গৌরবগাঁথায় লেখা বিজয়ী বাঙালি জাতির সংগ্রাম ও অর্জনের গল্প। শোষণ ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ নিরীহ জাতি নিজেদের অধিকার আদায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে অসম ক্ষমতার গোলা বারুদের যুদ্ধে। দীর্ঘ নয় মাস এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জন করে স্বাধীনতা। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়গাঁথা গৌরবের। আর এই গৌরবের অংশিদার মুক্তিযোদ্ধারা, তাদের পরিবারের সদস্যরা। দেশ মাতৃকা রক্ষায় পরিবারগুলো নিজেদের বাবা, ভাই, চাচাদের যুদ্ধে পাঠিয়েছিল। আর তাদের সেই বৃহৎ ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আজকে আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের অজানা ও না বলা সব ঘটনা জানবো।
আব্দুল্লাহ আল সাদ
স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী
ভেটেরিনারি অ্যানিমেল ও বায়োমেডিকেল সায়েন্সেস অনুষদ
আব্দুল্লাহ সাদের পিতা এগারো নম্বর সেক্টরে মোহনগঞ্জের বিভিন্ন আঞ্চলের যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল সাদ তার পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত আলীর মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা ও তাদের পরিবারের না বলা কথা জানিয়েছেন দৈনিক নয়া শতাব্দীকে।
মুদিমালের দোকান। ছোট্ট দোকানে বেচা-বিক্রি ভালোই চলছে। ঢাকা থাকার সুবাদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি শোনার সৌভাগ্য হয়। ভাষণ শোনার পর আর দেরি নাই। দোকানপাট গুছিয়ে বাড়িতে চলে আসেন। দেরি না করে কাছের কয়েকজন বন্ধু নিয়েই চলে যান মহেশখালীতে। ট্রেনিং করে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চলে আসেন মোহনগঞ্জে। বলছিলাম বীর মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত আলীর কথা। কত শত রাত জাগা সহস্র ঘটনা আর সাহসিকতার প্রতিচ্ছবি তা যেনো এখনো ভেসে উঠে উনার মুখের কথা শুনলে। তারপর তাড়াইল, মোহনগঞ্জ যুদ্ধ করে শেষ সময়ে ছিলেন আজিম উদ্দিন হাইস্কুলে।
নিজের টগবগে যৌবনকালে যেমন দেশের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তেমনি যুদ্ধপরবর্তী সময়ে কখনো তার এলাকায় স্বাধীনতাবিরোধী চক্র মাথা চাড়া দেওয়ার সুযোগই পায়নি। এখনো তার কন্ঠের বলিষ্ঠতা যেকেনো অপশক্তিকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সর্বদা উনার পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষা ও গবেষণায় মনোযোগী হয়ে দেশের কল্যাণে কাজ করে যেতে উৎসাহ দিয়ে আসছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবীত হয়ে দেশ গড়ার লক্ষ্যে তার এবং তার প্রজন্মের অবদান অনস্বীকার্য।
এগারো নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধে ছিনিয়ে নিয়ে আসে লাল-সবুজের পতাকা। অস্ত্র জমা দিয়েছিলেন সে অঞ্চলের তৎকালীন ডিসি মহোদয়ের কাছে।
মো. সাব্বির মোল্লা
স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী (ফিজিওলজি)
ভেটেরিনারি অ্যানিম্যাল অ্যান্ড বায়োমেডিকেল সায়েন্সেস
সিকৃবিসাব্বির মোল্লার পিতা দুই নম্বর সেক্টরের কসবার শশীদলসহ কুমিল্লার বিভিন্ন আঞ্চলের যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. সাব্বির মোল্লা তার পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. হোসেন মোল্লার মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা ও তাদের পরিবারের না বলা কথা জানিয়েছেন দৈনিক নয়া শতাব্দীকে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এক তর্জনির ইশারায় বাংলার কৃষক, শ্রমিকসহ সকল স্তরের বাঙালি দেশ মাতৃকার মানচিত্র পাক হানাদার বাহিনী থেকে ছিনিয়ে আনার জন্য যারা এক হয়েছিলেন; তাদের মধ্যে আমার সাহসী পিতাও এগিয়ে এসেছিলেন। জীবন বাজি রেখে যে পিতা দেশকে স্বাধীন করেছেন, শত্রু মুক্ত করেছেন তার সন্তান হিসেবে যে গর্ব অনুভূত হয়; তা অন্য কোনো অর্জনের সঙ্গে তুলনা করা অসম্ভব। আমি গর্বিত, আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।
একজন মুক্তিযোদ্ধা সবচেয়ে বড় অবদান, প্রত্যক্ষভাবে প্রিয় মাতৃভূমিকে পাক হানাদার বাহিনী থেকে শুরু করে রাজাকারসহ সকল শত্রুদের সঙ্গে লড়াই করে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা। ৭১ এর পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের স্বপক্ষে সবসময় আমার পিতাকে কাজ করে যেতে দেখেছি এবং আজ অবধি তিনি কাজ করে যাচ্ছেন।
একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে সবসময় আমার বীর পিতার মুখে যে দুই-একটি আক্ষেপের কথা শুনে থাকি, তার মধ্যে অন্যতম হলো- ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার বিষয়টি। সেই সঙ্গে রাজাকার ও রাজাকার সন্তানদের ফুসফুস ভরে স্বাধীন বাংলাদেশর বাতাস গ্রহণ।
বাবার মুখে মুক্তিযুদ্ধের গল্পে যেমন শিহরিত হয়ে দেশ বিনির্মাণে উজ্জীবিত হয়ে উঠি। তেমনি সময়ের পরিক্রমায় দেশ মাতৃকার উন্নয়নে যখন ঘাপটি মেরে থাকা একাত্তরের ঘাতক দালালদের ভয়াল থাবায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে উঠে। তখন একজন বয়োবৃদ্ধ বীর মুক্তিযোদ্ধা পিতার নিরব আর্তনাদে ব্যথিত হয়ে উঠি। পুনরায় বাবার মুখে বীরত্বের গল্পে উজ্জীবিত হয়ে দৃপ্ত কন্ঠে শপথ নিয়ে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে সংকল্পবদ্ধ হয়ে উঠি।
ডা. আবুল বাশার জুয়েল
শিক্ষার্থী মেডিসিন বিভাগ
ভেটেরিনারি, অ্যানিমেল ও বায়োমেডিকেল সায়েন্সেস অনুষদ
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ডা. আবুল বাশার জুয়েলের পিতা পাঁচ নম্বর সেক্টরের সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারের বিভিন্ন আঞ্চলের যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ডা. আবুল বাশার জুয়েল তার পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. উমর আলীর মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা ও তাদের পরিবারের না বলা কথা জানিয়েছেন দৈনিক নয়া শতাব্দীকে।
আমার বাবা ছিলেন দেশমাতৃকার একজন গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা। আর আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে গর্বিত। ছোটবেলায় বাবার মুখে অনেক যুদ্ধের কাহিনী শুনেছি। যেখানে অনেক বাবা তাদের সন্তানদের শুনাত রপকথার গল্প, সেখানে তিনি আমাদের শুনাতেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প।
আজ যে লাল সবুজের পতাকা, মানচিত্র নিয়ে গর্ব করি এর অবদান বীর মুক্তিযুদ্ধোসহ সকল শহীদদের। সেখানে কিছুটা অবদান আমার বাবারও রয়েছে, সেকথা ভাবতেই গর্বে বুকটা ভরে ওঠে। আমার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. উমর আলী। তিনি ছিলেন, মানুষ গড়ার কারিগর। যুদ্ধের পর শিক্ষকতা পেশা বেছে নিয়েছিলেন। তিনি ৭ মার্চের ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। টেকেরঘাট সাবসেক্টরে তিনি প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেখানে তৎকালীন এমপি আব্দুস জহুর এবং শফিকুর রহমান ওসিসহ একটি দলকে বালাট ক্যাম্পে পাঠান। ক্যাম্প থেকে একুয়ান লাভা ইউথ ক্যাম্পে ৬নং ব্যাচ প্রশিক্ষণ শেষে ৫নং সেক্টরের সুনামগঞ্জ জেলা সাবসেক্টরে যোগদান করেন। তিনি সুনামগঞ্জের ছাতক, দোয়ারাবাজার ও আশপাশের এলাকায় ক্যাপ্টেন হেলালের নেতৃত্বে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রণ করেন।
দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হয়, আমরা দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হই। এ দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিতেই মিশে আছে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের রক্ত ও ঘাম। ৭১ এ বীর সেনারা পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত অস্ত্রে সজ্জিত সেনাদের বুলেটের মুখে লড়েছিলেন আমাদের মুক্তির জন্য। কিন্তু দেশ স্বাধীন হলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছে বির্তকিত ও বঞ্চিত।
৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর মুক্তিযোদ্ধারা আরও বঞ্চিত ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা ভয়ে নিজেদের পরিচয় দিতে পারত না। তাদের সার্টিফিকেট পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হত। আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে কয়েকবার সরকারি চাকরির ভাইভা দিয়েও চাকরি পাইনি। বয়স শেষের দিকে বেসরকারি রেজিস্টার প্রাইমারি স্কুলে সারাজীবন চাকরি করছেন।
স্বাধীনতার ৫১ বছর পরেও মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাইনি। ১ লা ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা দিবস ঘোষণা করা কথা ছিল সেটাও হলো না। এ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারে আক্ষেপ রয়েই গেছে। মুক্তিযোদ্ধারা আজ সামান্য ভাতাতেই সীমাবদ্ধ। চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়ানো উচিত। মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ কখনও ভুলার নয়, দলমত নির্বিশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান করা উচিত। শুধু জাতীয় দিবসেই নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান সবসময়েই কৃতজ্ঞচিত্তে সম্মরণ করা উচিত।
১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হলে পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। শুধু তাই নয়, তারা একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় গণহত্যা। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয় এবং শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। জাতি এ বছর একাত্তরের মহান বিজয়ের ৫১তম বার্ষিকী পালন করবে। একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা। বিগত ৫১ বছরে দেশ অনেক এগিয়ে গেলেও কাঙ্ক্ষিত সে লক্ষ্য এখনো পূরণ হয়নি। লাখো প্রাণের বিনিময়ে, রক্তের দামে কেনা স্বাধীনতা তখনই অর্থবহ হবে, যখন দারিদ্র্যমুক্ত হবে দেশ, দেশের সব মানুষ হবে স্বনির্ভর।
নয়াশতাব্দী/এফআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ