য।
নাপিত্তাছড়া:
মিরসরাইয়ে পাহাড়ে অবস্থিত আরেক নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে ভরা নাপিত্তাছড়া ঝর্ণা। ঝর্ণায় প্রবেশে যে ঝিরিপথ আছে তা নাপিত্তাছড়া ট্রেইল নামে পরিচিত। এই ট্রেইলে আছে টিপরা খুম, কুপিটা খুম, বাঘবিয়ানী ঝর্ণা ও বান্দরখুম নামের আরও বেশ কিছু ঝর্ণা ও খুম। তুলনামূলক সহজ ট্রেইল হওয়ায় একটু কষ্ট করলে একদিনেই পুরা ট্রেইল হেঁটে উপভোগ করতে পারবেন।
উপজেলার খইয়াছড়া ইউনিয়নের নয়দুয়ারীয়া বাজার থেকে পূর্ব দিকে রাস্তা ধরে রেললাইন পার হয়ে আরও কিছুদূর হেঁটে গেলে নাপিত্তাছড়া পাহাড় দেখা পাবেন। সেখান থেকে থেকে ঝিরি ও পাহাড়ি পথের যাত্রা শুরু হবে। কিছুদূর যাওয়ার পর প্রথমে এই ট্রেইলের টিপরা খুমের দেখা মিলবে। মূলত এটি একটি ক্যাসকেড। টিপরা খুমের উপরেই কুপিকাটা খুম। এই খুম বেশ গভীর। কুপিকাটা খুমের ডান পাশ দিয়ে পাহাড়ে উঠে আবার ঝিরিতে নেমে সামনে গেলে হাতের বামে আরও একটি ঝিরি পড়বে। এই ঝিরি ধরে ৩০ মিনিটের মত গেলে ঝিরির শেষ মাথায় বাঘ বিয়ানী ঝর্ণা দেখতে পাবেন। সেই ঝর্ণা দেখে আবার পিছনে এসে আগের ঝিরি ধরে সামনের এগিয়ে গেলে কিছু সুন্দর ক্যাসকেড পাবেন আর ঝিরির শেষে দেখা পাবেন বান্দর খুম ঝর্ণার।
বোয়ালিয়া ট্রেইল:
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের অন্যতম আকর্ষণ এখন বোয়ালিয়া ট্রেইল। ঝর্ণা, খুম, জলপ্রপাত, ঝিরি পথ করেছে বহুগুন দর্শনীয়। এই এক রুটেই আপনি দেখা পাবেন ৩টি ঝর্ণা। বোয়ালিয়া ট্রেইলে আছে বোয়াইল্যা, বাউশ্যা, অমরমানিক্য ঝর্ণা। এছাড়া আছেন হাইত্যে কুম, পালাকাটা খুম, উঠান ঢাল, আন্দারমানিক ঝর্ণা, তিন নং ছড়া, কলাতলি ঝর্ণা, লতকাও বা কেম্বাতলী ঝর্ণা এবং লতাবায়ানী। দুই দিকে উঁচু পাহাড় আর মাঝখানে গিরিপথ, পাথুরে দুর্গম ঝিরি-যার দু পাশে গহীন জঙ্গল বোয়ালিয়া ট্রেইলকে করেছে আরও এডভেঞ্চারাস । ঝর্ণার পানিতে পাহাড়ে তৈরি হয় নতুন পরিবেশ।
পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বেড়ে উঠা ঝর্ণাগুলো তখন ফিরে যায় যৌবনে। ঝর্ণার শো শো শব্দে প্রাণ চঞ্চল হয়ে উঠে নিমিষেই। তার পাশাপাশি রয়েছে ট্র্যাকিং পথ ও পর্যটকদের অনেক আকর্ষণ করার বিষয়। আর এখানে অ্যাডভেঞ্চারের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায়। দীর্ঘ পথ ভ্রমণ করে ঝর্ণার শীতল জলের ছোঁয়া পাওয়ার আনন্দ অন্যরকম। উপজেলায় রয়েছে আর অসংখ্য ছোট বড় ঝর্ণা।
মহামায়া লেক :
দেশ-বিদেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসে এ দেশের রূপবৈচিত্র্য উপভোগ করতে। এমনই একটি দর্শনীয় স্থান চট্টগ্রামে মিরসরাইয়ের মহামায়া লেক। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ। ১১ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট লেকটি চট্টগ্রাম শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার উত্তরে মিরসরাই উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের ঠাকুরদিঘি বাজার থেকে দেড় থেকে দুই কিলোমিটার পূর্বে এর অবস্থান।
পাহাড়ের কোলঘেঁষে আঁকাবাঁকা লেকটি যেন সৃষ্টিকর্তার অপার সৃষ্টি। ছোট-বড় কয়েকটি পাহাড়ের মাঝখানে অবস্থিত এ মহামায়া লেকের অন্যতম আকর্ষণ পাহাড়ি ঝর্ণা। স্বচ্ছ পানির জলাধারের চারপাশ সবুজ চাদরে মোড়া। মনে হয় কোনো সুনিপুণ শিল্পীর সুনিপুণ কারুকাজ। নীলাভ জলরাশিতে ডিঙি নৌকা কিংবা ইঞ্জিনচালিত বোট নিয়ে হারিয়ে যেতে পারেন অপরূপ সৌন্দর্যের মাঝে। এসব নৌকার প্রতিটির ভাড়া ওঠানামা করে ৬০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে।
বন্ধুবান্ধব ও পরিবার-পরিজন নিয়ে পানির কলকল ধ্বনিতে মুখর লেকে নৌভ্রমণ ভীষণ আনন্দদায়ক। লেকের চারপাশে পাহাড়ের বুক চিরে ছুটে চলা যে কোনো পর্যটককে এটি মুগ্ধ করবেই। গোধূলি লগ্নে সূর্য্য যখন অন্তিম নীলিমায় ডুবে যায়, তখন লেকের পরিবেশ মোহনীয় হয়ে ওঠে। পিকনিকের জন্য মহামায়া লেক দারুণ একটা জায়গা। এখানে এসে আপনি রান্না করেও খেতে পারেন। অনেকে লেকের কোলে অবস্থিত বিস্তীর্ণ ভূমিতে ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলায় মেতে ওঠে।
যেভাবে যাবেন:
রাজধানীর কমলাপুর থেকে বিআরটিসির বাসযোগে যেতে পারেন। সায়েদাবাদ থেকে এস আলম, সৌদিয়া, গ্রিন লাইন, সোহাগ, ইউনিক প্রভৃতি এসি ও নন-এসি পরিবহনের বাসে চড়ে সরাসরি মিরসরাই যেতে পারেন। এখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশাযোগে মহামায়া লেকে যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে জনপ্রতি ভাড়া গুণতে হবে ১৫-২০টাকা। যেখানে থাকবেন মহামায়া লেকের আশপাশে থাকার তেমন কোনো সুব্যবস্থা নেই। আপনি চাইলে চট্টগ্রামের অথবা সীতাকুণ্ডে অবস্থিত যে কোন হোটেলে উঠতে পারেন। সতর্কতা সাঁতার না জানলে পানিতে না নামাই উত্তম। লেকের পানিতে বোতল কিংবা অপচনশীল দ্রব্য ফেলবেন না।
সোনাইছড়া কৃত্রিম লেক :
সোনাইছড়া পানি প্রকল্প ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বড়তাকিয়া বাজার থেকে ২ কিলোমিটার ও বড়তাকিয়া রেলষ্টেশন থেকে ১ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থান এই লেকটির। সোনাইছড়া পানি প্রকল্পে রয়েছে নয়নাভিরাম ঝর্ণা। ১০ একর বিশিষ্ট লেকের স্বচ্ছ নীলজলরাশি মুগ্ধ করবে যেকোন ভ্রমণপিয়াসু পর্যটকদের। লেকের পাশ বেষ্টিত পাহাড় থেকে বাতাসে ভেসে আসে হরিণের ডাক ও নানা প্রজাতির পাখির সুমধুর কণ্ঠ। ভ্রমণের জন্য লেকে প্যাটেল চালিত বোড ও কায়াকিং ছাড়ার পরিকল্পনা রয়েছে সমিতির ইতোমধ্যে বারৈয়ঢালা ন্যাশনাল পার্ক সোনাইছড়া ঝর্ণাকে ইজারা দিয়েছে।
সোনাইছড়া পানি ব্যবস্থাপনা সমিতির উদ্যোগে ইকো রিসোর্ট নির্মাণ ও বারৈয়ঢালা ন্যাশনাল পার্ক (সিএমসি) অধীনে ইকোশপ নির্মাণ করা হচ্ছে। সোনাইছড়া ঝর্ণার ১ কিলোমিটার উত্তরে খইয়াছড়া ঝর্ণা ও ১ কিলোমিটার দক্ষিণে নাপিত্তাছড়া ঝর্ণা। তবে সোনাইছড়া ঝর্ণায় যাওয়ার জন্য একমাত্র সড়কটি অবহেলিত। কাঁদামাটি ফেরিয়ে যেতে হবে ঝর্ণায়।
বাওয়াছড়া লেক :
মিরসরাই উপজেলার ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের ছোট কমলদহ বাজারের কাছে পূর্ব দিকে পাহাড়ের পাদদেশে লেককের অবস্থান। ছোট কমলদহ বাজার থেকে লেকে দূরত্ব মাত্র তিন কিলোমিটার। বারমাসি ছড়া নিকট অবস্থানের কারণে লেকটিকে বাওয়াছড়া লেক নামে ডাকা হয়। লেকের চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর, যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা কোন নিখুঁত ছবি। ঝর্ণার পানি আছড়ে পড়ার শব্দ এখানে নূপুর ধ্বনির মতই মধুর। দুইপাশের সুউচ্চ পাহাড় থেকে পানির অবিরাম লেকে গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য প্রশান্তি এনে দেয়। সেই সঙ্গে পাহাড়ি সবুজের ফাঁকে পাখির কলতান মন কেড়ে নেয়। পর্যটকেরা তাই বাওয়াছড়া লেকের জলে নাগরিক জীবনের ক্লান্তি ভাসিয়ে দিতে মোটেও ভুল করেন না। এছাড়া ভরা পূর্ণিমা রাতে বাওয়াছড়া লেকে ক্যাম্পিংয়ের জন্য আদর্শ জায়গা।
দেশের যেকোন স্থান থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাই উপজেলার ছোট কমলদহ বাজারের দক্ষিণ পাশে নেমে মাত্র দেড় কিলোমিটার পূর্বে দিকে পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত বাওয়াছড়া লেক যেতে পারবেন। আর চট্টগ্রাম থেকে ছোট কমলদহ আসতে প্রায় ১ ঘণ্টা সময় লাগে।
কোথায় থাকবেন: ছোট কমলদহ কিংবা মিরসরাইয়ে কোন আবাসিক হোটেল নেই। তাই রাত্রিযাপন করতে চাইলে চট্টগ্রাম, ফেনী কিংবা সীতাকুণ্ড উপজেলায় যেতে হবে।
কোথায় খাবেন: কমলদহ বাজারে ড্রাইভার হোটেল নামে একটি প্রসিদ্ধ খাবারের হোটেল রয়েছে। ছাড়া চট্টগ্রাম কিংবা ফেনী শহরে বিভিন্ন মানের খাবার হোটেল ও রেস্টুরেন্ট পাবেন।
মুহুরী সেচ প্রকল্প :
দেশের যে কোনো স্থান থেকে মুহুরী প্রজেক্টের সড়ক যোগাযোগ তথা যাতায়াত ব্যবস্থা যথেষ্ট সুবিধাজনক। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ বাজারের উত্তর পাশ দিয়ে যে রাস্তা পশ্চিম দিকে চলে গেছে সেটিই সহজতর ও একমাত্র রাস্তা। জোরারগঞ্জ হতে প্রজেক্ট পর্যন্ত মাত্র আধা কিলোমিটার রাস্তাতেই পাবেন নিয়মিত সিএনজি অটোরিক্সা সার্ভিস। ভাড়া ট্যাক্সি বা ব্যক্তিগত গাড়িতেই ভ্রমণে সুবিধাজনক হয়। একাকী কিংবা দলবদ্ধভাবে মুহুরী প্রজেক্টে ভ্রমণের পরিকল্পনা করতে পারে।
জোরারগঞ্জ হতে প্রজেক্ট রোডে আট কিলোমিটার চলার পর প্রকল্পের দীর্ঘ ড্যামের (বাঁধের) পূর্বে প্রান্তে পৌঁছাতে পারবেন। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে কিংবা গাড়িতে অথবা রিকশা করে ড্যামের পশ্চিম প্রান্তে সদিৃশ্যময় স্থান রেগুলেটর পর্যন্ত যাওয়া যাবে। বাঁধের উত্তরের নীল জলরাশি আর দক্ষিণের দিগন্ত বিস্তৃত চর ও প্রাকৃতির নৈসর্গিক পরিবেশ, পাইন গাছের সারি, ঝাউ বন, প্রাকৃতিক কাশফুলে ভরা ঘাস প্রকৃতির নৈসর্গিক শোভামণ্ডিতে পরিবেশ যেকোনো পর্যটককেই আকর্ষণ করতে পারে। দর্শনার্থীদের জন্য অন্যতম প্রধান আকর্ষণ চল্লিশ দরজা বিশিষ্ট সারিবদ্ধ রেগুলেটর। এছাড়া বাঁধের মূলগোড়া থেকে প্রকল্পে প্রবেশ না করে বেড়িবাঁধ দিয়ে সোজা দক্ষিণে গেলেই দেখবেন উপকূলীয় বন বিভাগ কর্তৃক সাজানো কৃত্রিম সুন্দর। বনের ফাঁকে ফাঁকে সর্পিল আকারে বয়ে গেছে ছোট ছোট নদী ও অনেক বন্য পশুপাখি।
এখানে পর্যটকদের জন্য উন্নত কোনো হোটেল রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থা নেই। ফাঁকে ফাঁকে বিক্ষিপ্ত কয়েকটি রেস্টুরেন্ট তাই নিজ দায়িত্বেই খাবারের আয়োজনের জন্যে রেগুলেটরের উত্তর পশ্চিমের ছোট বনে রান্না বান্না ও ভোজের আয়োজন করা যেতে পারে। দক্ষিণ পূর্ব প্রান্তে ২/১টি অস্থায়ী ভাসমান চা দোকান বসে। তবে সেখানে রাত্রিযাপনের কোনো সুব্যবস্থা নেই।
ডোমখালী সমুদ্রসৈকত:
চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলা পশ্চিম দক্ষিণে অবস্থিত ডোমখালী সমুদ্রসৈকতে বেড়িবাঁধ সড়কে চোখে পড়ে দূর-দূরান্ত থেকে আসা ভ্রমণপিপাসুদের ঢল। শোনা যায়, সমুদ্রের গর্জন, বনের মধ্যে পাখিদের কলকাকলীর শব্দ। দক্ষিণা নির্মল বাতাসে শীতল করে ক্লান্ত শরীর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ডোমখালী উপকূলীয় বনাঞ্চল ও সমুদ্রসৈকত। সবুজের সমারোহ মিলে এক অপার সৌন্দর্যের নীলাভূমি।
সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস; বাস থেকে উপকূলবাসীকে রক্ষার জন্য’ ৮০ এর দশকে সাগরের কোলজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে হাজার হাজার একর ম্যানগ্রোভ বন। এখানে আছে কেওড়া, বাইন, গড়ান, গেওয়া, সুন্দরীসহ নানা জাতের বৃক্ষ। যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজের সমারোহ। বাঁধের উত্তর ও পশ্চিমে বয়ে চলা দৃষ্টিনন্দন সমুদ্রসৈকত। বায়ান্ন বাঁকের বড়দারোহাট-বেড়িবাঁধ সড়ক অতিক্রম করে দেখা মিলবে বিশাল সমুদ্র সৈকতের। শোনা যাবে সাগরের গর্জন। দখিনা মিষ্টি হাওয়ায় শরীরটা শীতল হয়ে যাবে। উত্তরে দু’চোখ যতটুকু যাবে দেখা মিলবে সৈকতের, দক্ষিণে কেওড়া গাছের সবুজ বাগান। পশ্চিমে শুধু সাগর আর সাগর। চোখে পড়বে দুষ্ট ছেলেদের সাগরের স্বচ্ছ পানিতে লাফালাফি দৃশ্য। ঘাটে আছে সারি সারি ডিঙ্গি নৌকা। জেলেরা কেউ মাছ ধরে সাগর থেকে ঘাটে ফিরছে, কেউ আবার সাগরে যাচ্ছে। এমন নৈসর্গিক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখার জন্য সেখানে প্রতিদিন ছুটে যাচ্ছেন অসংখ্য পর্যটক।
বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের কাজ শুরু করার পর মেরিনড্রইভের বাঁধ নির্মাণের কারণে বিশাল এলাকাজুড়ে সমুদ্র সৈকতের সৃষ্টি হয়েছে। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার একেবারে দক্ষিণ সীমান্তে অবস্থিত এই স্পটের নাম ‘ডোমখালী সমুদ্র সৈকত’। ‘ডোমখালী বিচ’ নামেও এটি পরিচিত। শুধু দিনে নয়, রাতেও সাগর পাড়ে দেখা মেলে অসংখ্য মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকারের। রাতে বেলায় বিশাল সমুদ্রের গর্জন কান পেতে শুনে সেখানে ছুটে যান তরুণরা। পূর্ণিমার রাতে সেখানে তরুণদের ঢল নামে। মিরসরাই থেকে এই সমুদ্র সৈকতের দূরত্ব প্রায় ৪ কিলোমিটার। অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা মিরসরাই উপজেলার একদিকে পাহাড় অন্যদিকে সাগর। ভ্রমণপিপাসুরা চান এমনই একটি স্থান। আঁকা বাঁকা পথে পাহাড় ভ্রমণ কিংবা সাগর দুটোই ভালো লাগে। কোলাহল মুক্ত সাগরের খোঁজে ছুটে চলেন ভ্রমনপিপাসুরা। উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ এলাকায় সমুদ্র সৈকতের আবিষ্কার করছে স্থানীয় ভ্রমণপিপাসুরা।
ডোমখালী পুরোনো সুইচগেট থেকে ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে সাগরের মোহনায় নির্মাণ করা হয়েছে আরো একটি সুইচগেট। যা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হবে সাগরের পানি। এর একটু উত্তরে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। নির্মাণ করা হয়েছে আরো একটি বেড়িবাঁধ। মূলত বেড়িবাঁধের পূর্বাংশে গড়ে উঠছে শিল্প কারখানা। নতুন নির্মিত বেড়িবাঁধ জুড়ে সবুজের সমারোহ, পাখিদের কোলাহল, কিছুদূর পর পর সাগরের সঙ্গে মিশে যাওয়া ছোট ছোট খালের অবিরাম বয়ে চলা, বাঁধের পূর্বে গ্রামীণ জনপদ আর দক্ষিণে সাগরের কোল জুড়ে ম্যানগ্রোভ বন। এসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবেন যে কেউ। কিছুদূর পার হলে শোনা যায় বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের গর্জন। খেজুর, নারকেল আর ঝাউ গাছের সারি। বিস্তৃত চরজুড়ে কেওড়া গাছের সমহার। আছে হরেক রকমের বৃক্ষ। পথে পথে দেখা মিলে সামুদ্রিক বিভিন্ন প্রজাতির মাছ।
সুইচগেট ঘেঁষে জেলেদের ব্যস্ততা, সাগর থেকে মাছ নিয়ে ফেরে জেলেরা। কেউ জাল বুনে অবসরে, কেউ আবার উত্তাল সাগরে নৌকা ভিড়ায়। লাল কাঁকড়া, সাগরের বিভিন্ন জাতের কাঁকড়া ভেজা মাটিতে ছোট ছোট গর্তে মুখ তুলে থাকে। সবুজে বনায়নজুড়ে হরিণের পায়ের পদচিহ্ন।
কখনো কখনো দেখা মিলে হরিণেরও। সন্ধা হলেই শোনা যায় শিয়ালের ডাক। শীতের মৌসুমে খেজুরের মিষ্টি রসের স্বাদ, আর মহিষের দুধের চা খেয়ে মহুর্তেই দুর হবে হবে শরীরের ক্লান্তি। সকালের সূর্যের আলোয় ঝিলমিল করে সাগরের ঢেউ। বিকেলে মিষ্টি রোদ আর সূর্যাস্তের সৌন্দর্য মন কেড়ে নেবে যে কারো।
কীভাবে যাবেন? ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের যে কোনো স্থান থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বড়দারোগাহাট নেমে সিএনজিযোগে একেবারে সাগরপাড়ে যাওয়া যাবে। জনপ্রতি ৪০ টাকা ভাড়া নেবে। রিজার্ভ নিলে পড়বে ২০০-২৫০ টাকা। এছাড়া নিজামপর কলেজের সামনে নেমে সেখান থেকেও সিএনজিযোগে যাওয়া যাবে। তবে এক-দুজন হলে মোটরসাইকেলেও যেতে পারে।
থাকবেন ও খাবেন কোথায়? ডোমখালী সমুদ্র সৈকত এলাকায় থাকা ও খাওয়ার জন্য এখনো কোনো রেস্টুরেন্ট বা আবাসিক হোটের গড়ে ওঠেনি। খাবারের জন্য ছোট কমলদহ বাজারের বিখ্যাত ড্রাইভার হোটেল আছে। যা ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। থাকার জন্য পর্যটন এলাকা থেকে ঘণ্টাখানেকের দূরত্বে চট্টগ্রাম শহরের একেখাঁন ও সীতাকুণ্ডর যে কোন আবাসিক হোটেলে অবস্থান করতে পারেন।
নয়াশতাব্দী/এনএইচ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ