বাঙালির ত্যাগ, অর্জন, গৌরব আর অহংকারের প্রতীক জাতীয় স্মৃতিসৌধ। ১৫০ ফুট উচ্চতার এ স্মৃতিসৌধ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে জানান দিচ্ছে তার গৌরব, অহংকার আর স্বাধীনতার স্পর্ধা। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত এ স্মৃতিস্তম্ভ বহন করছে বীর বাঙালির ত্যাগ ও অর্জনের নানা কাহিনি। মাথা উঁচু করে যেন বলছে প্রাণ দেবে তবু মাথা নোয়াবে না এ জাতি।
আর তাই জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করে এ জাতি বারবার শ্রদ্ধা জানায় বাঙালির সেই সব দামাল ছেলেদের, যারা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিল। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস ও ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে রাষ্ট্রীয়ভাবে শহিদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও আপামর সাধারণ জনতা। স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে ঢল নামে মানুষের। বছরের ১২ মাসই দর্শক ও পর্যটকদের ভিড় থাকে এ প্রাঙ্গণে। সুন্দর ও অর্থবহ বিন্যাসে স্মৃতিসৌধের মূল নকশা প্রণয়ন করেন স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের গণপূর্ত বিভাগ মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহীদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এরপর নকশা আহ্বান করা হয়। তখন ২৬ বছরের তরুণ স্থপতি মাইনুল ইসলাম স্মৃতিসৌধের নকশা জমা দেন। প্রায় ১৭-১৮ জন প্রতিযোগীর ৫৭টি নকশার মধ্যে তার প্রণীত নকশা গৃহীত হয় এবং তার করা নকশা অনুসারেই ঢাকার অদূরে সাভারে নির্মিত হয় জাতীয় স্মৃতিসৌধ।
স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে রয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গকারী অজ্ঞাত শহিদদের ১০টি গণকবর। পাকবাহিনী আত্মসমর্পণের একবছর পর ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয় জাতীয় স্মৃতিসৌধের। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাভারের নবীনগরে এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু প্রয়াত হওয়ার পর দীর্ঘদিনেও আলোর মুখ দেখেনি জাতীয় স্মৃতিসৌধ।
প্রথম পর্যায়ে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত জমি ক্রয় ও উন্নয়ন, অস্থায়ী পুষ্পবেদি ও সড়ক নির্মাণ করা হয়। এরপর ১৯৭৪ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত চলে দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্মাণ কাজ। ১৯৭৯ সালে গৃহীত নকশা অনুযায়ী নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ১৯৮২ সালে নির্মাণ শেষ করে প্রথম বারের মতো শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। এরপর ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত তৃতীয় পর্যায়ের উন্নয়ন কাজে স্মৃতির মিনারটি নির্মাণ করা হয়। ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় জাতীয় স্মৃতিসৌধের পরিধি। জাতীয় স্মৃতিসৌধের মোট আয়তন ১০৮ একর। এর মধ্যে ২৪ একর এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে বৃক্ষরাজি পরিপূর্ণ একটি সবুজ বলয়।
বাঙালির গৌরব আর অহংকারের ইতিহাসকেই লালন করে গড়ে তোলা হয়েছে পুরো স্মৃতিসৌধ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় অর্জনের মাঝপথে ঘটে যাওয়া সাতটি আলোাচিত ঘটনাকে ত্রিভুজ আকৃতিতে স্থান দেয়া হয়েছে স্মৃতিরমিনারে। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৫৬’র শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয়দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুথান, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ- এই সাতটি ঘটনাকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিক্রমা হিসাবে বিবেচনা করে সৌধটি নির্মিত হয়েছে। মিনারটি ৪৫ মিটার (১৫০ ফুট) উঁচু এবং স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত। মিনার ঘিরে আছে কৃত্রিম হ্রদ এবং মনোরম বাগান।
স্মৃতিসৌধ চত্বরে আছে মাতৃভূমির জন্য আত্মৎসর্গকারী অজ্ঞাতনামা শহীদের দশটি গণসমাধি। সৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে আরও রয়েছে উন্মুক্ত মঞ্চ, ভিআইপি অভ্যর্থনা কক্ষ, মসজিদ, হেলিপ্যাড, ক্যাফেটেরিয়া ও অন্যান্য স্থাপনা। স্মৃতিসৌধ নির্মাণে প্রথম পর্যায়ে ব্যয় করা হয়েছিল মাত্র ২৬ লাখ টাকা। এরপর স্মৃতিসৌধের সৌন্দর্য বাড়াতে আরও কয়েকদফায় খরচ করা হয় ১২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। বর্তমানে স্মৃতিসৌধের দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে সরকারের গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপ-প্রকৌশলী মিজানুর রহমান নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘পুরো স্মৃতিসৌধের সৌন্দর্য বর্ধনে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। স্মৃতিসৌধ আমাদের কাছে অনেক মূল্যবান। এর সংরক্ষণে সর্বোচ্চ চেষ্টা আমরা করি সবসময়ই। সামনে ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস, এদিন রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিসৌধ পরিদর্শনে আসবেন। সার্বিক নিরাপত্তার প্রতিও আমরা খেয়াল রাখছি। গত বছরের তুলনায় এবছর সিসিটিভি ক্যামেরার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।’
নয়াশতাব্দী/জেডআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ