শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১

সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ কলসকাঠী জমিদার বাড়ি

প্রকাশনার সময়: ১৩ জুন ২০২১, ২১:০৯ | আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০২১, ১৯:৩৮

ঝোপঝাড় আর লতাপাতায় ঘিরে আছে পুরো বাড়ি। কেমন একটা গা ছম ছমে সুনসান নীরবতায় বাড়িটিকে মনে হবে ভুতুড়ে। ইট, সুরকি আর পোড়া মাটির কারুকার্যে ঘেরা প্রায় দুই বিঘা জায়গা জুড়ে এই জমিদার বাড়ি। অযত্ন আর অবহেলায় আজ ভুতুড়ে রূপ নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে রয়েছে এখনো। বলছিলাম বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাঠী ইউনিয়নের জমিদার জানকী বল্লভ রায় চৌধুরীর জমিদার বাড়ির কথা।

প্রায় তিনশ বছর আগে ১৭শ শতকের শেষের দিকে জানকী বল্লভ রায় চৌধুরী কলসকাঠী জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন গারুড়িয়ার জমিদার রামাকান্তের পুত্র। রামাকান্তের জানকী বল্লভ রায় চৌধুরী ছাড়াও আরো একজন পুত্র ছিল। জানকী বল্লভ রায় চৌধুরী ছিলেন ছোট। আর তার বড় ভাই ছিলেন রাম বল্লভ। বিভিন্ন কারণে রামাকান্ত তার বড় পুত্রকে বাদ দিয়ে ছোট পুত্র জানকী বল্লভ রায় চৌধুরীকে জমিদারি দেন। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে রাম বল্লভ ছোট ভাই জানকী বল্লভ রায়কে হত্যার পরিকল্পনা করেন। মূলত জমিদারি পাবার জন্যই এই হত্যার পরিকল্পনা করেন রাম বল্লভ।

তবে জানকী বল্লভ রায় চৌধুরী তার বৌদির মাধ্যমে এই ব্যাপারটি জানতে পারেন। পরে রাতের আঁধারে তিনি মুর্শিদাবাদে চলে যান এবং সেখানে নবাবের কাছে এই বিষয়ে জানান। তখন মুর্শিদাবাদের নবাব তাকে রংপুর পরগনার জমিদার হিসেবে নিযুক্ত করেন। জমিদারি পেয়ে তিনি কলসকাঠীতে এসে বসতি স্থাপন করেন। তারপরই কলসকাঠীতে এই জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে ১৩ জন জমিদারের বাস ছিল। তাদের আলাদা আলাদা জমিদার বাড়িও ছিল। তারা মূলত এই জমিদার বাড়ির গোড়াপত্তনকারী জানকী বল্লভ রায় চৌধুরীর বংশধর ছিলেন। তারা সবাই এলাকার প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন।

আসলে কলসকাঠীকে একটি পৃথক জমিদার বাড়ি না বলে বলা যায় একটি প্রাচীন শহর। অনেকটা সোনারগাঁওয়ের পানাম নগরের আদলে তৈরি প্রতিটি স্থাপনা ও প্রাচীরের নকশা। এই জমিদার বাড়িটি তৈরিতে ইট, সুরকির পাশাপাশি পোড়া মাটির কারুকার্য করা হয়েছে। যা সেই তৎকালীন সময়ের আভিজাত্য প্রকাশ করে। জমিদারবাড়ির পাশেই অবস্থিত শিব মন্দির। প্রায় শত বছরের পুরনো এই মন্দিরটি কষ্টি পাথরের মূর্তি ও অন্যান্য ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ। এই মন্দিরে এখনো শত বছরের পুরনো মূল্যবান কোষ্ঠীপাথরের মূর্তি আছে। চুরির ভয়ে মন্দিরের ভেতরে দেবীর মূর্তিকে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। মন্দিরের সামনে ছোট একটি বেদী রয়েছে। যেখানে পূজার সময় প্রাণী বলি দেয়া হয়। প্রতিবছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে এখানে উদযাপিত হয় ঐতিহাসিক জগদ্ধাত্রী পূজা। সর্ববৃহৎ দূর্গা পূজায় কলসকাঠীতে তেমন আনন্দ-উৎসব না হলেও এ পূজা ঘিরে কলসকাঠী পরিণত হয় লাখো মানুষের মিলনমেলায়। দূর দুরান্তের গ্রাম-গঞ্জ থেকে এই পূজায় অংশ নিতে মানুষজন ছুটে আসে।

কলসকাঠীর জমিদারদের মধ্যে সর্বশেষ জমিদার ছিলেন রাজেস্বর রায় চৌধুরী। যিনি ৪৭'এর দেশভাগের পর সবাইকে নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। এরপর সেখানেই বসতি স্থাপন করেন। জমিদার বাড়ির সঙ্গেই ১৮৮২ সালে তৎকালীন জমিদার বরদাকান্ত রায় চৌধুরী নিজের ও তার স্ত্রী মুক্তা কেশীর নামে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয় কে.বি.এম একাডেমী (কলসকাঠী বরদাকান্ত-মুক্তাকেশী একাডেমী) প্রতিষ্ঠা করেন।

তবে আক্ষেপের বিষয় হলো প্রায় তিনশ বছরের পুরনো স্থাপনা অবহেলা ও সংরক্ষণের অভাবে আজ ধ্বংসপ্রায়। এখানে কিছু মন্দির আছে সেগুলোও প্রায় ধ্বংসের মুখে। সঠিক পরিচর্যা ও সংস্কারের মাধ্যমে এই জমিদার বাড়িটিকে কেন্দ্র করে একটি পর্যটন স্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব বলে দাবি করেন এলাকাবাসী। "জমিদার বাড়ির প্রাচীর ও ছাদ সবই আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ছে। স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার জমিদার বাড়িটি সংরক্ষণের দাবি জানানো হলেও কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি প্রশাসন"। তবে জানা যায় 'কেয়ার' নামক একটি সংস্থা স্বাধীনতার পরে স্থাপনাটি সংস্কার ও সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। এছাড়াও জমিদার বাড়ির জায়গায়াটিকে মালিকানা দাবি করা নিয়ে স্থানীয় দুই পক্ষের মধ্যে বিবাদ রয়েছে বলে জানান এলাকাবাসী।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ