দ্রব্যমূল্যের অব্যাহত ঊর্ধ্বগতি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষদের দাঁড় করিয়েছে একই লাইনে। নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে বেকায়দায় পড়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় খোলাবাজারে খাদ্যপণ্য বিক্রি বা ওএমএস কার্যক্রমের ট্রাক সেলের লাইনে কিছুদিন আগেও ভিড় ছিল নিম্ন আয়ের মানুষের। সেই চিত্র এখন বদলে গেছে। এখন কেবল নিম্ন আয়ের মানুষই নয়, এই সারিতে দাঁড়াচ্ছেন মধ্যম আয়ের মানুষরাও।
বাজার পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তের মধ্যে জীবন টেকানোর লড়াইয়ে পার্থক্য নেই বললেই চলে। তবে মধ্যবিত্তের সংকট ‘সামাজিক মর্যাদা হারানোর ভয়’। মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা বলছেন, দৈনন্দিন বাজার খরচ কিছুটা সাশ্রয়ী করতে লোকলজ্জার ভয় ও অস্বস্তি নিয়েই টিসিবির ট্রাকের লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে। আর নিম্ন আয়ের মানুষরা বলছেন, ওএমএসের লাইনই এখন তাদের ভরসা।
একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন মাহফুজুর রহমান। তার মাসিক ৪০ হাজার টাকা বেতন। জিনিসপত্রের দাম, বাড়ি ভাড়া, ইউটিলিটি বিল এতই বেড়েছে যে তার একার আয়ে তিনজনের সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হয় তাকে। গত জুলাই মাসে স্ত্রী-সন্তানকে গ্রামের বাড়িতে রেখে এসে নিজে উঠেছেন একটা মেসে। ভাড়া চার হাজার টাকা। বাড়িভাড়া বাঁচিয়ে কোনোমতে কিছু টাকা গ্রামে পাঠিয়ে চলতে পারছেন। সমাজে চলতে, অফিসে প্রতিদিনের সামাজিকতাসহ কিছু খরচ চালিয়ে কোনোভাবেই সৎ উপায়ে জীবনযাপন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ‘অফিস থেকে ফেরার পরে প্রায় প্রতিদিনই ঝগড়া লেগে যায়। এটা নাই সেটা নাই করে জীবন চালাতে গিয়ে আমরা পরস্পরের সঙ্গে ভালোবাসার কথা বলতে ভুলে গেছি।’
সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক নেহাল করিম মনে করেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্তদের সব সমস্যা। না পারে জীবনমান টিকিয়ে রাখতে, না পারে নামতে। দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন তারা নিয়মিত প্রোটিন খেতে পারছে না। যারা হয়তো দেশি মুরগি খেত, তারা ব্রয়লারে নামছে। কিন্তু এরচেয়ে নামবে কী করে? তাদের কাছে ব্যাংক ব্যালেন্স নেই। ফলে সীমিত অর্থে চালানোর জন্য সন্তানের হাত খরচ কমাচ্ছে। লেখাপড়ার জন্য বাড়তি কিছু করতে চেয়েও পারছে না। সার্বিকভাবে সে বিপদের মধ্যে আছে। ফলে এক ধরনের হীনম্মন্যতা জন্মাচ্ছে। সেটা সন্তানের সামনে, সমাজের সামনে। এই পরিস্থিতিতে তার মানসিকতা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুরের বিভিন্ন ট্রাক সেল পয়েন্ট ঘুরে দেখা যায়, টিসিবির লাইনগুলোতে বিভিন্ন নিম্নআয়ের মানুষের ভিড় লক্ষণীয়। এসব লাইনে বিশেষত পরিবারে কর্মহীন বয়স্ক মানুষের সংখ্যাই বেশি। মিরপুর ১৩ নম্বরে ডেসকো অফিসের পাশে ওএমএসের ট্রাকের লাইনে অপেক্ষমাণ ষাটোর্ধ্ব নারী আমেনা খাতুন। তিনি বলেন, ‘সকাল ১০টা থেকে এখানে দাঁড়িয়ে। দুপুর ১টা বেজে গেছে। এখনও ট্রাকের কাছেই যাইতে পারি নাই। দুই নাতি-নাতনি নিয়া থাকি। ওগো বাপে আরেক জায়গায় বিয়া কইরা গ্যাছে গা। আর ওগো মায়ে ২০২০ সালে বিদেশ গেছে, আর আহে নাই। মাঝে মাঝে কিছু টাকা পাঠায়। সেই টাকায় মিলা-ঝিলায়া চলি। এহন এই টাকায় বাজার থেকে সদাই কিনলে পুরা মাস আর চলা যাইব না। এই জায়গায় আইলে কমে চাইল-আটা কেনা যাইতাছে। তাই কষ্ট হইলেও এই লাইনেই আইসা দাঁড়াই।’ এদিকে ওএমএসের ট্রাকের রেশন কিনতেও সবচেয়ে বিপাকে থাকেন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা। অনেক দোটানার মধ্য দিয়ে তাদের লাইনে দাঁড়াতে হয় বলে জানান তারা। কেউ দেখে ফেললে কী ধরনের আচরণ করবে সেই চিন্তাও কাজ করতে থাকে মাথার মধ্যে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গৃহিণী বলেন, ‘সবসময় আসি না। আজ আটা নিতে এসেছি, তার সঙ্গে চালও নিতে হচ্ছে। বাচ্চাদের সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে নাস্তার জন্য রুটি বানিয়ে দেই। সেই আটাই এখন ৭০-৭৫ টাকা কেজি। বাসার লোকের তো আর আয় বাড়ে নাই। কিন্তু বাচ্চাদের নাস্তায় রুটি দিতে পারব না, এইটা ভাবলেও কষ্ট লাগে। তাই এখানে ভিড় কম থাকলে দাঁড়াই, না হলে চলে যাই।’ শেরেবাংলা নগর থানার মোল্লাপাড়া বাজারে ১০ জনের একটি দলের সাতজনই জানান, আগে মাছ-মাংস একসঙ্গে হলেও এখন গেস্ট না হলে তেমন রান্না এড়িয়ে যান। খাবারের মেন্যু আগের তুলনায় কমিয়ে দিয়েছেন। বিকেলের নাস্তায় বাইরে থেকে কিছু না এনে ঘরেই বানানোর চেষ্টা করেন। আগারগাঁও এলাকা থেকে ব্যক্তিগত গাড়িতে অফিসে যাওয়া ছেড়েছেন বলে জানিয়েছেন ওই ১০ জনের আটজনই। বাচ্চাদের দূরের স্কুল থেকে কাছের স্কুলে এনেছেন স্কুলের বেতন ও গাড়ির তেল বাঁচানোর জন্য। সন্তানদের নিয়মিত জীবনে কোনো পরিবর্তন আনতে হয়েছে কিনা— প্রশ্নে তিনজন জানান, হুটহাট ফুডপান্ডায় অর্ডার করতে নিষেধ করা হয়েছে। দশম শ্রেণিতে পড়া সন্তানদের হাত খরচ এক হাজার টাকা কমিয়ে ৫শ’ টাকা দেয়ার কথা জানান তারা। আত্মীয় বাড়ি যেতে হলে কিছু না কিছু নিয়ে যেতে হয়, ‘সেই ঝামেলা’ এড়াতে নানা অজুহাতে যাওয়া কমিয়েছেন ৬০ শতাংশ মানুষ।
অফিস থেকে ফেরার পথে শেরেবাংলা নগর থানার মোল্লাপাড়া বাজারে মুরগি কিনতে নামেন সামিয়া। বাজারের হালচাল নিয়ে তিনি বলেন, ‘যারাই নিজেদের সীমিত আয়ে সম্মান বাঁচিয়ে চলতে চান, তাদের অবস্থা ভালো বলার কোনো সুযোগ নেই। বাসায় দুটো বাচ্চা আছে। তাদের তো পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়। নদীর মাছ আগে কেনার কথা ভাবলেও এখন একদমই ছেড়ে দিয়েছি। চাষের রুই আর ব্রয়লার মুরগি কিনি। এই হচ্ছে ভালো মেন্যু। কিন্তু সেই সস্তা ব্রয়লার মুরগির দামও কেজিতে ৪০ থেকে ৫০ টাকা বেড়েছে।’ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মধ্যবিত্ত সবার আগে খাওয়া কমিয়ে দেয় উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘থিওরি বলে, কোনো বৈষম্য সৃষ্টি হলে মধ্যবিত্তরাই বেশি চাপে পড়ে। মধ্যবিত্ত খাওয়া কমানোর পাশাপাশি নিয়মিত জীবনযাপনের সব বিষয়ে খরচ কমানোর কৌশল অবলম্বন করে টিকে থাকতে চেষ্টা করে। কেননা, তার সামাজিক পজিশনের কারণে সে ঝুঁকি নিতে ভয় পায়। ঝুঁকি নিয়ে মধ্যবিত্তের এক অংশ পরাজিত হয়ে ফেরত আসে। আরেক অংশই কিন্তু তার অবস্থান পরিবর্তন করে বিত্তশালী হওয়ার সম্ভাবনায় যায়। ফলে এই পরিস্থিতিতে তাদের ভালো উদ্যোক্তা হওয়ার সম্ভাবনাটাকে জিইয়ে রাখার জন্য, যা করণীয় সেটায় পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার বিষয়টি ভাবতে হবে।’
হীনম্মন্যতা ও পারস্পরিক সম্পর্কের ওপরে প্রভাব পড়ার বিষয়ে মনোচিকিৎসক ডা. মেখলা সরকার বলেন, ‘যে কোনো ধরনের পরিবর্তন, সেটা দৈনন্দিন জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করলে এক ধরনের চাপ হয়। সেটা সামলাতে না পারলে ব্যবহারে অসঙ্গতি দেখা যায়। তখন সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর। যে কোনো না পাওয়া নিয়ে পরস্পরকে দোষারোপ করতে থাকে। দ্রব্যমূল্যের কারণে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা থেকে এই দোষারোপ শুরু হয়। এখন মূলত দরকার পরিস্থিতি স্বীকার করে নিয়ে মানসিক প্রস্তুতি। পরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে— সেটা খেয়াল করে সামনে আরও কীসের মুখোমুখি হতে হবে, সেই ধারণা নিয়ে পরিকল্পনা করে পারস্পরিক পথ চলার পদ্ধতি নির্ধারণ জরুরি।’
নয়াশতাব্দী/এমএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ