তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডে মৃত ব্যক্তি, বিদেশে থাকা অথবা অবসরে যাওয়া কর্মীদের নামে বেতন-ভাতা হয়। শুধু তাই নয়, মৃত ও বিদেশে থাকা ব্যক্তিদের স্থলে যারা কাজ করতেন, তাদের থেকে ঘুষও নিয়েছেন তিতাসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এমনটাই জানা গেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন সোহেল রানা। ২০১৩ সাল থেকে তিনি আর সেখানে চাকরি করছেন না। কিন্তু তার নামে প্রায় আট বছর নিয়মিত বেতন-ভাতা হয়েছে। তার ব্যাংক হিসাবে টাকাও গেছে। সেই বেতন কে তুলে নিয়েছেন, তার খোঁজে নেমে দেখা গেছে, সোহেল রানার নাম ব্যবহার করে সেখানে বিধিবহির্ভূতভাবে কাজ করেছেন জাকারিয়া মাসুদ নামের এক ব্যক্তি। তবে তিনি বেতন পেয়েছেন ‘নগদে’।
জাকারিয়া মাসুদ বলেন, তিনি সোহেল রানার নামে ডিউটি করেছেন, তবে বেতন পেয়েছেন অনেক কম। তিনি বলেন, ‘আমি নিয়োগ পেয়েছিলাম তিতাস অফিসের একজনের মাধ্যমে। ৮০ হাজার টাকা দিয়ে এ চাকরি পেয়েছি। আমি জানতাম না সোহেল রানার নামে আমাকে চাকরি দেয়া হয়েছে। চাকরিতে যোগদানের দুদিন পর রোস্টারে স্বাক্ষর করতে গিয়ে দেখি আমার নাম নয়- সোহেল রানার নাম। পরে আমি ঠিকাদার কোম্পানি (মেসার্স প্যান্থার সিকিউরিটি) ও তিতাসে অনেকবার গিয়েছি। আমি মাসুম স্যারের বাসায়, অফিসে (বর্তমানে তিতাসের কোম্পানি সচিব, তৎকালীন উপ-মহাব্যবস্থাপক লুৎফুল হায়দার মাসুম) গিয়েছি। কিন্তু সবাই বলেছেন চুপ করে কাজ করতে। বলেছেন কোনো অসুবিধা হবে না। এভাবে গত আট বছর সবাই আমাকে সোহেল রানা নামেই চিনেছেন।’
একইভাবে আল আমিন নামের একজন আট বছর ধরে চাকরি করেছেন মৃত ইব্রাহিম খলিল ‘সেজে’। ইব্রাহিম খলিল অনেক আগেই মারা গেছেন। আল আমিন বলেন, ‘৯০ হাজার টাকা দিয়ে আমি ঢুকেছিলাম। জাহাঙ্গীর নামের একজনকে টাকা দিয়ে চাকরিটা পাই। অনেকবার বলেছি, এত টাকা দিয়ে ঢুকেছি, অন্যের নামে কাজ কেন করব? তবু তারা নাম পরিবর্তন করেনি।’
এদিকে এ ব্যাপারে ইতোমধ্যেই দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে দুদকের সহকারী পরিচালক রনজিৎ কুমার কর্মকারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি এনফোর্সমেন্ট টিম গত ২৯ নভেম্বর অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় মৃত ব্যক্তি, বিদেশে থাকা, অবসরে যাওয়া তিতাসের কর্মীদের নামে নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে চাকরি করেছেন, এমন ৩৭ জনকে চিহ্নিত করেছে দুদক। এসব নিরাপত্তা প্রহরীর অনেকেই একটি চক্রকে ৯০ হাজার থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিয়ে তিতাস গ্যাস কোম্পানিতে নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে চাকরি পেয়েছেন বলে জানা গেছে। আর ঘুষ নেয়া তিতাসের সেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খোঁজে অভিযানে গিয়ে এরই মধ্যে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ঘটনা জানাজানি হলে তিতাস কর্তৃপক্ষ ৩৭ নিরাপত্তা প্রহরীকে ছাঁটাই করে আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান প্যান্থার সিকিউরিটির সঙ্গে সব ধরনের চুক্তি বাতিল করেছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে দুদকের সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মোহাম্মদ শফিউল্লাহ বলেন, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশ করে তিতাসের সাবেক নিরাপত্তা প্রহরী, যারা মৃত অথবা অবসরে গিয়েছেন তাদের নামে কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগে অভিযান পরিচালনা করে দুদক টিম। অভিযান পরিচালনাকালে টিম তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, কোম্পানি সচিব এবং মহাব্যবস্থাপকের (প্রশাসন) সঙ্গে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ, বেতনসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা ও উপাত্ত সংগ্রহ করেছে।
দুদক সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, তিতাস কর্তৃপক্ষ দুদক টিমকে জানিয়েছে, পূর্ববর্তী আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল এবং অভিযুক্ত নিরাপত্তা প্রহরীদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এছাড়া আগে নিয়োগপ্রাপ্ত নিরাপত্তা প্রহরীদের ৩০০ জনের এনআইডি যাচাই করে নতুন আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পুনঃনিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর বিরুদ্ধে কেন এত দিন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, দুর্নীতির সঙ্গে কারা জড়িত এবং তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এ সব প্রশ্নের যথাযথ জবাব দিতে পারেনি তিতাস কর্তৃপক্ষ। বরং বিতর্কিত অনেক প্রশ্নের জবাবে তারা চুপ ছিল বলে জানা গেছে।
সূত্র আরও জানায়, তিতাস কর্তৃপক্ষ দুদক টিমকে জানিয়েছে বর্তমানে কর্মরত নিরাপত্তা প্রহরীদের যাবতীয় তথ্য, বেতন বিল, অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদন, নিয়োগবিধি এবং নতুন আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার ফাইলের অনুলিপি দুদককে সরবরাহ করবে। তবে প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ওই নথিপত্র দুদকের কাছে সরবরাহ করা হয়নি। এদিকে নাম বদল করে চাকরি করা লোকেরা জানিয়েছেন, নিরাপত্তাকর্মীদের মধ্যে যারা মৃত, যারা বিদেশে গেছেন কিংবা অবসরে, তাদের ‘নামে’ চাকরি হয়েছে। তারা জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবি জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু ওগুলো ব্যবহার করা হয়নি।
নিয়ম অনুযায়ী, তিতাসের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা কার্যালয়ে একজনকে নিরাপত্তা প্রহরী পদে চাকরি পেতে হলে জীবনবৃত্তান্ত, শিক্ষাগত যোগ্যতা, জাতীয় পরিচয়পত্র, চেয়ারম্যানের সনদ জমা দিতে হয়। নিরাপত্তা প্রহরী নেয়ার আগে পুলিশি যাচাই (ভেরিফিকেশন) প্রতিবেদন জমা দিতে হয়।
তিতাসের দুজন কর্মকর্তা বলেন, এত বড় অনিয়মের বিষয়টি নিয়ে কানাঘুষা শুরু হওয়ার পর বর্তমানে তিতাসের কোম্পানি সচিব ও তৎকালীন উপমহাব্যবস্থাপক লুৎফুল হায়দার নিজেই একটি তদন্ত কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন। এরপর ইনস্টলেশন অব প্রি-পেইড গ্যাস মিটার ফর টিজিটিডিসিএলের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক ফয়জার রহমানকে প্রধান করে কমিটি গঠন করা হয়। তবে কমিটিকে আর্থিক বা অসংগতির বিষয়টি বের করার বিষয়ে কার্যপরিধিতে কিছু উল্লেখ ছিল না। ওই দুই কর্মকর্তা বলেন, এ তদন্ত প্রতিবেদন অনেক দিন ধামাচাপা দেয়া হয়। অন্যদিকে যারা অন্য নামে নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ করেছেন, তাদের কিছুদিন বাড়িতে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়।
সূত্র মতে, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে তিতাসে জনবল সরবরাহ করেছিল মেসার্স প্যান্থার সিকিউরিটি সার্ভিসেস। নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। তবে প্যান্থার সিকিউরিটি দাবি করেছে, তারা যা করেছে, তা তিতাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানিয়েই।
ইনস্টলেশন অব প্রি-পেইড গ্যাস মিটার ফর টিজিটিডিসিএলের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক ফয়জার রহমান বলেন, নিরাপত্তার দায়িত্বে অনেক আগে কিছু লোক নেয়া হয়েছিল। এদের জায়গায় অন্য লোকেরা এসে আগের লোকদের নামে টাকা তুলে নিয়েছে। সরজমিন গিয়ে সত্যতা পেয়েছি। জীবনবৃত্তান্ত ছাড়া ওদের কাছে কীভাবে বিল গেল, কেউ তা তদারক করেননি। এর ফলে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। বহিরাগত লোকদের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার দায়িত্ব দেয়া বিরাট অবহেলা। নিরাপত্তা প্রহরীদের হাজিরা শিটে স্বাক্ষর, প্রতিস্বাক্ষর ও প্রত্যয়ন করেছেন ১৪ কর্মকর্তা।
যারা বেতন-ভাতায় স্বাক্ষর করেছেন: নিরাপত্তা প্রহরীদের হাজিরা শিটে স্বাক্ষর, প্রতিস্বাক্ষর ও প্রত্যয়ন করেছেন ১৪ কর্মকর্তা। তারা হলেন তিতাসের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক আবদুল হাকিম, উপ-মহাব্যবস্থাপক (অবসরপ্রাপ্ত) আমিরুল আসগর খান, উপ-মহাব্যবস্থাপক মাইন উদ্দিন, লুৎফুল হায়দার, আবুল সালেহ মাহমুদ, ব্যবস্থাপক শাহ মো. আল মাহমুদ, মিজানুর রহমান, আবদুস সালাম সরদার, ছায়েফ উদ্দীন, ব্যবস্থাপক (তৎকালীন উপব্যবস্থাপক) ফজলুল হক, উপ-ব্যবস্থাপক মেসবাহুল আলম, সহকারী ব্যবস্থাপক শামসুল হক (অবসরপ্রাপ্ত), সহকারী ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল ও সহকারী কর্মকর্তা কারিমুল হক। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে নিরাপত্তা বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন উপ-মহাব্যবস্থাপক লুৎফুল হায়দার। জনবল প্রতিস্থাপন, নিরাপত্তা প্রহরীর নামে নিয়োজিত অপর কর্মীকে বেতন-ভাতা প্রদান, নিরাপত্তা বিভাগ থেকে প্রত্যয়নের বিষয়টি যাচাই-বাছাই করার দায়িত্বও তার ছিল। লুৎফুল হায়দার এ ব্যাপারে বলেন, ‘আমি বিভিন্ন স্থাপনা ঘুরে বিষয়টি জানতে পেরেছি। আগে জানতাম না। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান প্যান্থার যে লোক বদল করেছে, তা আমাদের বলেনি।’
তবে প্যান্থার সিকিউরিটি বলছে, তিতাসের অনুমতি ছাড়া কোনো লোককে এর নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ দেয়া সম্ভব নয়। প্যান্থার সিকিউরিটি সার্ভিসের পরিচালক কামরুজ্জামান দুলাল বলেন, ‘তিতাসে আমরা আমাদের লোক কখনই নিয়োগ দিতে পারি না। তিতাসের কর্মকর্তারা যাদের নাম দেন, আমরা তাদেরই নিয়োগ দিয়েছি। তাদের মামাতো ভাই, ফুফাতো ভাই, ইউনিয়নের তদবিরেই লোক নিয়োগ দিয়েছি। তারা আমাদের তালিকা দিয়েছিলেন, আমরা ব্যবসায়িক খাতিরে ওদের নিয়োগ দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা কাজ করতে গিয়ে তো আর যুদ্ধ করতে পারি না। আমরা যা করেছি, তাদের জানিয়েই করেছি।’ তাদের ঠিকাদারি কোম্পানিটি আর সক্রিয় নেই বলে তার দাবি।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এ ব্যাপারে বলেন, ‘বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর, আমাকেও বিষয়টি জানান হয়নি। জ্বালানি বিভাগকে আমি অনেকবার বলেছি নীতি মেনে পরামর্শক নিয়োগ করে নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ দেয়ার জন্য। তারা তা করে না, কথাও শোনে না। কেন এ বিষয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি সেটা আমি জানতে চাইব, কঠিন ব্যবস্থা নেব।’
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ