ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কাটআউটে স্বর্ণ পাচার

প্রকাশনার সময়: ১৩ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮:০৯

নির্দিষ্ট হারে শুল্ক দিয়ে স্বর্ণ আমদানির সুযোগ করে দিয়েছে সরকার। কিন্তু তাতে সাড়া না দিয়ে এখনও অবৈধপথে দুবাই ও আর্জেন্টিনা থেকে স্বর্ণ আনা হচ্ছে দেশে। এরপর তা স্থলপথে চলে যাচ্ছে ভারতে। মাঝে মধ্যে বিমানবন্দরে কিছু স্বর্ণ জব্দ হলেও সম্প্রতি সীমান্তে উল্লেখযোগ্য হারে স্বর্ণ উদ্ধার হচ্ছে। এতে চিন্তিত গোয়েন্দারা।

এসব ঘটনায় বাহক হিসেবে অনেকে গ্রেফতার হলেও মূল হোতারা থেকে যাচ্ছেন আড়ালে। কারণ কাটআউট পদ্ধতিতে এসব স্বর্ণ পাচার হচ্ছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে। তদন্তকারীদের জিজ্ঞাসাবাদে বাহক কখনই প্রকৃত মালিকের সন্ধান দিতে পারছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।

এ বিষয়ে কারও আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া না গেলেও তদন্ত তদারক একটি সূত্র মতে, তিন থেকে চার ধাপে স্বর্ণ পাচার হয়ে থাকে। প্রথম ধাপে বাহক হিসাবে দুবাই ও সিঙ্গাপুর থেকে একজন ব্যক্তি স্বর্ণ নিয়ে আসেন। এক্ষেত্রে প্রথম ব্যক্তি নিজেও জানে না ওই স্বর্ণ কার কাছে পৌঁছাতে হবে। শুধু বিদেশে তার পাসপোর্টের ফটোকপি রেখে দেয়া হয়। এরপর তাকে বলে দেয়া হয় দেশে পৌঁছানোর পর বিমানবন্দরে তার কাছ থেকে দ্বিতীয় ব্যক্তি একটি সাংকেতিক কোড ব্যবহার করে স্বর্ণ রিসিভ করবে।

দ্বিতীয় ব্যক্তির কাজ হচ্ছে ওই স্বর্ণ সীমান্তে পৌঁছে দেয়া। সেখান থেকে বাহক হিসেবে সাধারণ কোনো ব্যক্তিকে ব্যবহার করে ওই স্বর্ণ সীমান্ত দিয়ে পাচার করা হয়। আর এই পুরো প্রক্রিয়াটিই বিদেশে বসে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। গোয়েন্দাদের ভাষায় এ ধরনের কার্যকলাপকে কাটআউট বলা হয়ে থাকে। এই পদ্ধতি শুধু জঙ্গি ও স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করে থাকে। তবে সম্প্রতি কিছু স্বর্ণ আটকের ঘটনায় পুরান ঢাকার এক নামকরা ব্যবসায়ীর নাম উঠে এসেছে। তাকে সবাই স্বর্ণ ও হুন্ডি ব্যবসার মাফিয়া বলে থাকেন।

জানা গেছে, ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর কামাল আতাতুর্ক রোডে পুলিশের চেকপোস্টে অবৈধ স্বর্ণের একটি চালানসহ শহীদ হোসেন রায়হান নামে এক যুবক গ্রেফতার হন। তিনি চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার খায়ের আহম্মেদের ছেলে। তার কাছ থেকে ৬টি স্বর্ণের বার উদ্ধার হয়। প্রতিটি স্বর্ণের বারের ওজন ১১৬ গ্রাম করে।

এর মধ্যে ৫টি স্বর্ণের বারের গায়ে খোদাই করে গলফ গোল্ড রিফাইনারি এবং একটি বারের গায়ে এআরজি লেখা রয়েছে। গলফ গোল্ড রিফাইনারি দুবাইভিত্তিক স্বর্ণ শোধনাগার প্রতিষ্ঠান। আর এআরজি আর্জেন্টিনাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। অবৈধপথে আনা স্বর্ণ বহন ও চোরাচালানের দায়ে গুলশান থানায় একটি মামলা দায়ের হয়।

রায়হানের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, চোরাচালানের মাধ্যমে দুবাই থেকে আসা এই স্বর্ণের বার ঢাকা বিমানবন্দর থেকে তিনি গ্রহণ করেন। পরে এই স্বর্ণ পল্টনের স্বর্ণ ব্যবসায়ী ফয়সাল আহমেদ মুন্নার কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য তিনি নিয়ে যাচ্ছিলেন। এভাবে এর আগেও বেশ কয়েক দফায় তিনি চোরাচালানের মাধ্যমে আসা স্বর্ণের বার ঢাকার বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। পরে ওইসব ব্যবসায়ীর হাত ঘুরে অবৈধ স্বর্ণের বার চলে যায় জেলা শহরের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের কাছে। পরে সেখান থেকে চলে যায় ভারতে। সম্প্রতি সীমান্তে আটক হওয়া স্বর্ণের গায়েও এ ধরনের চিহ্ন পাওয়া গেছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমানবন্দরে কর্মরত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যোগসাজশে স্বর্ণের বড় চালান নির্বিঘ্নে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে যায়। এ কাজে সহায়তা করেন শুল্ক, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও বিমানের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী। ১০ তোলা ওজনের একেকটি সোনার বার বিমানবন্দর থেকে বাইরে এনে দিলে চোরাচালানিদের কাছ থেকে এক হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পান তারা।

আবার অনেক সময় দুবাই, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে আসার সময় বিমানের কোনো কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী স্বর্ণ পরিবহনে সহায়তা করেন। বাহকদের হাতে স্বর্ণ ধরিয়ে দেন দুবাইয়ে অবস্থানরত চক্রের প্রধানরা। বাহক সেই স্বর্ণ বিমানের আসনের নিচে, শৌচাগারে বা অন্য কোনো স্থানে লুকিয়ে রেখে বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। পরে বিমানবন্দরে কর্মরত লোকজন নিজ দায়িত্বে সেই স্বর্ণ বের করে বাইরে নিয়ে আসেন। তবে বৈধ পথে তো স্বর্ণ আমদানি করা হচ্ছে।

বৈধপথে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণবার আনা হয়েছে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। তবে করোনার কারণে আকাশপথে যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ ছিল। এ সময় বিদেশ থেকে আকাশপথে কোনো স্বর্ণ আমদানি হয়নি। নিয়মানুযায়ী, ব্যাগেজ রুলের আওতায় একজন যাত্রী বিদেশ থেকে ফেরার সময় ঘোষণা দিয়ে সর্বোচ্চ ২৩৪ গ্রাম ওজনের স্বর্ণের বার নিয়ে আসতে পারেন। এতে সর্বোচ্চ দুটি বার আনা যায়।

বৈধভাবে স্বর্ণের বার আমদানির জন্য প্রতি ভরিতে (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) শুল্ক-কর ২ হাজার টাকা। তবে বিদেশ থেকে ফেরার সময় একজন যাত্রী ১০০ গ্রাম ওজনের (প্রায় সাড়ে আট ভরি) স্বর্ণালংকার বিনা শুল্কে আনতে পারেন। তবে একই রকমের অলংকার ১২টির বেশি আনা যায় না। তবে বৈধপথে স্বর্ণ আমদানিতে অনীহা রয়েছে পাচারকারীদের।

বিজিবির দেয়া তথ্যমতে, গত দুই মাসে তারা দেশের অন্তত ১২টি জেলার বিভিন্ন সীমান্ত থেকে অন্তত শতকোটি টাকার স্বর্ণ জব্দ করেছে। জব্দকৃত স্বর্ণগুলো ভারতে পাচারের উদ্দেশ্যে নেয়া হচ্ছিল। এসব ঘটনায় আটককৃতরা প্রকৃত স্বর্ণের মালিককে কখনও চেখে দেখেনি বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। কাটআউট পদ্ধতিতে তারা টাকার বিনিময়ে সীমান্ত পার করার দায়িত্বে ছিল বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র দাবি করেছে।

জানা গেছে, সীমান্তঘেঁষা ১২ জেলার অর্ধশতাধিক পয়েন্ট দিয়ে ভারতে স্বর্ণ পাচার বাড়ছে। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে, কৃষক, দিন-মজুর, ট্রাক-লরির চালক, খালাসি, রাখাল ও জেলেদের। কখনও আবার টিফিন বক্স, মৌসুমি ফলের ঝুড়ি, সবজি ও মানব শরীরে স্বর্ণ পাচারের সময় গ্রেফতারের ঘটনাও ঘটছে। তবে চোরাচালানের মূল হোতাদের ধারেকাছেও যেতে পারছে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। যার ফলে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে রাঘব বোয়ালরা।

সূত্র জানায়, সাতক্ষীরা, বেনাপোল, কুষ্টিয়া, যশোর, লালমনিরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী দিয়ে বেশি স্বর্ণ পাচার হচ্ছে। স্বর্ণ চোরাকারবারিরা বাংলাদেশ ও ভারতের মোবাইল-সিম ব্যবহার করে। কথাবার্তা চলে এসএমএসের মাধ্যমে। আকাশপথে স্বর্ণ আসার পর বাস ও ট্রেনে সীমান্ত জেলাগুলোতে পৌঁছে যায়।

বিজিবির কর্মকর্তাদের দাবি, দুই দেশের সীমান্ত রক্ষীরা স্বর্ণ পাচারের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে নজরদারি করছে। যে সব পয়েন্ট দিয়ে স্বর্ণ পাচার হচ্ছে সেখানে নজরদারি ও টহল বাড়ানো হলেও কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি স্বর্ণ পাচার তৎপরতাও বেড়ে গেছে অস্বাভাবিকভাবে। গ্রেফতার হলেও জামিনে বেরিয়ে ফের কারবারে নেমে পড়েন। কাস্টমস ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্যমতে, চোরাকারবারিরা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোসহ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও দুবাই থেকে স্বর্ণ এনে বাংলাদেশ ও ভারতের বাজারে সরবরাহ করছে। এ কাজে তারা নিজস্ব বাহক যেমন কাজে লাগাচ্ছে, তেমনি টাকার টোপে কখনও পাইলট, কখনও ক্রু, কখনও বিমানবালাকেও কাজে লাগাচ্ছে। তাছাড়া বিমানের ক্লিনার, ট্রলিম্যান এমনকি প্রকৌশলীরাও এই চক্রের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে স্বর্ণ পাচার চালিয়ে যাচ্ছে। যাত্রীবেশি বাহকের সঙ্গে থাকা ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, ইলেকট্রিক মোটর, দেহের বিভিন্ন অংশ, ট্রলির ওপরের হ্যান্ডেল ও মানিব্যাগে করে স্বর্ণ পাচারের ঘটনা ঘটছে।

এছাড়া রোগী সেজে হুইলচেয়ারে, ঊরুতে অ্যাংকলেট বেঁধে, জুতার মধ্যে, বেল্ট দিয়ে কোমরবন্ধনীর ভেতরে, শার্টের কলারের ভেতরে, স্যান্ডেলের সঙ্গে, সাবান কেসে, সাউন্ড বক্সের অ্যাডাপটরে লুকিয়ে, বিভিন্ন ধরনের খাদ্য বা ওষুধের কৌটা, প্যান্টের নিচে শর্টসের ভেতর, ল্যাপটপের ব্যাটারির ভেতর, মানিব্যাগে ও গলায় চেইনের সঙ্গে ঝুলিয়ে লকেট হিসেবেও আনা হচ্ছে স্বর্ণের বার।

এরপর নানা কৌশলে হাত বদল করে। একেকটা গ্রুপ একেক অংশে দায়িত্ব পালন করে, যার কাছ থেকে তারা গ্রহণ করে তাদের যেমন তারা চেনে না তেমনি যার কাছে দেয় তাদেরও চেনে না। কিছু সাংকেতিক, কিছু সিম্বল তারা ব্যবহার করে একে অপরের কাছে বদল করে। এ কারণে শিকড়ের গোড়ায় পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ