ঠোঁটে লিপিস্টিক, পরনে রংচঙ্গা থ্রিপিস। চলাফেরায় মেয়েলিভাব। মেকআপে ভরপুর। প্রথম দেখাতেই মনে হবে কোনো সুন্দরী নারী। সাজুগুজু করে থাকতে পছন্দ তাদের। হিজড়া নয়- কিন্তু হিজড়া সেজে রাস্তাঘাটে টাকা তুলছে একটি চক্র। একইভাবে কিছু পুরুষ স্বেচ্ছায় লিঙ্গ পরিবর্তন করে হিজড়া সেজে চাঁদাবাজি করাসহ বিভিন্ন প্রতারণামূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে।
নাইমুর রহমান। চাকরি করেন মতিঝিলের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। বাসে ওঠেন টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকা থেকে। প্রতিদিন হিজড়াদের চাঁদা গুনতে হয় ৩-৪ স্থানে। আর কয়েক পয়েন্টে ছাড় পেয়ে যান নানা অজুহাতে।
তিনি বলেন, ১০ টাকার কম দিলে নিতে চায় না। বিভিন্ন প্রকার অশালীন আচরণ আর গালমন্দ শুনতে হয়। কিন্তু নীরব ভূমিকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আর যাত্রীরা প্রতিবাদ করতে গেলেই চড়াও হয়ে ওঠে। অনেক সময় মারামারির পর্যায়ে চলে যায়।
সরেজমিনে টঙ্গী, আব্দুল্লাহপুর, উত্তরা, বিমানবন্দর, খিলক্ষেত, কুড়িল, বাড্ডা, বনানী, মহাখালী, বিজয়সরণি, মগবাজার, মিরপুর, ফার্মগেট, শাহবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গণপরিবহনে উঠে চাঁদাবাজি করতে দেখা যায়। গণপরিবহন ছাড়া ট্রেনেও চলে এ চাঁদাবাজি।
রাজধানীর গণপরিবহনে হিজড়াদের (তৃতীয় লিঙ্গ) চাঁদা আদায়ের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে দিনের পর দিন। ঢাকার একাধিক পয়েন্টে হিজড়াদের এ ধরনের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ গণপরিবহনের যাত্রীরা।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, তারা এই জনগোষ্ঠীর কাছে রীতিমতো অসহায়। যদি তারা প্রকৃত হিজড়া হতো তাহলে তাদের টাকা দিতে আমাদের কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু তারা একদম পুরুষ। কাজ করে এভাবে হিজড়ার আড়ালে চাঁদাবাজি করে বেড়াচ্ছেন। একজন বেসরকারি চাকরিজীবী শামসুন নাহার নয়া শতাব্দীকে বলেন, এদের (হিজড়াদের) টাকা না দিলে এমন অশ্লীল কথা বলে লজ্জা পেতে হয় অন্য যাত্রীদের সামনে। ভয়ে বাধ্য হয়ে টাকা দিতে হয়।
তিনি বলেন, চলার পথে আব্দুল্লাহপুর থেকে মহাখালী যেতেই ৬ জায়গাতে চাঁদা দিতে হয় তাদের। কিছু পয়েন্টে ছাড় পাওয়া যায়। এভাবে সব রুটেই রয়েছে হিজড়াদের দৌরাত্ম্য। ১০ টাকার কম দেয়া যায় না। কম দিলেই হতে হয় নাজেহাল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও হিজড়াদের এমন আচরণের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয় না।
গণপরিবহনে চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হিজড়া সম্প্রদায়ের ‘গুরুমা’রা বলেন, আমাদের কোনো হিজড়া গণপরিবহনে চাঁদাবাজি করে না। এটা আমাদের নিয়মেও নেই। যারা করছে তারা প্রকৃত হিজড়া না। এরা পুরুষ, খোঁজ নিলে দেখা যাবে এদের বিরুদ্ধে গ্রামের লোকাল থানায় মাদকসহ বিভিন্ন মামলা রয়েছে। আত্মগোপনে থাকতে তারা এ পেশা বেছে নিয়েছে। এমন অনেককেই পেয়েছি আমরা।
তারা বলছেন, এলাকা ভাগ করে বিভিন্ন মার্কেট ও দোকানপাটে সপ্তাহে এক দিন তাদের ( দোকানিদের) খুশিমতো টাকা নেয়া হয়। আর কারও সন্তান হলে নাচ-গান করে দোয়া করে দেয়। এতে খুশি হয়ে যা টাকা দেয় সেটা নিয়ে চলে আসি। রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। দোকানপাটের পাশাপাশি গণপরিবহনে উঠে যাত্রীদের কাছ থেকে জোর করে চাঁদা আদায় করছে তারা। যাত্রীরা চাঁদা দিতে না চাইলে অশ্লীল সব কৌশল অবলম্বন করে হিজড়ারা। বিশেষ করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ও মধ্যবয়সি পুরুষরা এদের টার্গেট। আর পুরুষের সঙ্গে যদি নারী থাকে তাহলে তাদের জিম্মি করে টাকা নেয়।
কয়েক শিক্ষার্থী নয়া শতাব্দীকে জানান, প্রথমে সুন্দর ব্যবহার দিয়ে শুরু করলেও টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে অশ্লীল আচরণ শুরু করে। পরনের কাপড় খোলার হুমকি দিয়ে পুরুষের শরীরের বিভিন্ন অংশে হাত দেয়। পরে বাধ্য হয়ে টাকা দিতে হয়।
গতকাল সোমবার। ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ২টা। রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকা থেকে ভিক্টর পরিবহনের একটি বাসে ওঠে দুই হিজড়া। যাত্রীদের কাছ থেকে তারা ১০ টাকা করে আদায় করেন। যাত্রীরা টাকা না দিতে চাইলে তারা ওই যাত্রীকে নাজেহাল করে কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় নেমে যায়।
বাসে থাকা যাত্রী নাজনিন আক্তার নয়া শতাব্দীকে বলেন, রামপুরা অফিস যাচ্ছি। প্রায় দিনই এদের ১০ টাকা করে দিতে হয়। টাকা না দিলে অশালীন কথা বলে সবার সামনে। যা শুনে লজ্জা পেতে হয়। কুড়িল থাকে অপর এক গ্রুপ বাসে উঠে ভাটারা থানার আগেই নেমে যায়। ভাটারা থেকে অন্য এক গ্রুপকে আবার চাঁদা দিতে হয়। এভাবেই তাদের চাঁদাবাজি চলে। বনানীর আর্মি স্টেডিয়াম এলাকা থেকে বলাকা পরিবহনে ওঠে অন্য দুই হিজড়া। বাসে ওঠে দুই পাশে তারা টাকা চান। না দিলেই চলে অশালীন আচরণ।
মৌসুমি নামের এক হিজড়া নয়া শতাব্দীকে বলেন, আমরা ইচ্ছা করে চাঁদাবাজি করি নারে ভাই। পেটের দায়ে করি। হাত পেতে টাকা নিই মানুষের কাছ থেকে। কেউ আমাদের একটা চাকরি দেই না— তাহলে কোথায় যাব। রাজধানীর কাঁটাবন এলাকা। সেখানে দেখা যায়, সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা রিকশার যাত্রীদের কাছ থেকে হিজড়ারা টাকা তুলছে। আবার ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়া যাত্রীরাও তাদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, হাতে গোনা কিছু হিজড়া ভালো আচরণ করলেও অধিকাংশই আক্রমণাত্মক। যাত্রীদের সঙ্গে পরিবারের কোনো সদস্য থাকলে হিজড়ারা আরও বেশি অপদস্থ করে। এতে যাত্রীরা সম্মান বাঁচাতে হিজড়াদের চাহিদা পূরণে বাধ্য হন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা মাঝে মধ্যে হিজড়াদের অশ্লীল আচরণে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার করে থাকলেও পরে আবার যেই-সেই।
নামপ্রকাশ না করার শর্তে একজন হিজড়া জানান, কিছু মেয়েলি আচরণের পুরুষকে দলে ভিড়িয়ে হিজড়া গুরু মা’রা মাঠে নামিয়ে দিচ্ছেন চাঁদাবাজি করতে। সম্প্রতি মালিবাগের একটি লেজার পার্লারের মালিককে গ্রেফতার করেছে ডিবি। সেই পার্লারের আড়ালে মালিক হাদিউজ্জামান অন্তত ১০০ পুরুষকে হিজড়ায় রূপান্তর করেছেন। প্রত্যেকের কাছ থেকে তিনি হাতিয়েছেন ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা।
কয়েক মাস আগে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ হাদিউজ্জামান ও তার সহযোগীদের গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের সময় হাদীউজ্জামান নিজের অপরাধ স্বীকার করে বলেন, আমি ডাক্তার না, খুলনায় এক ডাক্তারের সঙ্গে কাজ করতাম। তার কাছ থেকে এই কাজ শিখেছি। আমার লেজার সেন্টারে হিজড়া হতে এলে পুরুষাঙ্গ কেটে ক্যাথেড্রাল স্থাপন করে দিতাম।
গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, যারা হিজড়া হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে মাদক, অস্ত্র ও চুরির মামলাসহ বিভিন্ন মামলার পলাতক আসামি। নিজেদের আত্মগোপনে থাকতে এ পেশা বেছে নেয়। তারা বলছেন, একটি চক্র এসব মানুষকে হিজড়ায় রূপান্তর করে নানা অপকর্ম করাচ্ছে। চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় আনতে নজরদারি রেখেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
সম্প্রতি হিজড়াদের নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ হিজড়া কল্যাণ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবিদা সুলতানা মিতু বলেন, সরকার হিজড়াদের উন্নয়নে উদ্যোগ নিয়েছে ঠিকই। কিন্তু সঠিকভাবে কাজটা হচ্ছে না। যে কারণে হিজড়াদের দৃশ্যমান কোনো উন্নতি হচ্ছে না।
তিনি বলেন, সম্প্রতি ঢাকা শহরের গুরু মা’দের নিয়ে আমরা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি নগর পরিবহনে হিজড়াদের কোনো ধরনের চাঁদাবাজি করা যাবে না। যদি কেউ পরিবহনে চাঁদাবাজি করে তবে এর দায়-দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সরকার যদি হিজড়াদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে তবে আমরা বাসাবাড়ি, দোকানপাটে হিজড়াদের চাঁদাবাজি বন্ধের ব্যবস্থা করব।
ডিবির হাতে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, আমরা খবর পেয়েছি রাজধানীসহ বিভিন্ন পার্লারের আড়ালে অস্ত্রোপচার করে লিঙ্গ পরিবর্তন করা হচ্ছে। পরে এদের রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে চাঁদাবাজি করছেন। সেগুলো তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া ও জনসংযোগ বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) ফারুক হোসেন বলেন, যে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে পুলিশ ব্যবস্থা নেয়। তিনি বলেন, সরকার ও বাংলাদেশ পুলিশ এই সম্প্রদায়ের মানুষদের কর্মক্ষম ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে সহানুভূতিশীল। তবে হিজড়াদের কারও কারও উচ্ছৃঙ্খল আচরণ দুঃখজনক।
অন্যদিকে, সদ্য বিদায়ী ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান বর্তমানে ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রধান ‘তৃতীয় লিঙ্গের’ এসব মানুষের উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের গবাদি পশুর খামার, বিউটি পার্লার, মিনি গার্মেন্টসসহ পছন্দ মতো কর্মে নিয়োজিত করে দিয়েছেন। এদিকে, ট্রাফিক পুলিশে হিজড়াদের নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ